অবলাকান্ত বললে, নাম জানিনে স্যার। কম্বলরামের দোস্ত–কাঁথারাম বোধ হয়।
হেঁড়ে গলায় লোকটা বললে, শতরঞ্চিরাম হতেও বাধা নেই।
বাকি সবাই একসঙ্গে বললে, হ্যাঁ, শতরঞ্চিরামও হওয়া সম্ভব।
সিন্ধুঘোটক বললে, অর্ডার- অর্ডার বলেই আবার গড়গড়ার নলটা মুখে তুলে নিলে। আর এইবার আমি লক্ষ করে দেখলুম, গড়গড়ায় কলকে-টলকে কিছু নেই, শুধু-শুধু একটা নল মুখে পুরে সিন্ধুঘোটক বসে আছে।
–তারপর কম্বলরাম–
এতক্ষণ টেনিদা আলু-চচ্চড়ির মতো মুখ করে বসে ছিল, এবার গাঁ-গাঁ করে উঠল।
—দেখুন স্যার, এরা গোড়া থেকেই ভুল করেছে। আমি তো কম্বলরাম নই-ই, আমাদের সাতপুরুষের মধ্যে কেউ কম্বলরাম নেই। আমি হচ্ছি টেনি শর্মা-ওরফে ভজহরি মুখুজ্যে, আর এ হল প্যালারাম—ওর ভালো নাম স্বর্ণেন্দু ব্যানার্জি। আমরা পটলডাঙায় থাকি। গরমের জ্বালায় অস্থির হয়ে আমরা গঙ্গার স্নিগ্ধ সমীর সেবন করছিলুম, আপনার ঘেঁটুচন্দর আর অবলাকান্ত গিয়ে আমাদের জোর করে ধরে এনেছে।
শুনে, সিন্ধুঘোটকের মুখ থেকে টপ করে নলটা পড়ে গেল। তিনটে কোলা ব্যাঙের ডাক একসঙ্গে গলায় মিশিয়ে সিন্ধুঘোটক প্রায় হাহাকার করে উঠল : ওহে অবলাকান্ত, এরা কী বলে?
অবলাকান্ত ব্যস্ত হয়ে বললে, বাজে কথা বলছে, স্যার। এই কম্বলরামটা দারুণ খলিফা—তখন থেকে আমাদের সমানে ভোগাচ্ছে। আপনিই ভালো করে দেখুন না, স্যার। কম্বলরাম ছাড়া এমন চেহারা কারও হয়? এমন লম্বা তাগড়াই চেহারা, এমন একখানা মৈনাকের মতো খাড়া নাক, এমনি তোবড়ানো চোয়াল–
দাঁড়াও—দাঁড়াও!—সিন্ধুঘোটক হঠাৎ তার ছোট্ট মাথা আর কুঁতকুঁতে চোখ দুটো সামনের দিকে বাড়িয়ে দিলে : কিন্তু কম্বলরামের নাকের পাশে যে একটা কালো জড়ল ছিল, সেটা কোথায়?
সঙ্গে সঙ্গে বাকি লোকগুলো সবাই ঝুঁকে পড়ল টেনিদার মুখের ওপর : তাই তো, জড়লটা কোথায়?
টেনিদা খ্যাঁচম্যাচ করে বললে, আমি কি কম্বলরাম যে জড়ল থাকবে? এইবার আপনারাই বলুন তো মশাই, এই দারুণ গ্রীষ্মের সন্ধেবেলায় খামকা দুটো ভদ্র সন্তানকে হয়রান করে আপনাদের কী লাভ হল?
কিছুক্ষণ সব চুপচাপ। তারপর সিন্ধুঘোটক ডাকল : অবলাকান্ত!
-বলুন স্যার!
—এটা কী হল?
—আজ্ঞে, অন্ধকার স্যার ভালো করে ঠাওর পাইনি। মাথা চুলকোতেকুলকোতে অবলাকান্ত বললে, কিন্তু আমার মনে হয় স্যার, এটাই কম্বলরাম। চালাকি করে জড়লটাও কোথাও লুকিয়ে রেখেছে।
-শাট আপ। জড়ল কি একটা মার্বেল যে ফস করে লুকিয়ে ফেলা যায়?
—যদি অপারেশন করায়?
—হুঁ। সে একটা কথা বটে—সিন্ধুঘোটক আবার নলটা তুলে নিলে : কিন্তু অপারেশনের দাগ তো থাকবে।
–নাও থাকতে পারে স্যার। আজকাল ডাক্তারদের অসাধ্য কাজ নেই।
টেনিদা কী বলতে যাচ্ছিল, হঠাৎ দোরগোড়া থেকে কোচোয়ান বললে, হুজুর, আমার একটা নিবেদন আছে।
–বলে ফেলো পাঁচকড়ি। আউট উইথ ইট।
–কম্বলরামকে আমি চিনি, স্যার। রোজ বিকেলে মনুমেন্টের নীচে আমরা খইনি খাই। সে কলকাতায় নেই, আজ দুপুরবেলায় রেলে চেপে তার মামাবাড়ি বাঁকুড়া চলে গেছে।
শুনে, অবলাকান্ত তড়াক করে লাফিয়ে উঠল। পাঁচকড়িকে এই মারে তো সেই মারে।
—তবে এতক্ষণ বলিসনি কেন হতভাগা বুদ্ধ কোথাকার? খামকা আমাদের খাটিয়ে মারলি?
–বলে কী হবে? আমার কথা তো কেউ বিশ্বাস করে না বলে, ভারি নিশ্চিন্ত মনে পাঁচকড়ি হাতের মুঠোয় খইনি ডলতে লাগল আর গুনগুনিয়ে গান ধরল : বনে চলে সিয়ারাম, পিছে লছমন ভাই
সিন্ধুঘোটক বললে, অর্ডার, অর্ডার! পাঁচকড়ি, নো সিংগিং নাউ। কিন্তু এ-পরিস্থিতিতে কী করা যায়?
অবলাকান্ত প্যাঁচার মতো মুখ করে বসে রইল। আর বাকি সবাই একসঙ্গে বললে, তাই তো, কী করা যায়!
টেনিদা বললে, কিছুই করবার দরকার নেই স্যার। বেশ রাত হয়েছে, আমাদের তাড়াতাড়ি ছেড়ে দিন, নইলে বাড়িতে গিয়ে বকুনি খেতে হবে।
সিন্ধুঘোটক কিছুক্ষণ খালি খালি গড়গড়া টানতে লাগল। কলকে-টলকে কিছু নেই, শুধু গড়গড়ার ভেতর থেকে উঠতে লাগল জলের গুড়গুড় আওয়াজ।
তারপর সিন্ধুঘোটক বললে, হয়েছে।
অবলাকান্ত ছাড়া বাকি সবাই একসঙ্গে জিজ্ঞেস করলে, কী হয়েছে!
—প্ল্যান। কম্বলরাম যখন নেই, তখন একে দিয়েই কাজ চালাতে হবে। নাকের নীচে একটা জড়ল বসিয়ে দিলেই ব্যস—কেউ আর চিনতে পারবে না।
অবলাকান্ত ভারি খুশি হয়ে হাত কচলাতে লাগল : আমিও তো স্যার সেই কথাই বলছিলুম।
হায়–হায়, ঘাটে এসে শেষে নৌকো ড়ুবল! এতক্ষণ বেশ আরাম বোধ করছিলাম, কিন্তু সিন্ধুঘোটকের কথায় একেবারে ধুক করে নিবে গেল বুকভরা আশা। টেনিদার দিকে চেয়ে দেখলুম, ওর মুখখানা যেন ফজলি আমের মতো লম্বা হয়ে ঝুলে পড়েছে।
টেনিদা শেষ চেষ্টা করল : স্যার, আমাদের আর মিথ্যে হ্যারাস করবেন না। ভুল যখন বুঝেইছেন—
সিন্ধুঘোটক এবার কুঁতকুঁতে চোখ মেলে টেনিদার দিকে তাকিয়ে রইল খানিকটা। কী ভেবে মিনিট খানেক খ্যাঁক-খ্যাঁক করে হাসল, তারপর বললে, আচ্ছা ছোরারা, তোমরা আমাদের কী ভেবেছ বলো দেখি? রাক্ষস? খপ করে খেয়ে ফেলব?
ভাবলে অন্যায় হয় না—অন্তত সিন্ধুঘোটকের চেহারা দেখলে সেই রকমই সন্দেহ হয়। এতক্ষণে আমি বললুম, আমরা কিছুই ভাবছি না স্যার, কিন্তু বাড়ি ফিরতে আর দেরি হলে বড়দা আমার কান ধরে–
–হ্যাং ইয়োর বড়দা!–বিরক্ত হয়ে বললে, তোমার কান দুটো এমনিতেই বেশ বড় রয়েছে, একটু ছাঁটাই করে দিলে নেহাত মন্দ হবে না। ওসব বাজে কথা রাখো। তোমাদের দিয়ে আজ রাতে আমরা একটা মহৎ উদ্দেশ্য সিদ্ধ করতে চাই। যদি সফল হইতোমাদের খুশি করে রিওয়ার্ড দেব!