বলে, অবলাকান্ত তো খ্যাঁ-খাঁ করে হাসলই, সেই সঙ্গে গোবরমাখা ঘেঁটুচন্দর, গাড়ির কোচোয়ান আর দুটো লণ্ঠন হাতে চারটে লোক সবাই একসঙ্গে হেসে উঠল। আর সেই হাসির আওয়াজে পাশের একটা ঝুপসি-মতন আমগাছ থেকে গোটা দু-তিন বাদুড় ঝটপট করে উড়ে পালাল।
ঘেঁটু বললে, কই হে কম্বলরাম, গুলি ছুঁড়লে না?
টেনিদা কিছুক্ষণ ঘুগনিদানার মতো মুখ করে চেয়ে রইল, তারপর খেলনা পিস্তলটা তার হাত থেকে টপ করে পড়ে গেল। ইস ইস—আমরা কী গাড়ল। দুটো লোক আমাদের স্রেফ বোকা বানিয়ে গড়ের মাঠ থেকে ভর সন্ধেবেলায় এমন করে ধরে আনল। আগে জানলে–
কিন্তু পিস্তল-ফিস্তল চুলোয় যাক—এখন আর কিছুই করবার নেই। আমরা দুজন—কোচোয়ান সুষ্ঠু ওরা সাতজন। টেনিদার কুস্তির প্যাঁচ-ট্যাঁচ কোনও কাজে লাগবে
—সোজা চ্যাংদোলা করে তুলে নিয়ে যাবে। সেই হেঁড়ে গলার লোকটা বললে, এখানে দাঁড়িয়ে থেকে আর কতক্ষণ ভ্যারেণ্ডা ভাজবে, হে। রাত তো প্রায় আটটা বাজল। চলোচলো শিগগির। সিন্ধুঘোটক তখন থেকে হা-পিত্যেশ করে বসে আছে।
টেনিদা একবার আমার দিকে তাকাল, আমি টেনিদার দিকে তাকালুম। তারপর কী আর করা যায়—দুজনে সুড়সুড় করে এগিয়ে চললুম লোকগুলোর সঙ্গে সঙ্গে।
কোন আদ্যিকালের একটা রদ্দিমাকা বাড়ি—মানুষজন বিশেষ থাকে-টাকে বলে মনে হল না। ভাঙাচোরা সব ঘর—কোথাও একটা তেপায়া কিংবা খাটিয়া, কোথাও বা দু-একখানা ধুলোবালি-মাথা টেবিল-চেয়ার। দুটো লণ্ঠনের আলোয় ঘরগুলোকে যেমন বিচ্ছিরি, তেমনি ভয়ঙ্কর মনে হচ্ছিল। থেকে থেকে মাথার ওপর দিয়ে চামচিকে উঠে যাচ্ছিল, তাই দেখে আমি শক্ত করে নিজের কান দুটোকে হাত চাপা দিলুম। চামচিকেকে আমার ভীষণ সন্দেহজনক মনে হয়—কেন যে হঠাৎ লোকের ঘরে ঢুকে ফরফর করে উড়তে থাকে তার কোনও মানেই বোঝা যায় না। ছোড়দি বলে, ওরা নাকি লোকের কান ধরে ঝুলে পড়তে ভীষণ ভালোবাসে। আমার লম্বা লম্বা কান দুটো তাই আগে থেকেই সামলে রাখাটা বুদ্ধিমানের কাজ বলেই মনে হল আমার।
এ-ঘর থেকে ও-ঘর, ও-ঘর থেকে সে-ঘর। তারপরেই ঘরটাই বোধহয় শ্রীঘর। ভেবেই আমার মনে হল, শ্রীঘর তো থানার হাজতকে বলে। সিন্ধুঘোটক নিশ্চয় পুলিশ নয় যে আমাদের দুম করে হাজতে পুরে দেবে।
এদিকে একটা সিঁড়ি বেয়ে আমরা ওপরে উঠছি। খুব বাজে মাকা সিঁড়ি, রেলিং ভাঙা, ধাপগুলো দাঁত বের করে রয়েছে। ঠিক এমনকি একটা বাড়িতেই যত রকম ভয়ঙ্কর কাণ্ড হয়—দসর্দার চিং চুং বেপরোয়া গোয়েন্দা দিগ্বিজয় রায়কে গুম করে ফেলে, কিংবা কাঞ্চীগড়ের রাজরানী মৃদুলাসুন্দরীর হীরের নেকলেস নিয়ে গুণ্ডা তিলালের সঙ্গে ওস্তাদ কলিমুদ্দির গজকচ্ছপের যুদ্ধ বেধে যায়। আমার প্রিয় লেখক কুণ্ডু মশাইয়েরও যত সব দুর্ধর্ষ রোমাঞ্চকর কাহিনী একে-একে আমার মনে পড়ে যেতে লাগল।
কিন্তু খালি একটা খটকা লাগছে। সেসব গল্পে খেলনা পিস্তলের কথা কোনও দিন পড়িনি!
আবার এসব দারুণ দারুণ ভাবনায় হঠাৎ বাধা পড়ে গেল। সিঁড়ি পেরিয়েই সামনে মস্ত একটা ঘর। তার দরজাটা ভেজানো, কিন্তু ভেতর থেকে একটা জোরালো আলো বাইরে এসে পড়েছে। আমরা সেইখানে থেমে দাঁড়ালাম।
অবলাকান্ত বেশ মিহি গলায় ডাকল : স্যার!
ভেতর থেকে ব্যাঙের ডাকের মতো আওয়াজ এল : কে?
—আমরা সবাই। মানে কম্বলরাম সুদ্ধ এসে গেছে।
—এসে গেছে? অলরাইট! ভেতরে চলে এসো।
অবলাকান্ত দরজাটা খুলে ফেলল। আর পেছন থেকে লোকগুলো আমাকে আর টেনিদাকে ধাক্কা দিয়ে বললে, যাও–যাও, এবার স্যারের সঙ্গে মোকাবেলা করো।
সবাই আমরা ঘরে পা দিলুম।
বাড়িটা নীচে থেকেই যতই খারাপ মনে হোক—এ-ঘরটা একেবারে আলাদা। টিমটিমে লণ্ঠন নয়—মেঝেতে সোঁ-সোঁ করে একটা পেট্রোম্যাক্স বাতি জ্বলছে। মস্ত ফরাসের ওপর ধপধপে শাদা চাদর বিছানো, সেখানে তিন-চারটে তাকিয়া, আর একটা তাকিয়ায় হেলান দিয়ে—গড়গড়ার নল মুখে পুরে–
কে?
কে আর হতে পারে—সিন্ধুঘোটক ছাড়া?
চেহারা বটে একখানা! হঠাৎ দেখলে মনে হয় বোধহয় স্বপ্ন দেখছি, নিজের কানে চিমটি কেটে পরখ করতে ইচ্ছে করে। একটা লোক যে এমন মোটা হতে পারে, এক পিপে আলকাতরায় ড়ুব দিয়ে উঠে আসার মতো তার যে গায়ের রঙ হতে পারে, মন চারেক শরীরের ওপর এত ছোট যে একটা মাথা থাকতে পারে, আর ছোট মাথায় যে আরও ছোট এমন দুটো কুঁতকুঁতে চোখ থাকতে পারে—এ না দেখলে তবুও বিশ্বাস করা যায়, কিন্তু দেখলে আর কিছুতেই বিশ্বাস করবার জো নেই।
আমি প্রায় চেঁচিয়ে উঠতে যাচ্ছিলুম, ডি-লা-গ্রান্ডি মেফিস্টোফিলিস—কিন্তু সামলে নিলুম আর সিন্ধুঘোটক ব্যাঙের গলায় গ্যাং-গ্যাং করে বললে, বোসো সব, সিট ডাউন।
এমন কায়দা করে বললে– যে, আমরা যেন সব স্কুলের ছাত্র আর হেডমাস্টার আমাদের বসতে হুকুম দিচ্ছেন।
ঘেঁটুদা কাঁউমাউ করে বললে, আমি বসতে পারব না স্যার—এই কম্বলরামটা আমাকে গোবরের ভেতরে ল্যাং মেরে ফেলে দিয়েছে। গায়ে দারুণ গন্ধ।
সিন্ধুঘোটক বললে, তুমি একটা থার্ডক্লাস! আমার ফরাসে গোবর লাগিয়ো না—আগে চান করে এসো। যাও—গেট আউট।
ঘেঁটুদা তখুনি সুড়সুড় করে বেরিয়ে গেল।
আমরা সবাই তখন ফরাসে বসে পড়েছি, সিন্ধুঘোটক তাকিয়া ছেড়ে পিঠ খাড়া করে উঠে বসল। জিজ্ঞেস করলে, কে কম্বলরাম?
অবলাকান্ত টেনিদাকে একটা খোঁচা দিয়ে বললে, এইটে।
সিন্ধুঘোটক আমার দিকে আঙুল বাড়িয়ে বললে, আর রোগা চিমটে খাড়া খাড়া কানওলা ওটা কে?