শুধু দুদিকে চারটে সিট কোনওমতে রাখা আছে আমাদের জন্যে। তাতে গদিটদি কিছু ছিল, কিন্তু এখন সব ছিড়েখুঁড়ে একাকার।
হাবুল সেন বললে, অ টেনিদা! মালগাড়িতে চাপাইলা নাকি?
টেনিদা দাঁত খিঁচিয়ে বললে, যা—যা-মেলা বকিসনি! কুড়ি টাকা দিয়ে প্লেন চাপবিকত আরাম পেতে চাস–শুনি? তবু তো ভাগ্যি যে প্লেনের চাকার সঙ্গে তোদের বেঁধে দেয়নি।
বলতে বলতে জন-তিনেক কোট-প্যান্ট-পরা লোক তড়াক করে প্লেনে উঠে পড়ল। তারপর সার্কাসের খেলোয়াড়ের মতো অদ্ভুত কায়দায় টকটক করে সেই বাক্সবস্তার ভূপ পেরিয়ে—একজন আবার কোগুলোতে একটা হোঁচট খেয়ে ওপাশের প্রবেশ নিষেধ লেখা একটা কাচের দরজার ওপারে চলে গেল।
টেনিদা বললে, ওরা পাইলট। এখুনি ছাড়বে।
ক্যাবলা বললে, ইস, পাইলট হওয়া কী কষ্ট! বাক্স আর বস্তার উপর দিয়ে লাফাতে হয় কেবল।
যাত্রী আমরা মাত্র চারজন। দুদিকের সিটগুলোতে চেপে বসতে-বসতে হঠাৎ ঘুরুর ঘুরুর করে আওয়াজ আরম্ভ হল। তারপরেই গুড়গুড়িয়ে চলতে আরম্ভ করল প্লেনটা।
আমরা তাহলে সত্যিই এবার আকাশে উড়ছি। কী মজা। এবার মেঘের উপর দিয়েনদী গিরি কান্তার মানে আরও কী সব যেন বলে—অটবী-টটবী পার হয়ে দূর-দূরান্তে চলে যাব। আমার পিসতুতো ভাই ফুচুদা এখন থাকলে নিশ্চয় কবিতা লিখত :
পাখি হয়ে যাই গগনে উড়িয়া,
ফড়িং টড়িং খাই ধরিয়া—
কিন্তু ফড়িং খাওয়ার কথা কি লিখত? আমার একটু খটকা লাগল। কবিরা কি ফড়িং খায়? বলা যায় না–যারা কবি হয় তাদের অসাধ্য আর অখাদ্য কিছুই নেই।
এইসব দারুণ চিন্তা করছি, আর প্লেনটা সমানে গুড়গুড় করে চলেছে। আমি ভাবছিলুম এতক্ষণে বুঝি মেঘের উপর দিয়ে কান্তার মরু দুস্তর পারাবার এইসব পাড়ি দিচ্ছি। দুৎ–কোথায় কী! খালি ডাঙা দিয়ে চলছে তো চলছেই!
টেনিদার পাশ থেকে হাবুল বললে, কই টেনিদা—উড়তে আছে না তো?
ক্যাবলা একটা এলাচ বের করে চিবুচ্ছিল। আমি খপ করে নিতে গেলুম পেলুম খোসাটা। রাগ করে বললুম, উড়বে না ছাই। মালগাড়ি কোনওদিন ওড়ে নাকি?
ক্যাবলা বললে যাচ্ছে তো গড়গড়িয়ে। কাল হোক, পরশু হোক,—ঠিক পৌঁছে যাবে।
হাবুল করুণ গলায় বললে, কয় কী–অ টেনিদা! এইটা উড়ব না? সঙ্গে সঙ্গে প্লেন দাঁড়িয়ে পড়ল। আর বেজায় জোরে ঘর ঘর করে আওয়াজ হতে লাগল।
আমি বললুম, যাঃ, থেমে গেল!
ক্যাবলা মাথা নেড়ে বললে, হুঁ–স্টেশনে থামল বোধহয়। ইঞ্জিনে জল-টল নেবে।
টেনিদা ভীষণ রেগে গেল এবার।
-টেক কেয়ার ক্যাবলা–আমার কুট্টিমামার দেশের প্লেন! খবরদার—অপমান করবিনি বলে দিচ্ছি।
–তবে ওড়ে না কেন! খালি আওয়াজ করে–মাথা ধরিয়ে দিচ্ছে!
বলতে বলতেই আবার ঘর ঘর করে ছুটতে আরম্ভ করল প্লেন। তারপরেই–ব্যাস, টু করে যেন ছোট্ট একটু লাফ দিলে, আর সব আমাদের পায়ের তলায় নেমে যাচ্ছে।
আমরা উড়েছি! সত্যিই উড়েছি।
টেনিদা আনন্দে চেঁচিয়ে উঠে বললে, তবে যে বলছিলি উড়বে না? কেমন–দেখলি তো এখন? ডি-লা-এ্যাণ্ডি মেফিস্টোফিলিস—
আমরা সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার করে বললুম, ইয়াক-ইয়াক!
প্লেন উড়েছে। দেখতে দেখতে বাড়িঘরগুলো খেলনার মতো ছোট্ট-ছোট্ট হয়ে গেল, গাছগুলোকে দেখাতে লাগল ঝোপের মতো, রাস্তাগুলো চুলের সিঁথির মতো সরু হয়ে গেল আর রুপোর সাপের মতো আঁকাবাঁকা নদীগুলো আমাদের অনেক নীচে লুকিয়ে রইল।
মেজদার কাছে আগেই শুনেছিলুম, প্লেনে চেপে সিনারি দেখতে হলে জানলার পাশে যেতে হয়। আমিও কায়দা করে আগেই বসে পড়েছি। ক্যাবলা মিনতি করে বললে, তুই আমার জায়গায় আয় না প্যালা–আমিও ভাল করে একটুখানি দেখে নিই! আমি বললুম, এখন কেন? এলাচের খোসা দেবার সময় মনে ছিল না?
—তোকে চকলেট দেব।
—দে।
ঘাড় চুলকে ক্যাবলা বললে, এখন তো সঙ্গে নেই, কলকাতায় ফিরে গিয়ে দেব।
—তবে কলকাতায় ফিরেই সিনারি দেখিস। —আমি তক্ষুনি জবাব দিলুম।
ক্যাবলা ব্যাজার হয়ে বললে, না দিলি দেখতে–বয়ে গেল! কীই বা আছে দেখবার! ভারি তো বাঁশবন আর পচা ডোবা–-ও তো পাড়াগাঁয়ে গিয়ে তালগাছের উপরে চাপলেই দেখা যায়।
–দ্রাক্ষাফল অতিশয় টক–শেয়াল বলেছিল।–আমি ক্যাবলাকে উপদেশ দিলুম; তবে যা-তালগাছের মাথাতেই চাপ গে।
ওদিকে টেনিদা আর হাবুলের মধ্যে দারুণ তর্ক চলছে।
হাবুল বললে, আমার মনে হয়, আমরা বিশ হাজার ফুট উপর দিয়া যাইত্যাছি।
টেনিদা নাকটাকে কুঁচকে বললে, ফুঃ! আমার কুট্টিমামার দেশের প্লেন অত তলা দিয়ে যায় না। আমরা কম-সে কম পঞ্চাশ হাজার ফুট উপর দিয়ে যাচ্ছি।
ক্যাবলা মিটমিট করে হাসল। তারপর বললে, কেইসা বাত বোস্তা তুমলোক। এসব ডাকোটা প্লেন, যেগুলো মাল টানে, কখনও ছ-সাত হাজার ফুটের উপর দিয়ে যায় না।
—এই ক্যাবলাটার সব সময় পণ্ডিতি করা চাই। টেনিদা মুখখানা হালুয়ার মতো করে বললে, থাম, ওস্তাদি করিসনি! এসব কুট্টিমামার দেশের প্লেন–পঞ্চাশষাট হাজারের নীচে কথাই কয় না।
ক্যাবলা বললে, আমি জানি।
টেনিদার হালুয়ার মতো মুখটা এবার আলু-চচ্চড়ির মতো হয়ে গেল : তুই জানিস? তবে আমিও জানি। এক্ষুনি তোর নাকে এমন একটা মুগ্ধবোধ বসিয়ে দেব যে—
ক্যাবলা তাড়াতাড়ি বললে, না-না, আমারই ভুল হয়ে গিয়েছিল। এই প্লেনটা বোধহয় এখন একলাখ ফুট উপর দিয়ে যাচ্ছে।
–এক লাখ ফুট! —আমি হাঁ করে রইলুম। সেই ফাঁকে ক্যাবলা আমার মুখের ভেতরে আবার একটা এলাচের খোসা ফেলে দিলে।
হাবুল বললে, খাইছে! এক লাখ ফুট! অ টেনিদা–!