ইস–কতদিন যে আমি আলুর দম খাইনি। আর লুচি যে কী রকম সে তো বলতে গেলেই ভুলেই গেছি। লুচি কী দিয়ে বানায়–সুজি না পোস্ত দিয়ে? লুচি কি হাতখানেক করে লম্বা হয়?
আর থাকতে না পেরে আমি ক্যাবলাকে একটা খোঁচা দিলুম।
ক্যাবলা মুখটাকে ঠিক চামচিকের মতো করে বসে ছিল। আমার খোঁচা খেয়ে খ্যাঁচখেচিয়ে উঠল।
–ক্য হুয়া? জ্বালাচ্ছিস কেন?
আমি চুপি চুপি বললুম, আঃ চাঁচাসনি। কুট্টিমামা শুনতে পাবে। বলছিলুম, বড্ড খিদে পেয়েছে। সেই যে টিফিন ক্যারিয়ারটা সঙ্গে এসেছিল, সেটা কোথায় বল দিকি?
ক্যাবলা হঠাৎ ভীষণ গম্ভীর হয়ে গেল।
–ছিঃ প্যালা, তোর লজ্জা হওয়া উচিত। টেনিদার এখনও দেখা নেই—কোথায় হাতির পিঠে চেপে সে চলে গেল, আর তুই এখন খেতে চাইছিস?
আমি তাড়াতাড়ি বললুম, না-না-না—এমনিতে জানতে চাইছিলুম।
কী করা যায়–চুপ করে বসে থাকতে হল। সত্যি কথা–লিডার টেনিদার জন্যে আমারও বুকের ভেতর তখন থেকে আঁকুর-পাঁকুর করছে। কিন্তু খিদেটাও যে আর সইতে পারছি না। টেনিদা বেঁচে আছে কি না জানি না, কিন্তু আমিও যে আর বেশিক্ষণ বেঁচে থাকব, সে কথা আমার মনে হচ্ছে না।
কী আর করি—চুপ করে বসে আছি। গাড়িটা বনের ভেতর দিয়ে এগোচ্ছে। অন্ধকার দুধারে বেশ ঘন হয়ে এসেছে নানা রকম পাখি ডাকছে। ঝিঝিরা ঝিঁ ঝিঁ করছে।
হঠাৎ হাবুল চেঁচিয়ে উঠল, বাঘ বাঘ—
আবার বাঘ! এ কী বাঘা কাণ্ডে পড়া গেল রে বাবা!
কুট্টিমামা বললেন, কোথায় বাঘ?
আমি ততক্ষণে দেখেছি। বললুম, ওই যে দুরে দেখা যাচ্ছে। মোটরের আলোয় দুটো লাল চোখ জ্বলজ্বল করে জ্বলছে ওখানে।
কুট্টিমামা হেসে বললেন, বাঘ নয়, ও খরগোশ।
–খরগোশ! অতবড় চোখ! অমন জ্বলে?
–জানোয়ারদের চোখ অমনিই হয়। আলো পড়লে ওইভাবেই জ্বলে। দ্যাখো—দ্যাখো–
গাড়িটা তখন কাছে এসে পড়েছে। দেখি, সত্যিই তো একটা খরগোশ! একেবারে গাড়ির সামনে দিয়ে লাফিয়ে পাশের ঝোপের মধ্যে অদৃশ্য হল।
ক্যাবলা বললে, খরগোশের চোখই এই! বাঘের চোখ হলে–
—আগুনের মতো দপদপ করত। শিকারে স্পটিংয়ের সময় চোখ দেখেই জানোয়ার ঠাহর করা যায়।
—স্পটিং কাকে বলে?
—একটা সার্চলাইটের মতো আলো। স্পটলাইট বলে তাকে। রাত্রে বনের মধ্যে সেইটে ফেলে শিকার খুঁজতে হয়। জানোয়ারের চোখে পড়লে থমকে দাঁড়িয়ে যায়–ধাঁধা লেগে যায় ওদের। তখন গুলি করে মারে।
কথাটা শুনে আমার ভালো লাগল না। এ অন্যায়। মারতে চাও তো মুখোমুখি দাঁড়িয়ে মারো। চোখে আলো ফেলে, ধাঁধিয়ে দিয়ে গুলি করে মারা কাপুরুষের লক্ষণ। আমি পটলডাঙার প্যালারাম জীবনে আমি হয়তো কখনও শিকারি হতে পারব না, কিন্তু যদি হই, এমন অন্যায় আমি কিছুতে করব না।
ঘ্যাস-স্—
গাড়িটা থেমে গেল। আরে–এ কোথায় এসেছি।
বনের বাইরে কয়েকটা তাঁবু। পেট্রোম্যাক্স জ্বলছে। একদিকে তিন-চারটে হাতি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কলাগাছ খাচ্ছে। আর তাঁবুর সামনে–
একটা টেবিলে জনতিনেক লোক বসে বসে তরিবত করে খাচ্ছে। তাদের একজন—
আমরা সমস্বরে চেঁচিয়ে উঠলুম : টেনিদা!!!
টেনিদা গম্ভীর গলায় বললে, কী, এসে গেছিস সব? এখন বিরক্ত করিসনি, আমি কাটলেট খাচ্ছি।
আর টেবিল থেকে এক ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে উঠে কুট্টিমামাকে বললেন, এই যে গজগোবিন্দবাবু, আসুন–আসুন। আপনার ভাগ্নে আমাদের হাতির পিঠে সোয়ার হয়ে এসে উপস্থিত–ভয়ে হাফ ডেড! আমরা অনেকটা চাঙ্গা করে তুলেছি এতক্ষণে। আসুন আসুন—চা খান—
আমরা গাড়ি থেকে লাফিয়ে নেমে পড়লুম। আর তাই দেখে টেনিদা গোগ্রাসে কাটলেটটা মুখে পুরে দিলে।
সেই ভদ্রলোক বললেন, এসো—এসো। তোমরা আসবে আন্দাজ করেছিলুম, তোমাদের জন্যেও কাটলেট ভাজা হচ্ছে।
ব্যাপারটা বুঝেছ তো এতক্ষণে? না, না–ওরা বুনো হাতি নয়, ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের পোষা হাতি। মাসখানেক হল ওঁরা কী কাজে এখানে ক্যাম্প করেছেন। ওঁদেরই হাতি চরতে চরতে এদিকে এসেছিল, আর টেনিদা তারই একটার পিঠে চড়াও হয়ে–
কী কাণ্ড। কী কাণ্ড!
কাটলেট ভাজা হচ্ছে হোক–কিন্তু আমার যে প্রাণ যায়! ক্যাবলাকে বললুম, ক্যাবলা, সেই টিফিন ক্যারিয়ারটা–
ক্যাবলা বললে, দি আইডিয়া। তারপর এক হ্যাঁচকা টানে কোত্থেকে সেটাকে টেনে নামাল।
তারপর?
তারও পর? উহু, আর নয়। অনেকখানি গল্প আমি তোমাদের শুনিয়েছি, এর পরেরটুকু যদি নিজেরা ভেবে নিতে না পারে, তাহলে মিথ্যেই তোমরা চারমূর্তির অভিযান পড়েছ।