টেনিদা বিরক্ত হয়ে বললে, কী বলবি বল না! একেবারে শিবনের হয়ে বসে রইলি কেন?
—আমরা তো অনেক উপরে উইঠ্যা পড়ছি!
টেনিদা ভেংচে বললে, তা পড়ছি। তাতে হয়েছে কী?
–চাঁদের কাছাকাছি আসি নাই?
টেনিদা উঁচুদরের হাসি হাসল।
–হ্যাঁ, তা আর-একটু উঠলেই চাঁদে যাওয়া যেতে পারে।
—তা হইলে একটু কও না পাইলটেরে। চাঁদের থিক্যা একটু ঘুইর্যাই যাই। বেশ ব্যাড়ানোও হইব, রাশিয়ান স্পুটনিক আইস্যা পড়ছে কি না সেই খবরটাও নিতে পারুম।
ক্যাবলা বললে, হুঁ, চাঁদে সুধাও আছে শুনেছি। এক-এক ভাঁড় করে খেয়ে যাওয়া যাবে।
আমার শুনে কেমন খটকা লাগল। এত সহজেই কি চাঁদে যাওয়া যায়? কাগজে কী সব যেন পড়েছিলুম। চাঁদ, কী বলে–সেই যেন কত লক্ষ মাইল দূরে মানে, যেতে-টেতে অনেক দেরি হয় বলেই শুনেছিলুম। এমন চট করে কি সেখানে যাওয়া যাবে? আরও বিশেষ করে এই মালগাড়িতে চেপে?
কিন্তু টেনিদাকে সে কথা বলতে আমার ভরসা হল না। কুট্টিমামার দেশের প্লেন। সে-প্লেন সব পারে। আর পারুক বা নাই পারুক, মিথ্যে টেনিদাকে চটিয়ে আমার লাভ কী? এসে হয়তো টকাটক চাঁদির উপরে গোটাকয়েক গাঁট্টাই মেরে দেবে। আমি দুনিয়ার সব খেতে ভালবাসি–কলা, মুলো, পটোল দিয়ে শিঙিমাছের ঝোল, চপ কাটলেটকালিয়া কিছুতে আমার আপত্তি নেই। কিন্তু ওই চাঁটি-গাঁট্টাগুলো খেতে আমার ভালো লাগে
—একদম না। হাবুল আবার মিনতি করে বললে, অ টেনিদা, একবার পাইলটেরে রিকোয়েস্ট কইর্যা–চল না চাঁদের থিক্যা একটুখানি ব্যাড়াইয়া আসি।
হাবুল সেন ইয়ার্কি করছে নির্ঘাত! আমার দিকে তাকিয়ে একবার চোখ পিটপিট করলে। কিন্তু টেনিদা কিছু বুঝতে পারল না। বুঝলে হাবলার কপালে দুঃখ ছিল।
টেনিদা আবার উঁচুদরের হাসি হাসল–যাকে বাংলায় বলে, হাইক্লাস। তারপর বললে, আচ্ছা, নেস্ট টাইম। এখন একটু তাড়াতাড়ি যেতে হবে কিনা–মানে কুট্টিমামা আমাদের জন্যে এতক্ষণ হরিণের মাংসের ঝোল রেডি করে ফেলেছে। তা ছাড়া রাশিয়ান আর আমেরিকানরা যাওয়ার এত চেষ্টা করছে, ওদের মনে ব্যথা দিয়ে আগে চাঁদে যাওয়াটা উচিত হবে না। ভারি কষ্ট পাবে। আমার মনটা বড় কোমল রে–কাউকে দুঃখ দিতে ইচ্ছে করে না। আমরা সবাই বললুম, সে তো বটেই!
টেনিদা বললে, যাক চাঁদে পরে গেলেই হবে এখন। ও আর কী–গেলেই হয়। কিন্তু কথা হচ্ছে, কুট্টিমামার হরিণের ঝোল মনে পড়তে ভারি খিদে পেয়ে গেল রে। কী খাওয়া যায় বল দিকি?
-এই তো খেয়ে এলে–আমি বললুম, এক্ষুনি খিদে পেল?
টেনিদা বললে, পেল। যাই বল বাপু, আমার খিদে একটু বেশি। বামুনের পেট তো প্রত্যেক দশ মিনিটেই একেবারে ব্রহ্মতেজে দাউদাউ করে ওঠে। কিন্তু কী খাই বল তো?
হাবুল বললে, ওই তো একটা বস্তা ফুটা হইয়া কী জ্যান পড়তে আছে! লবণ মনে হইত্যাছে। খাইবা?
আমরা একসঙ্গে তাকিয়ে দেখলুম। তাই বটে। একটা ছোট বস্তায় ছোট একটা ফুটো হয়েছে। সেখান থেকে শাদা গুঁড়ো-গুঁড়ো কী সব পড়ছে। লবণ? কিন্তু কিন্তু কেমন সন্দেহজনক!
একলাফে দাঁড়িয়ে পড়ল টেনিদা। বললে, দেখি কী রকম লবণ!
বলেই বস্তা থেকে খানিকটা আঙুলের ডগায় তুলে নিলে। তারপর চেঁচিয়ে বললে, ডি-ল্যা-এ্যাণ্ডি! ইউরেকা! আমরা বললুম, মানে?
–বস্তার রহস্যভেদ। মানে?
–বস্তার চৈনিক রহস্য। —চৈনিক রহস্য!
সে আবার কী?–আমি জানতে চাইলুম। টেনিদা বললে, চিনি—চিনি—পিয়োর চিনি। যে-চিনি দিয়ে সন্দেশ তৈরি হয়, যে-চিনির রহস্যভরা রসের ভিতরে রসগোল্লা সাঁতার কাটে! যে-চিনি–
আর বলতে হল না। চিনিকে আমরা সবাই চিনি–কে না চেনে?
পড়ে রইল চাঁদ, নদী-গিরি কান্তারের শোভা। আমরা সবাই চিনির বস্তার ফুটোটাকে বাড়িয়ে ফেললুম।
তারপর—
তারপর বলাই বাহুল্য।
০৩. অতঃপর কুট্টিমামা
প্লেন এসে মাটিতে নামল।
ভালোই হল। চৈনিক রহস্য ভেদ করে এখন গলা একেবারে আঠা-আঠা হয়ে আছে—জিভটা যেন কাঁচাগোল্লা হয়ে আছে। জিভে কাঁচাগোল্লা চেপে বসলে ভালোই লাগে কিন্তু জিভটাই কাঁচাগোল্লা হয়ে গেলে কেমন বিচ্ছিরি-বিচ্ছিরি মনে হতে থাকে। এর মধ্যে আবার থেকে-থেকে কেমন গা গুলিয়ে উঠছিল। শেষকালে ক্যাবলার গায়েই খানিকটা বমি করে ফেলব কি না ভাবতে ভাবতেই দেখি, প্লেনটা সোজা থেমে গেল, আর বাইরে থেকে কারা টেনে দরজাটা খুলে দিলে।
দেখি, দুজন কুলি একটা ছোট লোহার সিঁড়ি লাগিয়ে দিয়েছে। নীচে পাঁচ-সাত জন লোক দাঁড়িয়ে।
চিনির বস্তার রাহাজানি ধরা পড়বার আগেই সরে পড়া দরকার। টুপ টুপ করে নেমে পড়লুম আমরা।
বা–রে—কোথায় এলুম? সামনে একটা টিনের ঘর, একটুখানি মাঠ–তার ভেতরে প্লেনখানা এসে নেমেছে। মাঠের তিন দিক ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে ঘন জঙ্গল–আর একদিকে মেঘের মতো মাথা তুলে আছে নীল পাহাড়। হাওয়ায় বড় বড় ঘাস দুলছে আশেপাশে।
হাবুল বললে, তাইলে আইস্যা পড়লাম।
কিন্তু কুট্টিমামা? কোথায় কুট্টিমামা! যেকজন তোক দাঁড়িয়ে আছে তার মধ্যে তো কুট্টিমামা নেই? সেই লম্বা তালগাছের মতো চেহারা, মিশমিশে কালো রং—মাথায় খেজুরপাতার মতো ঝাঁকড়া চুল–মানে টেনিদা আমাদের কাছে যেরকম বর্ণনা দিয়েছে আগে সেরকম কাউকে তো দেখতে পাচ্ছি না?
বললুম, ও টেনিদা, কুট্টিমামা কোথায়?
টেনিদা বললে, ঘাবড়াসনি–ওই তো আসছে মামা।
চালাঘরটার পাশে একখানা জিপ গাড়ি এসে থেমেছে এক্ষুনি। তা থেকে নেমেছে বেঁটে-খাটো গোলগাল একটি ভালোমানুষ লোক। গায়ে নীল শার্ট, পরনে পেটুলুন। টেনিদা দেখিয়ে বললে, ওই তো কুট্টিমামা।