টেনিদার মতো বেপরোয়া লিডারেরও মুখ-টুখ শুকিয়ে প্রায় আলুকাবলির মতো হয়ে গেছে, খাঁড়ার মতো লম্বা-নাকটা ঝুলে পড়েছে নীচের দিকে। কুক্ষণে বেশ কায়দা করে দুজনে একটা নিরিবিলি জায়গা বেছে নিয়েছিলুম—আশেপাশে লোকজন কোথাও কেউ নেই! চেঁচিয়ে ডাক ছাড়লে, দু-পাঁচজন নিশ্চয় শুনতে পাবে, কিন্তু আমরা আর তাদের বিশেষ কিছু শোনাতে পারব না, তার আগেই দু-দুটো পিস্তলের গুলিতে আমাদের দুনিয়া থেকে কেটে পড়তে হবে! একেবারে দেন অ্যান্ড দেয়ার!
আমার সেই ছেলেবেলার পিলেটা আবার যেন নতুন করে লাফাতে শুরু করল, কানের ভেতরে যেন ঝিঝি পোকারা ঝিঝি করতে লাগল, নাকের মধ্যে উচ্চিংড়েরা দাঁড়া নেড়ে সুড়সুড়ি দিচ্ছে এমনি মনে হতে লাগল! ভীষণ ইচ্ছে করতে লাগল অজ্ঞান হয়ে যাই, কিন্তু দু-দুটো পিস্তলের ভয়ে কিছুতেই অজ্ঞান হতে পারলুম না।
টেনিদা-ই আবার সাহস করে, বেশ চিনি-মাখানো মোলায়েম গলায় তাদের বুঝিয়ে-সুঝিয়ে বলতে লাগল : দেখুন মশাইরা, আপনারা ভীষণ ভুল করছেন। এখানে কম্বল বলে কেউ নেই, কম্বল বলে কাউকে আমরা চিনি না, শীতকালে আমরা কম্বল গায়ে দিই না—লেপের তলায় শুয়ে থাকি। এ হল আমার বন্ধু পটলডাঙার প্যালারাম, আর আমি হচ্ছি শ্রীমান টেনি, মানে–
মোটা লোকটা ঘোঁত-ঘোঁত করে বললে, মানে কম্বলরাম। প্যালারামের বন্ধু কম্বলরাম রাম রামে মিলে গেছে। যাকে বলে, রামে এক, রামে দো! ঘুঘু খুঁত
শেষের বিটকেল আওয়াজটা বের করল নাক দিয়ে। হাসল বলে মনে হল। আর সেই বিচ্ছিরি হাসিটা শুনে অত দুঃখের ভেতরেও আমার পিত্তিসুষ্ঠু জ্বালা করে উঠল।
সেই ঢ্যাঙা লোকটা খ্যাচম্যাচ করে বললেন, কী হাসি মস্করা করছ হে অবলাকান্ত। ফস করে একটা পুলিশ-ফুলিশ এসে যাবে, তা হলেই কেলেঙ্কারি। ওদিকে সিন্ধুঘোটক তখন থেকে খাপ পেতে বসে রয়েছে, কম্বলরামকে নিয়ে তাড়াতাড়ি না ফিরলে আমাদের জ্যান্ত চিবিয়ে খাবে! চলোচলো! ওঠো হে কম্বলরাম, আর দেরি নয়। গাড়ি রেডিই রয়েছে।
রেডি রয়েছে, তাতে আর সন্দেহ কী! একটু দূরেই দরজাবন্ধ একটা ঘোড়ার গাড়ি ঠায় দাঁড়িয়ে। বুঝতে পারলুম, ওটা কম্বলরামকেই অভ্যর্থনা করবার জন্যে এসেছে।
টেনিদা বললে, দেখুন বুঝতে পারছেন–
–আমাদের আর বোঝাতে হবে না, সিন্ধুঘোটককেই সব বুঝিয়ো। নাও—চলো–বলেই ঢ্যাঙা লোকটা পিস্তলের নল টেনিদার পিঠে ঠেকিয়ে দিলে।
আর এ-অবস্থায় হাত তুলে নির্বিবাদে সুড়সুড় করে হেঁটে যেতে হয়, গোয়েন্দার গল্পের বইতে এই রকমই লেখা আছে। টেনিদা ঠিক তাই করল। আমি সরে পড়ব ভাবছি—দেখি বেঁটে লোকটার পিস্তলের নল আমাকেও খোঁচা দিচ্ছে!
–বা-রে, আমাকে কেন?—আমি ভাঙা গলায় বলতে চেষ্টা করলুম : আমি তো কম্বলরাম নই।
–না, তুমি কম্বলের দোস্ত কাঁথারাম! তোমাকে ছেড়ে দিই, তুমি দৌড়ে পুলিসে খবর দাও—আর ওরা গাড়ি ছুটিয়ে আমাদের ধরে ফেলুক! চালাকি চলবে না, চাঁদ—চলো!
এ-অবস্থায় হেমেন্দ্রকুমারের জয়ন্ত পর্যন্ত চলতে বাধ্য হয়, আমি কোন্ ছার! আমরা চললুম, ঘোড়ার গাড়িতে উঠলুম, গাড়ির দরজা বন্ধ হয়ে গেল, আর গাড়ি গড়গড়িয়ে চলতে
শুরু করে দিলে।
হায় গঙ্গার শীতল সমীর! বেশ বুঝতে পারলুম, এই আমাদের বারোটা বেজে গেল!
০২. গাড়িটা বাজে
গাড়িটা বাজে—একদম লক্কড়-মাকা। ছক্কর-ছক্কর করে যাচ্ছে তো যাচ্ছেই। কোন্ চুলোয় যে যাচ্ছে বোঝবার জো নেই। সেই জাঁদরেল অবলাকান্ত প্রায় আমাকে চেপ্টে বসে আছে—ওর নাম যদি অবলাকান্ত হয়, তবে বলেন্দ্রনাথের মানে, স্বয়ং সিন্ধুঘোটকের চেহারা যে কেমন হবে কে জানে! দরজা খোলবার জো নেই—এমন কি, কথাটি কইবার জো নেই। টেনিদা একবার বলতে চেষ্টা করেছিল, ও মশাই, খামকা ভুল লোককে হয়রান করে
ঢ্যাঙা লোকটা খ্যাঁ-খাঁ করে বললে, চোপ!
—যাকে তাকে কম্বলরাম ঠাউরে–
—যাকে তাকে? এমনি খাঁড়ার মতো নাক, এমনি চেহারা-কম্বলরাম ছাড়া আর, কারও হয়? কম্বলরামের কোনও যমজ ভাই নেই, তিনকুলে তার কেউ আছে বলেও আমরা শুনিনি। ইয়ার্কি?
-স্যার, দয়া করে যদি পটলডাঙায় একটা খবর নেন
-শাট আপ ইয়োর পটলডাঙা-আলুডাঙা! আর একটা কথা বলেছ কি, এই পিস্তলের এক গুলিতে–
কাজেই আমরা চুপ করে আছি। যা হওয়ার হয়ে যাক। শুধু থেকে থেকে আমার পেটের ভেতর থেকে কেমন গুড়গুড় করে একটা কান্না উঠে আসছিল। আর কখনও পটলডাঙায় ফিরে যেতে পারব না, আর কোনওদিন পটোল দিয়ে শিঙিমাছের ঝোল খেতে পাব না। টেনিদার সঙ্গে আড্ডা দিয়েই আমার এই সর্বনাশ হয়ে গেল। মেজদা ঠিকই বলে, ওই টেনিদার চ্যালা হয়েই প্যালা স্রেফ গোল্লায় গেল।
আমি তখন বিশ্বাস করিনি। ভাবলুম, যে যাই বলুক, টেনিদা একজন সত্যিকারের গ্রেটম্যান। দু-একটা চাঁটি-টাঁটি লাগায়, জোর করে খাওয়া-টাওয়াও আদায় করে, কিন্তু আসলে তার মেজাজটা ভীষণ ভালো, বিপদ-টিপদ হলে লিডারের মতো বুক ঠুকে সামনে এগিয়ে যায়। কিন্তু সে যে এত মারাত্মক কম্বলরাম হলেও হতে পারে, আর কোথাকার এক বিটকেল সিন্ধুঘোটক তাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে, এ জানলে কে তার ত্রিসীমানায় এগোত।
ওদিকে হঠাৎ অবলকান্ত খ্যাঁ-খাঁ করে হেসে উঠল। বললে, ঘেঁটুদা!
ঘেঁটুদা, ওরফে ঢ্যাঙা লোকটা বললে, কী বলছ হে অবলকান্ত?
—এটা যে কম্বলরাম, তাতে আর কোনও সন্দেহ নেই।
ঘেঁটুদা বললে, আলবাত!
অবলাকান্ত বললে, তা না হলে এমন ডোম্বলরাম হয়।