আমরা তিনজনে একসঙ্গে আর্তনাদ করে উঠলুম, ওই কুট্টিমামা! হতেই পারে না! ঝাঁকড়া চুল তালগাছের মতো লম্বা কালিগোলা রং–সে কী করে অমন ছোটখাটো টাকমাথা গোলগাল মানুষ হয়ে যাবে। আর গায়ের রংও তো বেশ ফর্সা।
ক্যাবলা কী বলতে যাচ্ছিল, তার আগেই টেনিদা এগিয়ে গিয়ে ভদ্রলোককে একটা প্রণাম ঠুকে দিলে।
–মামা, আমরা সবাই এসে গেছি।
কী আর করা! কুট্টিমামার রহস্য পরে ভেদ করে যাবে আপাতত আমরাও একটা করে প্রণাম করলুম।
ভদ্রলোক খুশি হয়ে হেসে বললেন, বেশ বেশ, ভারি আনন্দ হল তোমাদের দেখে। তা পথে কোনও কষ্ট হয়নি তো?
ফস করে বলে ফেললুম, না মামা–বেশি কষ্ট হয়নি। মানে, চিনির বস্তাটা ছিল—
টেনিদার চোখের দিকে তাকিয়েই সামলে গেছি সঙ্গে সঙ্গে। মামা বললেন, চিনির বস্তা। সে আবার কী?
টেনিদা বললে, না মামা, ওসব কিছু না। চিনির বস্তাটা আমরা চিনি না। মানে, প্যালা খুব চিনি খেতে ভালোবাসে কিনা–তাই সারা রাস্তা স্বপ্ন দেখছিল।
কুট্টিমামা হেসে বললেন, তাই নাকি?
—হ্যাঁ মামা।—টেনিদা উৎসাহ পেয়ে বলতে আরম্ভ করলে, আমারও ওরকম হয়। তবে আমি আবার চপকাটলেটের স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসি। এই হাবুল সেন খালি রাবড়ি আর চমচমের স্বপ্ন দেখে। আর এই ক্যাবলা মানে এই বাচ্চা ছেলেটা পরীক্ষায় স্কলারশিপ পায় আর চুয়িং গামের স্বপ্ন দেখতে পছন্দ করে।
ক্যাবলা ভীষণভাবে প্রতিবাদ করে উঠল, কক্ষনো না। চুয়িং গামের স্বপ্ন দেখতে আমি মোটই ভালোবাসি না। আমিও চপকাটলেট রাবড়ি চমচম—এইসবের স্বপ্ন দেখি।
কুট্টিমামা আবার অল্প একটু হেসে বললেন, দেখা যাক, স্বপ্নকে সফল করা যায় কি না। এখন চলল। মালপত্র প্লেনে কিছু নেই তো? সব হাতে? ঠিক আছে।
–তোমাদের বাগান কতদূরে মামা?
—এই মাইল-ছয়েক। দশবারো মিনিটের মধ্যেই চলে যাব। এসো—
একটু পরেই আমরা জিপে উঠে পড়লুম। ড্রাইভারের পাশে বসে মামা বললেন, একটু তাড়াতাড়ি যেতে হবে দেওয়ান বাহাদুর। অনেক দূরে থেকে আসছে এরা এদের খিদে পেয়েছে।
টেনিদা বললে, তা যা বলেছ মামা। সকালে বলতে গেলে কিছুই খাইনি–পেট চুঁই-চুঁই করছে।
টেনিদা কিছু খায়নি! বাড়ি থেকে গলা পর্যন্ত ঠেসে বেরিয়েছে প্লেনে এসে কমসে কম একসের চিনি মেরে দিয়েছে। টেনিদা যদি কিছু না খেয়ে থাকে, আমি তো তিনদিন উপোস করে আছি!
জিপ ছুটল।
জঙ্গলের মধ্য দিয়ে কালো পিচের পথ পড়ে আছে মস্ত একটা ফিতের মতো। আমাদের জিপ চলেছে। ঠাণ্ডা-ঠাণ্ডা ছায়া ছড়িয়ে আছে পথের উপর–কেমন মিষ্টি গলায় নানারকমের পাখি ডাকছে।
টেনিদা বসেছে আমাদের পাশেই। ফাঁক পেয়ে আমি জিজ্ঞেস করলুম, তুমি যেরকম বলেছিলে, তোমার কুট্টিমামার চেহারা তো একদম সেরকম নয়! গুল দিয়েছিলে বুঝি? টেনিদা বললে, চুপ-চুপ! কুট্টিমামা শুনলে এখুনি একটা ভীষণ কাণ্ড হয়ে যাবে!
—ভীষণ কাণ্ড! কেন?
টেনিদা আমার কানে কানে বললে, সে এক লোমহর্ষক ব্যাপার–বুঝলি! বললে পেত্যয় যাবি না–নেপালী বাবার একটা ছু-মন্তরেই কুট্টিমামার চেহারা বিলকুল পালটে গেছে।
–ছু-মন্তর! সে আবার কী?
–পরে বলব, এখন ক্যাঁচম্যাচ করিসনি। কুট্টিমামা শুনলে দারুণ রাগ করবে। বলতে বারণ আছে কিনা!
আমি চুপ করে গেলুম। একটা যা-তা গল্প বানিয়ে দেবে এর পরে। কিন্তু টেনিদার কথায় আর বিশ্বাস করি আমি? আমি কি পাগল না পেন্টুলুন?
এর মধ্যে হাবুল সেন কুট্টিমামার পাশে বসে বকবকানি জুড়ে দিয়েছে : আইচ্ছা মামা, এই জঙ্গলটার নাম কী?
মামা বললেন, এর নাম দইপুর ফরেস্ট।
—এই জঙ্গলে বুঝি খুব দই পাওয়া যায়?
মামা বললে, দই তো জানি না—তবে বাঘ পাওয়া যায় বিস্তর।
এতক্ষণ পরে ক্যাবলা বললে, সেই বাঘের দুধেই দই হয়।
কুট্টিমামা হেসে বললেন, তা হতে পারে। কখনও খেয়ে দেখিনি।
শুনে দুচোখ কপালে তুলল হাবুল সেন : আরে মশয়, কন কী? আপনে বাঘের দই খান নাই? আপনার অসাধ্য কর্ম আছে নাকি? কালীসিঙ্গির মহাভারতের একখানা ঘাও দিয়া–বলেই হঠাৎ হাউমাউ করে চেঁচিয়ে উঠল হাবুল; গেছি–গেছি–খাইছে।
কুট্টিমামা অবাক হয়ে বললেন, কী হল তোমার? কিসে খেলে তোমাকে?
কিসে খেয়েছে সে আমি দেখেছি। টেনিদা কটাং করে একটা রাম-চিমটি বসিয়েছে। হাবুলের পিঠে।
—আমারে একখানা জব্বর চিমটি দিল। কুট্টিমামা পেছন ফিরে তাকালেন; কে চিমটি দিয়েছে?
টেনিদা চটপট বললে, না মামা, কেউ চিমটি দেয়নি। এই হাবুলটার মানে পিঠে বাত আছে কিনা, তাই যখন-তখন কড়াং করে চাগিয়ে ওঠে, আর অমনি ওর মনে হয় কেউ ওকে চিমটি কেটেছে।
হাবুল প্রতিবাদ করে বললে, কখনও না—কখনও না! আমার কোনও বাত নাই।
টেনিদা রেগে গিয়ে বললে, চুপ কর হাবলা, মুখে মুখে তক্কো করিসনি। বাত আছে। মামা-ও জানে না। ওর পিঠে বাত আছে-কানে বাত আছে, নাকে বাত আছে—
কুট্টিমামা বললেন, কী সাঙ্ঘাতিক! এইটুকু বয়সেই এসব ব্যারাম।
—তাই তো বলছি মামা টেনিদার মুখখানা করুণ হয়ে এল : এইজন্যেই তো ওকে নিয়ে আমাদের এত ভাবনা! কতবার ওকে বলেছি–হাবলা, অত বাতাবিনেবু খাসনি–খাসনি। বাতাবি খেলেই বাত হয়। এ তো জানা কথা। কিন্তু ভালো কথা কি ওর কানে যায়? তার ওপর বাতাসা দেখলে তো কথাই নেই–তক্ষুনি খেতে শুরু করে দেবে। এতেও যদি বাত না হয়—
হাবুল আবার হাউমাউ করে কী সব বলতে যাচ্ছিল, কুট্টিমামা তাকে থামিয়ে দিলেন। বললেন, বাতাবিলেবু আর বাতাসা খেলে বাত হয়? তা তো কখনও শুনিনি।