—হচ্ছে মামা, আজকাল আকছার হচ্ছে। কলকাতায় আজকাল কী যে সব বিচ্ছিরি কাণ্ডকারখানা ঘটছে সে আর তোমায় কী বলব! এমনকি একটু বেশি করে জল খেয়েছ তো সঙ্গে সঙ্গেই জলাতঙ্ক।
শুনে কুট্টিমামা চোখ কপালে তুলে বসে রইলেন খানিকক্ষণ। বললেন, কী সর্বনাশ!
কথা বলে কিছু লাভ হবে না বুঝে হাবুল একদম চুপ। আমি গ্যাঁট হয়ে বসে টেনিদার চালিয়াতি শুনছি। কিন্তু ক্যাবলাটা আর থাকতে পারল না, ফস করে বলে ফেলল, গুল!
টেনিদা চোখ পাকিয়ে জিজ্ঞেস করলে, কী বললি?
ক্যাবলা দারুণ হুঁশিয়ার–সঙ্গে সঙ্গেই সামলে নিয়েছে। নইলে জিপ থেকে নেমেই নির্ঘাত টেনিদা ওকে পটাপট কয়েকটা চাঁটি বসিয়ে দিত চাঁদির ওপর। বললে, না-না, চারদিকে কী সুন্দর ফুল ফুটেছে!
আমি অবশ্যি কোথাও কোনও ফুল-টুল দেখতে পেলুম না। কিন্তু ক্যাবলা বেশ ম্যানেজ করে নিয়েছে।
কুট্টিমামা খুশি হয়ে বললেন, হুঁ, ফুল এদিকে খুব ফোটে। কাল জঙ্গলে যখন বেড়াতে নিয়ে যাব, তখন দেখবে ফুলের বাহার!
হাবুলটা এক নম্বরের বোকা, এর মধ্যেই আবার বলে ফেলেছে, মামা আপনার পোষা বাঘটা–
মামা ভীষণ চমকে গেলেন।
কী বললে! পোষা বাঘ! সে আবার কী? কিন্তু টেনিদা তক্ষুনি উল্টে দিয়েছে কথাটা। হাঁ হাঁ করে বললে, না-না মামা, বাঘ-টাঘ নয়। হাবুলের নাকেও বাত হয়েছে কিনা, তাই কথাগুলো ওইরকম শোনায়। ও বলছিল তোমার বোসা রাগটা মানে সেই ধুসো কম্বলটা যেটা তুমি দার্জিলিঙে কিনেছিলে সেটা আছে তো?
হাবুল একবার হাঁ করেই মুখ বন্ধ করে ফেললে। কুট্টিমামা আবার দারুণ অবাক হয়ে বললেন, তা সে কম্বলটার কথা এরা জানলে কী করে?
—হেঁ—হেঁ–টেনিদা খুব কায়দা করে বললে, তোমার সব গল্পই আমি এদের কাছে করি কিনা! এরা যে তোমাকে কী ভক্তি করে মামা, সে আর তোমায়–
কথাটা শেষ হল না। ঠিক তখুনি—
জিপের বাঁ দিকের জঙ্গলটা নড়ে উঠল। আর জিপের সামনে দিয়ে এক লাফে যে রাস্তার ওপারে গিয়ে পড়ল, তাকে দেখামাত্র চিনতে ভুল হয় না। তার হলদে রঙের মস্ত শরীরটার উপর কালো কালো ডোরা–ঠিক যেন রোদের আলোয় একটা সোনালি তীর ছুটে গেল সামনে দিয়ে।
আমি বললুম, বা—বা—বা—
ঘ-টা বেরুবার আগেই টেনিদা জাপটে ধরেছে ক্যাবলাকে–আবার ক্যাবলা পড়েছে। আমার ঘাড়ের ওপর। আর হাবুল আর্তনাদ করে উঠেছে : খাইছে—খাইছে!
০৪. বনের বিভীষিকা
বনের বাঘ অবিশ্যি বনেই গেল, হালুম করে আমাদের ঘাড়ে এসে পড়ল না। আর কুট্টিমামা হা হা করে হেসে উঠলেন।
-ওই একটুখানি বাঘ দেখেই ভিরমি খেলে, তোমরা যাবে জঙ্গলে শিকার করতে।
ততক্ষণে গাড়ি এক মাইল রাস্তা পার হয়ে এসেছে। জঙ্গল ফাঁকা হয়ে আসছে দুধারে। আমরাও নড়েচড়ে বসেছি ঠিক হয়ে।
টেনিদা বললে, না মামা, আমরা ভয় পাইনি। বাঘ দেখে ভারি ফুর্তি হয়েছিল কিনা, তাই বাঃ বাঃ বাঘ বলে আনন্দে চেঁচামেচি করছিলুম। শুধু প্যালাই যা ভয় পেয়েছিল। ও একটু ভিতু কিনা!
বাঃ–ভারি মজা তো। সবাই মিলে ভয় পেয়ে শেষে আমার ঘাড়ে চাপানো! আমি তাড়াতাড়ি বললুম, নানা, আমিও ভয় পাইনি। এই ক্যাবলাটাই একটুতে নার্ভাস হয়ে যায়, তাই ওকে ভরসা দিচ্ছিলুম!
ক্যাবলা নাক-মুখ কুঁচকে বললে, ব্যাস্-খামোশ!
শুনে আমার ভারি রাগ হয়ে গেল।
—খা মোষ। কেন—আমি মোষ খেতে যাব কী জন্যে? তোর ইচ্ছে হয় তুই মোষ খা—গণ্ডার খা—হাতি খা! পারিস তো হিপোপটেমাস ধরে ধরে খা!
কুট্টিমামা মিটমিট করে হাসলেন।
—ও তোমাকে মোষ খেতে বলেনি–বলেছে খামোশ—মানে,থামো। ওটা হচ্ছে। রাষ্ট্রভাষা।
বললুম, না ওসব আমার ভালো লাগে না! চারদিকে বাঘ-টাঘ রয়েছে—এখন খামখা রাষ্ট্রভাষা বলবার দরকার কী?
হাবুল সেন বিজ্ঞের মতো মাথা নাড়ল।
–বুঝছস নি প্যালা–বাঘেও রাষ্ট্রভাষা কয় : হাম–হাম। মানে কী? আমি–আমি-যে-সে পাত্তর না-সাইক্ষাৎ বাঘ। বিড়ালে ইন্দুররে ডাইক্যা কয় : মিঞা আও–আইসো ইন্দুর মিঞা, তোমারে ধইর্যা চাবাইয়া খামু। আর কুত্তায় কয় : ভাগ—ভাগ—ভাগ হো–পলা—পলা, নইলে ঘ্যাঁৎ কইর্যা তর ঠ্যাঙে একখানা জব্বর কামড় দিমু–হঃ!
টেনিদা বললে, বাপূরে, কী ভাষা। যেন বন্দুক ছুঁড়ছে।
হাবুল বুক চিতিয়ে বললে, বীর হইলেই বীরের মতো ভাষা কয়। বোঝলা!
জবাব দিলে কুট্টিমামা। বললেন, বোঝলাম। কে কেমন বীর, দু-একদিনের মধ্যেই পরীক্ষা হবে এখন। এসব আলোচনা এখন থাক। এই যে—এসে পড়েছি আমরা।
সত্যি, কী গ্র্যান্ড জায়গা!
তিনদিকে জঙ্গল—আর একদিকে চায়ের বাগান ঢেউ খেলে পাহাড়ের কোলে উঠে গেছে। তার উপরে কমলালেবুর বাগান—অসংখ্য নেবু ধরেছে, এখনও পাকেনি, হলদে-হলদে রঙের ছোপ লেগেছে কেবল। চা বাগানের পাশে ফ্যাক্টরি, তার পাশে সায়েবদের বাংলো। আর একদিকে বাঙালি কর্মচারীদের সব কোয়ার্টার কুট্টিমামার ছোট্ট সুন্দর বাড়িটি। অনেকটা দূরে কুলি লাইন। ভেঁপু বাজলেই দলে দলে কুলি মেয়ে ঝুড়ি নিয়ে চায়ের পাতা তুলতে আসে, কেউ-কেউ পিঠে আবার ছোট্ট বাচ্চাদেরও বেঁধে আনে—বেশ মজা লাগে দেখতে।
সায়েবরা কলকাতায় বেড়াতে গেছে–কুট্টিমামাই বাগানের ছোট ম্যানেজার। আমরা গিয়ে পৌঁছুবার পর কুট্টিমামাই বললেন, খেয়ে-দেয়ে একটু জিরিয়ে নাও, তারপর বাগান-টাগান দেখবখন।
টেনিদা বললে, সেই কথাই ভালো মামা। খাওয়া-দাওয়াটা আগে দরকার। সে-চিনি যে কখন বলতে বলতেই সামলে নিলে : মানে সেই যে কখন থেকে পেট চিন-চিন করছে।