- বইয়ের নামঃ সমগ্র কিশোর সাহিত্য
- লেখকের নামঃ নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়
- প্রকাশনাঃ আনন্দ পাবলিশার্স (ভারত)
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
অন্ধকারের আগন্তুক (উপন্যাস)
এক
বেঙ্গল-আসাম রেলপথের একটা ছোট স্টেশনের ওপর কৃষ্ণপক্ষের রাত ঘুটঘুট করছিল। স্টেশনটা কিন্তু বাংলা দেশে নয়, আসামেও নয়। তোমরা হয়তো জানো, বাংলাদেশের ঠিক প্রতিবেশী, উত্তর বিহারে একটা জেলা আছে-নাম পূর্ণিয়া। অনেকদিন আগে পূর্ণিয়াকে বাংলার মধ্যে ধরা হত–পরে এটাকে বিহারের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়েছে। আজও এ-জেলার একটা অংশের মানুষ পুরোপুরি বাঙালী হাটে বাজারে বন্দরেগঞ্জে অসংখ্য বাঙালীর বসতি।
এই জেলাটার ভিতর দিয়ে বেঙ্গল-আসাম রেলপথের অনেকগুলো শাখা প্রকাণ্ড একটা বটগাছের ডালপালার মতো ছড়িয়ে রয়েছে। তারই কোনও একটা শাখাপথের ওপরে ছোট্ট একটি স্টেশন–ধরা যাক তার নাম মানিকপুর।
রাত বারোটা পেরিয়ে গেছে। স্টেশনমাস্টার গণেশবাবু টেবিলে একটা পা তুলে দিয়ে হাঁ করে নাক ডাকাচ্ছেন আর মাঝে মাঝে চমকে জেগে উঠেই গালে ও কপালে প্রাণপণে থাবড়া মেরে মশা মারবার চেষ্টা করছেন। কিন্তু মাঠের বেপরোয়া মশা চড়চাপড়ে ভয় তো পাচ্ছেই না, চারিদিক থেকে আরও মরিয়া হয়ে ছেকে ধরেছে।
কিন্তু ধৈর্যেরও সীমা আছে মানুষের।
শেষ পর্যন্ত চেয়ার থেকে তোক করে নেমে পড়লেন গণেশবাবু।
খানিকক্ষণ অভদ্র ভাষায় মশাদের বাপ বাপান্ত করলেন, তারপর কোণের কুঁজো থেকে ঢকঢক করে গেলাস তিনেক জল গড়িয়ে খেয়ে একটা বিড়ি ধরালেন।
ঢং। ঘড়িতে সাড়ে বারোটা।
জল খেয়ে গরম লাগছিল। কোটটা খুলে গণেশবাবু বাইরে বেরিয়ে এলেন।
অদ্ভুত গুমোট রাত। আকাশের তারাগুলোকে নিবিয়ে দিয়ে মেঘ এসে জমেছে–যেন অন্ধকারের একটা বিরাট ডাইনী-মূর্তি চারদিকে তার গুচ্ছ গুচ্ছ কালো কালো চুল মেলে দিয়েছে। স্টেশনের পেছনে ফাঁকা মাঠ–তার ভেতর দিয়ে একটা ধুলোভরা মেঠো রাস্তা তারার আলোয় খানকিটা আবছা আভাস দিয়ে মিলিয়ে গেছে। একটু দূরে সেই পথের ওপর ঝাকড়া একটা বটগাছ অন্ধকারকে আরও কালো করে ওত পেতে বসে আছে যেন আদ্যিকালের বদ্যিবুড়ির মতো। একফোঁটা বাতাস নেই কোথাও–গাছের একটা পাতা অবধি নড়ছে না।
সামনে মিটার গেজের ছোট ছোট তিনটি লাইন। ওপারে একটা অন্ধকার ফাঁকা মালগুদাম–তার পেছনে মাটিটা ঢালু হয়ে নেমে গেছে বিল আর শ্যাওড়াবনের মধ্যে। ওখানে শেয়াল আছে, বুনো শুয়োর আছে, কখনও কখনও নাকি চিতাবাঘও এসে আস্তানা গাড়ে শীতের সময়। আশেপাশে দু-তিন মাইলের মধ্যে জনমানুষের বসতি নেই–শুধু রেল-কোম্পানির বাবু আর কুলিদের ছোট ছোট তিন-চারটে কোয়ার্টার ছাড়া।
সৃষ্টিছাড়া জায়গা–তার চেয়ে সৃষ্টিছাড়া একটা ইস্টেশন!
অত্যন্ত বিরক্ত মনে গণেশবাবু প্ল্যাটফর্মের উপর পায়চারি করতে লাগলেন। তাঁর ডিউটি রাত তিনটে পর্যন্ত–অথচ এখন মোটে সাড়ে বারোটা। অর্থাৎ আরও অন্তত আড়াই ঘণ্টা এখানে নরক-যন্ত্রণা ভোগ করতে হবে। আর যা মশা-সন্ধে থেকেই কানের কাছে যেন। ক্ল্যারিয়োনেট বাজাচ্ছে।
ভুঁড়িটার ওপর হাত বুলোত বুলোতে গণেশবাবু ভাবতে লাগলেন, এখন ম্যালেরিয়া না ধরলেই বাঁচা যায়! বরাবর কলকাতায় মানুষ কলকাতার ছেলে, সাপ, ব্যাঙ, জোঁক, ম্যালেরিয়ার নামে তাঁর গায়ের রক্ত শুকিয়ে আসবার উপক্রম করে। অথচ সেই গণেশবাবুকেই কিনা শিয়ালদা থেকে একেবারে এই অজগর বিজুবনে বদলি করে দিলে! রাগে-দুঃখে গণেশবাবুর মাথার মধ্যে রক্ত চনচন করতে লাগল।
সব দোষ ওই ব্যাটা ফিরিঙ্গির–ওই গোমেজটার। গোমেজ তো নয়–এক সঙ্গে গো এবং মেষ। তারই লোভের প্রায়শ্চিত্ত করতে হচ্ছে গণেশবাবুকে। বন্ধু তো নয়, শনি!
একঝুড়ি ভাল ল্যাংড়া আম যাচ্ছিল কলকাতা থেকে জলপাইগুড়িতে। গোমেজের বুদ্ধিতে পড়ে তারই গোটাকয়েক দুজনে মিলে ভাগাভাগি করে নির্বিবাদে সেবা করেছিলেন, তারপর ইট-পাটকেল দিয়ে ঝুড়ির মুখ বন্ধ করে দিয়েছিলেন। কিন্তু আম যাচ্ছিল জলপাইগুড়ি কলেজের ফিজিক্সের প্রফেসার ভাদুড়ীমশায়ের নামে। তিনি দুদে লোক শ্রাদ্ধ অনেক দূর গড়াল, গেল আদালত পর্যন্ত।
গোমেজ নিরাপদে স্রেফ কেটে গেল, কিন্তু জালে পড়লেন গোবেচারা পেটুক মানুষ গণেশবাবু। ফলে, এক ধাক্কায় গণেশবাবু কলকাতা থেকে এই মাঠ আর জঙ্গলের মধ্যে এসে পড়লেন। পাপের ভোগ আর কাকে বলে!
আগুন হয়ে গণেশবাবু ভাবতে লাগলেন, গোমেজকে এখন হাতের কাছে পেলে এক চাঁটিতে তিনি তার গলাসুদ্ধ উড়িয়ে দিতেন। উঃ, এখানে মানুষ থাকতে পারে। কোনদিন যে বাঘে মুখে করে নেয় ঠিক নেই। আর তাও যদি না হয়-যা মশার অত্যাচার-তিনদিনেই রক্ত শুষে ছিবড়ে করে দেবে তারা। গণেশবাবুর কান্না পেতে লাগল।
রাত থমথম করছে! কোনওখানে একটু হাওয়া নেই–শুধু যেন চারিদিক থেকে রোদ-পোড়া মাটির গন্ধ উঠছে। আকাশে জমেছে কালো মেঘের রাশ। ঝড় বৃষ্টির লক্ষণ দেখা দিচ্ছে ঈশানের কোণায় কোণায়।
হঠাৎ গণেশবাবুর ভয়ানক ভয় করতে লাগল। কেমন আশ্চর্য লাগছে রাতকে অদ্ভুত লাগছে পৃথিবীকে। মনে হল, এমন রাত্রে সম্ভব-অসম্ভব কত কী যে ঘটতে পারে। হালুম করে অন্ধকার মালগুদামটার ওপাশ থেকে একটা বাঘ এসে লাফিয়ে পড়তে পারে, রেললাইনের ওপর থেকে একটা শঙ্খচূড় সাপ ফণা উঁচু করে তেড়ে আসতে পারে, দূরের ওই বটগাছটা থেকে গোটা কয়েক কালো কালো, মোটা-রোগা, লম্বা-বেঁটে, মাদো কিংবা হেঁড়ে ভূত এসে নাচানাচি শুরু করতে পারে!