ঘেঁটুদা বললে, নির্ঘাত! ডোম্বলরাম বলে ডোম্বলরাম!
অবলাকান্ত বললে, হ্যাঁ, ভোম্বলরামও বলা যায়।
বলেই দুজনে খ্যাঁ-খ্যাঁ করে হেসে উঠল।
আমরা নিজের জ্বালায় মরছি, কিন্তু ওদের যে কেন এত হাসি পেল, সে আমি বুঝতে পারলুম না। জুলজুল করে আমি একবার টেনিদার দিকে চেয়ে দেখলুম। গাড়ির ভেতরে ওকে ভালো দেখতে পাওয়া যাচ্ছিল না, কিন্তু যেটুকু দেখলুম তাতে মনে হল রাগে ওর দাঁত কিড়মিড় করছে। নিতান্তই দু-দুটো পিস্তল না থাকলে এতক্ষণে একটা কেলেঙ্কারি হয়ে যেত।
গাড়িটা চলছে তো চলছেই। মাঝে-মাঝে গাড়োয়ান এক-একবার জিভে-টাকায় এক-একটা কটকট আওয়াজ করছে, আর সাঁই সাঁই করে চাবুক হাঁকড়াচ্ছে। গাড়িটার থামবার নামই নেই। একসময় মনে হল, পিচের রাস্তা ছেড়ে খোয়াওঠা পথ ধরল আর থেকে-থেকে এক-একটা বেয়াড়া ঝাঁকুনিতে পিলেসুন্ধু নড়ে যেতে লাগল।
এতক্ষণ পথের পাশে গাড়ি-টাড়ির আওয়াজ পাচ্ছিলুম, ট্রামের ঘণ্টি কানে আসছিল, লোকের গলা পাওয়া যাচ্ছিল, কানে আসছিল রেডিয়ো-টেডিয়োর শব্দ। এখন মনে হল, হঠাৎ যেন সব নিঝুম মেরে গেছে, কোথায় যেন ঝিঝি-টিঝি ডাকছে, থেকে থেকে পেঁকো গন্ধ বন্ধ গাড়ির ভেতরেও এসে ঢুকছে। তার মানে উদ্ধারের শেষ আশাটুকুও গেল। এখন আমরা চলেছি একেবারে সিন্ধুঘোটকের খপ্পরে—কোন্ পোড়াবাড়ির পাতালে নিয়ে আমাদের দুম করে গুম করে ফেলবে—কে জানে!
হঠাৎ ক্যাবলার কথা মনে পড়ে আমার ভারি রাগ হতে লাগল। ক্যাবলা বলে ওসব গোয়েন্দা-গল্প স্রেফ গাঁজা বানিয়ে বানিয়ে লেখে, আমি এক বর্ণও বিশ্বাস করি না। কিন্তু আজ রাতে সিন্ধুঘোটকের পাল্লায়–
খ্যাড়—খ্যাড়-খ্যাড়াৎ–
গাড়িটা কাত হয়ে উল্টে পড়তে-পড়তে সামলে নিলে মনে হল, কোনও নালাফালায় নেমে যাচ্ছিল। আমি একেবারে অবলাকান্তের ঘাড়ে গিয়ে পড়লুম—সে বললে, উঁহু-উঁহু, নাকটা গেল মশাই। ওদিকে ঘেঁটুদার গলা থেকে আওয়াজ বেরুল : ক্যাঁক—গেলুম!
আর তক্ষুনি টেনিদা বললে, ঘেঁটুচন্দর—এবার! তোমার পিস্তল তো কেড়ে নিয়েছি আগে তোমার দফা নিকেশ করে ছাড়ব!
আমি চমকে উঠলাম। অন্ধকারে ভালো দেখা যাচ্ছি না, কিন্তু বুঝতে পারলুম, গাড়িটা কাত হওয়ার ঝাঁকুনিতে টেনিদা সুযোগ পেয়ে ফস করে ঘেঁটুর পিস্তলটা ছিনিয়ে নিয়েছে! একেই বলে লিডার। কিন্তু অবলাকান্তের হাতে তো পিস্তলটা এখনও রয়েছে। টেনিদা না হয় ঘেঁটুকে ম্যানেজ করল, কিন্তু অবলাকান্ত যে এক্ষুনি আমায় সাবাড় করে দেবে।
টেনিদা বললে, ওয়ান-টু-থ্রি। শিগগির গাড়ির দরজা খোলো, নইলে–
আমি তো কাঠ হয়ে বসে আছি—খালি মনে হচ্ছে, এখুনি আমি গেলুম। এইবারে দু-দুটো পিস্তলের আওয়াজ—ঘেঁটুচন্দর চিত, আমারও বাতচিত চিরতরে ফিনিশ! তারপর রইল টেনিদা আর অবলাকান্ত কিন্তু মহাযুদ্ধের সেই শেষ অংশটা আমি আর দেখতে পাব না, কারণ আমি ততক্ষণে দুনিয়া থেকে অনেক দূরে সরে পড়েছি।
গোয়েন্দা-উপন্যাসে এসব জায়গায় একটা দারুণ অবস্থার সৃষ্টি হয়। পড়তে-পড়তে লোকের মাথার চুল খাড়া হয়ে যায়। অথচ ঘেঁটু আর অবলাকান্ত হঠাৎ খাঁ খাঁ করে অট্টহাসি হাসল।
টেনিদা কী বলতে যাচ্ছিল, তার আগেই অবলাকান্ত বললে, শাবাশ কম্বলরাম, তুমি বীর বটে। তোমার বীরত্ব দেখে আমার চন্দ্রগুপ্ত নাটকের পার্ট বলতে ইচ্ছে করছে। আলেকজান্ডারের মতো—যাও বীর, মুক্ত তুমি। কিন্তু সে আর হওয়ার জো নেই, কারণ। আমরা সিন্ধুঘোটকের আস্তানায় ঢুকে পড়েছি।
আর তক্ষুনি চট করে গাড়িটা থেমে গেল। কোচোয়ান ঘরঘর করে গাড়ির দরজা খুলে দিয়ে বললে, নামো।
টেনিদা চেঁচিয়ে উঠল : সাবধান, আমি এখুনি গুলি ছুঁড়ব বলে দিচ্ছি—আমার হাতে পিস্তল–
বলতে বলতে গাড়ির ওধারটা খুলে অবলাকান্ত টপ করে নেমে গেল। আর ঘেঁটুদা বললে– থাম ছোকরা, বেশি বকিসনি। পিস্তল-ফিস্তল ছুড়ে আর দরকার নেই, নেবে আয়–
আর এদিক থেকে অবলাকান্ত এক হ্যাঁচকায় আমাকে নামিয়ে ফেলল, ওদিক থেকে টেনিদা আর ঘেঁটুদা জড়াজড়ি করতে করতে একসঙ্গে কুমড়োর মতো গড়িয়ে পড়ল গাড়ি থেকে।
আমি দেখলুম, সামনে একটা ভুতুড়ে চেহারার পোডোমতো পুরনো বাড়ি। তার ভাঙা সিঁড়ির সামনে গাড়ি এসে থেমেছে, চারজন লোক দুটো লুণ্ঠন হাতে করে এগিয়ে আসছে। আমাদের দিকে।
একজন হেঁড়ে গলায় বললে, কী ব্যাপার কুস্তি লড়ছে কারা?
টেনিদা ততক্ষণে ধাঁ করে একটা ল্যাং কষিয়ে ঘেঁটুকে উল্টে ফেলে দিয়েছিল। ঘেঁটু গ্যাঙাতে-গ্যাঙাতে উঠে দাঁড়াল। বললে, তোমরা তো বেশ লোক, হে! দিব্যি বুঝিয়ে দিলে, কম্বলরামটা এক নম্বরের ভিতু, একটু ভয় দেখালেই ভিরমি খেয়ে পড়বে। এ তো দেখছি। সমানে লড়ে যাচ্ছে, আবার একটা প্যাঁচ কষিয়ে আমায় চিত করে ফেললে। ইঃ—একগাদা গোবর-টোবর না কীসের মধ্যে যেন ফেলে দিয়েছে হেকী গন্ধ। ওয়াক।
টেনিদা চেঁচিয়ে উঠল : হুঁশিয়ার, আমার হাতে তৈরি পিস্তল।
লোক চারটে থমকে দাঁড়িয়ে মুখ চাওয়া-চাওয়ি করলে। শেষে একজন বললে, পিস্তল! পিস্তল আবার কোত্থেকে এল হে।
অবলাকান্ত বললে, দুত্তোর পিস্তল। সেই যে কম্বলরামকে ভয় দেখাব বলে ফিরিওলার কাছ থেকে আড়াই টাকা দিয়ে দুটো কিনেছিলুম, তারই একটা কেড়ে নিয়েছে আর তখন। থেকে শাসাচ্ছে আমাদের। বলেই আমার হাতে নিজের পিস্তলটা জোর করে গুঁজে দিয়ে বললে, ওহে কম্বলরামের দোস্ত কাঁথারাম, তোমারও গুলি ছোঁড়বার সাধ হয়েছে নাকি। তা হলে এটা তোমায় প্রেজেন্ট করলুম, চার আনার ক্যাপ কিনে নিয়ো—আর সারাদিন দুমফটাক করে বাড়ির কাক-টাক তাড়িয়ে।