টেনিদার মুখখানা কুঁকড়ে-টুকড়ে কি রকম যেন হয়ে গেল। ঠিক একতাল হালুয়ার মতো হয়ে গেল বলা চলে।
—কিন্তু আমাকে তো কুকুরে কামড়ায়নি। আর, মাত্র একটু আঁচড়ে দিয়েছে তাতে এইবার আমি কায়দা পেয়ে বললুম, যা হবার ওতেই হবে—দেখে নিয়ে।
–কী হবে? টেনিদার হালুয়ার মতো মুখটা এবার ডিমের ডালনার মতো হয়ে গেল। ক্যাবলা খুব গম্ভীরভাবে মাথা নেড়ে বললে, কেন, প্রেমেন মিত্তিরের গল্প পড়োনি? হবে স্থলাতঙ্ক।
–অ্যাঁ।
—তারপর তুমি আর মাটিতে থাকতে পারবে না। বানরের মতো কিচমিচ আওয়াজ করবে–
আমি বললুম, এক লাফে গাছে উঠে পড়বে—
হাবুল সেন বললে, আর গাছের ডালে বইসা বইস্যা কচিকচি পাতা ছিড়া ছিড়া খাইবা।
টেনিদা হাউমাউ করে চেঁচিয়ে উঠল : আর বলিসনি—সত্যি আর বলিসনি। আমি বেজায় নাভার্স হয়ে যাচ্ছি। ঠিক কেঁদে ফেলব বলে দিলুম।
বোধহয় কেঁদেও ফেলতহঠাৎ কুট্টিমামা এসে গেলেন।
–কী হয়েছে রে? এত গণ্ডগোল কেন?
–মামা, আমার স্থলাতঙ্ক হবে—টেনিদা আর্তনাদ করে উঠল।
–স্থলাতঙ্ক! তার মানে?-কুট্টিমামার চোখ কপালে চড়ে গেল।
আমরা সমস্বরে ব্যাপারটা যে কী তা বোঝাতে আরম্ভ করলুম। শুনে কুট্টিমামা হেসেই অস্থির। বললেন, ভয় নেই, কিছু হবে না। একটু আইডিন লাগিয়ে দিলেই সব ঠিক হয়ে যাবে।
শুনে টেনিদার সে কী হাসি! বত্রিশটা দাঁতই বেরিয়ে গেল যেন।
—তা কি আর আমি জানি না মামা। এই প্যালারামকেই একটু ঘাবড়ে দিচ্ছিলুম কেবল। চালিয়াতিটা দেখলে একবার?
০৬. বড় বেড়ালের আবির্ভাব
রাতের খাওয়া-দাওয়া শেষ হয়ে গেলে আমরা বারান্দায় এসে বসলুম। আকাশ আলো করে চাঁদ উঠেছে। চায়ের বাগান, দূরের শালবন, আরও দূরের পাহাড় যেন দুধে স্নান করছে। ঝিরঝিরে মিষ্টি হওয়ায় জুড়িয়ে যাচ্ছে শরীর। খাওয়াটাও হয়েছে দারুণ। আমার ইচ্ছে করছিল গিয়ে বিছানায় গড়িয়ে পড়ি। কিন্তু কুট্টিমামা গল্পের থলি খুলে বসেছেন—সে-লোভও সামলানো শক্ত।
আমরা তিনজনে তিনটে চেয়ারে বসেছি। একখানা ছোট তক্তোপোশে আধশোয়া হয়ে আছেন কুট্টিমামা। সামনে গড়গড়া রয়েছে, গুড়গুড় করে টানছেন আর গল্প বলছেন।
সেই অনেক কাল আগের কথা। জঙ্গল, কেটে সবে চায়ের বাগান হয়েছে। বড় বড় পাইথন, বাঘ আর ভালুকের রাজত্ব। কালাজ্বর, আমাশা, ম্যালিগন্যান্ট ম্যালেরিয়া এসব লেগেই আছে। বাগানে কুলি রাখা শক্তদুদিন পরে কে কোথায় পালিয়ে যায় তার আর ঠিক-ঠিকানা থাকে না। কুলিদের আর কী দোষ-প্রাণের মায়া তো সকলেরই আছে।
তখন কুট্টিমামার বাবা এই বাগানে কাজ করতেন। পাকা রাস্তা ছিল না—যোলো মাইল দূরের রেল স্টেশন থেকে গোরুর গাড়ি করে আসতে হত। বাঘ-ভালুকের সঙ্গে দেখা হত হামেশা। কুট্টিমামা তখন খুব ছোট্ট কত জন্তু-জানোয়ার দেখেছেন কতবার।
তারই একদিনের গল্প।
সেবার কুট্টিমামা আর ওঁর বাবা নেমেছেন রেল থেকে বিকেলের গাড়িতে। সময়টা শীতকাল। একটু পরেই অন্ধকার নেমে এল। কাঁচা রাস্তা দিয়ে গোরুর গাড়ি দুলতে দুলতে এগিয়ে চলেছে। দুপাশে ঘন অন্ধকার শাল-শিমুলের বন। কুট্টিমামা চুপচাপ তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছেন, জঙ্গলের মধ্যে থোকা থোকা জোনাক জ্বলছে। অনেক দূরে পাহাড়ের গায়ে হাতির ডাক-হরিণ ডেকে উঠছে মধ্যে মধ্যে গাড়ির সামনে দিয়ে ছুটে ছুটে পালিয়ে যাচ্ছে খরগোেশ। ঝিঝির আওয়াজ উঠছে একটানাঘুমের ভেতর গাছের ডালে কুঁক কুঁক করছে বনমুরগি।
দেখতে দেখতে আর শুনতে শুনতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছেন কুট্টিমামা। টুকুটক করে গাড়ি এগিয়ে চলেছে। হঠাৎ তাঁর ঘুম ভেঙে গেল।
গাড়ি থেমে দাঁড়িয়েছে। শালবনের ভেতর দিয়ে সেদিনও অনেকখানি চাঁদের আলো পড়েছে বনের রাস্তায়। সেই চাঁদের আলোয় আর বনের ছায়ায়–
কুট্টিমামা যা দেখলেন তাতে তাঁর দাঁতকপাটি লেগে গেল।
গোরুর গাড়ি থেকে মাত্র হাত দশেক দূরে দাঁড়িয়ে এক বিকট মূর্তি। কুচকুচে কালো লোমে তার শরীর ভরা বুকে কলারের মতো একটা শাদা দাগ। হিংসায় তার চোখ দুটো আগুনের মতো জ্বলছে। মুখটা খোলা—দুসারি দাঁত যেন সারি সারি ছুরির ফলার মতো সাজানো। আলিঙ্গন করবার ভঙ্গিতে হাত দুখানা দুপাশে বাড়িয়ে অল্প টলতে টলতে এগিয়ে আসছে সে।
ভালুক!
ভালুক বলে কথা নয়। এদিকের জঙ্গলে ছোটখাটো ভালুক কিছু আছেই। কিন্তু মানুষ। দেখলে তারা প্রায়ই বিশেষ কিছু বলে না—মানে মানে নিজেরাই সরে যায়। কিন্তু এ তো তা নয়! অদ্ভুত বড়—অস্বাভাবিক রকমের বিরাট! আর কী তার চোখ কী দৃষ্টি সেই চোখে! সাক্ষাৎ নরখাদক দানবের চেহারা!
গোরু দুটোর গায়ের লোম খাড়া হয়ে উঠেছে। ছটফট করছে—একটা বিচিত্র আওয়াজ বেরুচ্ছে তাদের গলা দিয়ে।
কুট্টিমামার বাবাও দারুণ ভয় পেয়েছেন। সঙ্গে বন্দুক নেই। ফিসফিস করে বললেন, এখন কী হবে?
নেপালী গাড়োয়ান বীর বাহাদুর একটু চুপ করে থেকে বললে, কিছু ভাববেন না বাবু, আমি ব্যবস্থা করছি।
ফস করে গাড়ি থেকে লাফিয়ে নেমে পড়ল বীর বাহাদুর। ভালুক তখন পাঁচ-সাত হাতের মধ্যে এসে পড়েছে। কুট্টিমামা ভাবলেন, এইবার গেছে বীর বাহাদুর। ভালুক এখুনি দুহাতে ওকে বুকে জাপটে ধরবে। আর যা চেহারা ভালুকের। একটি চাপে সমস্ত হাড়-পাঁজরা একেবারে গুঁড়ো করে দেবে। ভালুকরা অমনি করেই মানুষ মারে কিনা!
কিন্তু নেপালীর বাচ্চা বীর বাহাদুর—এ-সব জিনিসের অন্ধিসন্ধি সে জানে। চট করে গাড়ির তলা থেকে একরাশ খড় বের করে আনল, তারপর দেশলাই ধরিয়ে দিতেই খড়গুলো মশালের মতো দাউদাউ করে জ্বলে উঠল।