ক্যাবলা বললে, এই খবদার, কামড়াসনি। আমার জলাতঙ্ক হবে।
–জলাতঙ্ক হবে মানে? আমি কি খ্যাপা কুকুর নাকি?
হাবুল বললে,–কইব কেডা?
আমি হাবুলকে চড় মাতে যাচ্ছিলুম, ক্যাবলা বাধা দিলে। বললে, বন্ধুগণ, এখন আত্মকলহের সময় নয়। মনে রেখো, আমাদের লিডার টেনিদা হাতির পিঠে চড়ে উধাও হয়েছে। তাকে এখনও খুঁজে পাওয়া যায়নি।
—সে কি আর আছে? হাতিতে তারে মাইর্যা ফ্যালাইছে! বলেই হাবলা হঠাৎ কেঁদে ফেলল; ওরে টেনিদা রে—তুমি মইরা গেলা নাকি রে?
শুনেই আমারও বুকের ভেতর গুরগুর করে উঠল। আমিও আর কান্না চাপতে পারলুম না।
–টেনিদা, ও টেনিদা–তুমি কোথায় গেলে গো—
এমন যে শক্ত, বেপরোয়া ক্যাবলা–তারও নাক দিয়ে ফোঁসফোঁস করে গোটাকয়েক আওয়াজ বেরুল। তারপর আরশোলার মতো খুব করুণ মুখ করে সেও ড়ুকরে কেঁদে উঠতে যাচ্ছে, এমন সময় পেছন থেকে কে যেন বললে, আরে—আরে–এই তো তিনজন বসে আছে!
চমকে তাকিয়ে দেখি, কুট্টিমামা, শিকারি আর বাহাদুর।
আমরা আর থাকতে পারলাম না। তিনজনে একসঙ্গে হাহাকার করে উঠলুম : কুট্টিমামা গো, টেনিদা আর নেই।
কুট্টিমামার মুখ একেবারে ফ্যাকাশে হয়ে গেল।
–সে কি! কী হয়েছে তার?
হাবুল তারস্বরে ড়ুকরে উঠে বলল, তারে বুনা হাতিতে নিয়া গেছে কুট্টিমামা তারে নিয়া গিয়া অ্যাঁক্কেবারে মাইর্যা ফ্যালাইছে!
কুট্টিমামার হাত থেকে বন্দুকটা ধপাৎ করে মাটিতে পড়ে গেল।
১৭. হাতি থেকে কাটলেট
একটু সামলে-টামলে নিয়ে কুট্টিমামা বললেন, বুনো হাতিতে নিয়ে গেল।
আমরা সবাই কোরাসে গলা তুলে বললুম, হুঁ!
তাই শুনে কুট্টিমামা মাথার চাঁদির ওপর টাকটাকে কিছুক্ষণ কুরকুর করে চুলকোলেন। শেষে অনেক ভেবে-চিন্তে বললেন, মানে, তা কী করে হয়? হাতিতে নেবে কেমন করে?
হাবুল বললে, হ, নিয়া গেল। হাতি আসতাছে দেইখ্যা আমরা গাছে উঠছিলাম। টেনিদা না–ডাল ভাইঙা একটা হাতির পিঠে গিয়া পড়ল। আর হাতিটাও গাছের পাতা চাবাইতে চাবাইতে তারে কোনখানে য্যান নিয়া গেল।
—তারপর?
ক্যবলা বললে, আমরা তিনজনে তাকে খুঁজতে বেরুলুম। আমি একটা বন্দুকের আওয়াজ পেলুম। তারপর দেখি একটা বাঘ ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়ে আসছে। আমি একেবারে এক লাফে গিয়ে মোটরে!
শিকারি বললে, হুঁ, সেই বাঘটা–যেটাকে আমরা গুলি করেছিলুম। পায়েও চোট লেগেছিল।
কুট্টিমামা বললেন, তারপর?
হাবুল বললে, মনের দুঃখে এক বৃক্ষতলে শয়ন কইর্যা আমি ঘুমাইয়া পড়লাম। আমার ভাবনা কী-কুষ্ঠীতে লেখা আছে ব্যাঘ্ৰে নি আমারে কক্ষনো ভক্ষণ করব না। উইঠ্যা দেখি প্যালা সারা গায়ে কাদা মাইখ্যা ভূত সাইজ্যা একটা মস্ত কোলা ব্যাঙ ধইর্যা খাইতাছে।
কুট্টিমামা বললেন, কী সর্বনাশ! কোলা ব্যাঙ ধরে খাচ্ছে।
হাবুল সেনটা কী মিথ্যুক দেখেছ। আমি ভয়ঙ্কর আপত্তি করে বললুম, না মামা—আমি কোলা ব্যাঙ ধরে খাইনি। ওই হাবলাই তো পাখির ডাক শুনে দৌড়ে পালাল। আমি একটা গর্তের ভেতর পড়েছিলুম আর বাঘটা গিয়ে সেই গর্তেই একটা শজারুর ঘাড়ে গিয়ে পড়ল।
মামা বললেন, অ্যাঁ! তবে কুলিরা যে গর্ত কেটেছে, বাঘটা তাতেই পড়েছে নাকি? কিন্তু প্যালারাম—তুমি উঠে এলে কী করে?
—স্রেফ ইচ্ছাশক্তির জোরে, কুট্টিমামা! নইলে বাঘটা যেভাবে দাপাদাপি করছিল, তাতে ওর ল্যাজের চোট খেয়েই আমার প্রাণটা বেরিয়ে যেত–থাবার ঘা খাওয়ার দরকার হত না।
কিছুক্ষণ কুট্টিমামা আমার মুখের দিকে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকলেন। তারপর আবার কুরকুরিয়ে টাকটাকে চুলকে নিয়ে বললেন, বাঘটা তা হলে সেই গর্তের মধ্যেই আছে বলছ?
–নির্ঘাত!
–যাক, বাঘের জন্যে তবে ভাবনা নেই। কাল তুলব বাছাধনকে। কিন্তু টেনি—
বলতেই আবার হাউ-মাউ করে কেঁদে উঠল হাবুল : তারে হাতিতেই মাইরা ফেলছে কুট্টিমামা—এতক্ষণে হালুয়া বানাইয়া রাখছে!
শুনে আমিও ফোঁসফোঁস করে কাঁদতে লাগলুম, আর ক্যাবলা নাক-টাক কুঁচকে কেমন একটা কুঁ–কুঁ আওয়াজ করতে লাগল।
শিকারি মামার কানে কানে কী বললে। মামা গম্ভীর হয়ে বললেন, আমারও তাই সন্দেহ হচ্ছে। নইলে এখানে বুনো হাতি কেমন করে আসবে! তা ছাড়া হাতি তো বটেই। যদি ভয়-টয় পেয়ে—
শিকারি মাথা নেড়ে বললে, তা ঠিক।
তখন কুট্টিমামা আমাদের দিকে তাকালেন। ডেকে বললেন, শোনো, এখন আর কান্নাকাটি করে লাভ নেই। চলো সব গাড়িতে। তোমাদের লিডারকে খুঁজতে যেতে হবে।
হাবুল ফোঁপাতে ফোঁপাতে বললে, তারে কি আর পাওন যাইব?
কুট্টিমামা বললেন, একটা জায়গা আগে দেখে আসি। সেখানে যদি হদিস না পাই, তাহলে বনের মধ্যে খোঁজাখুঁজি করতে হবে। চলো এখন গাড়িতে কুইক!
গাড়িটা দূরে ছিল না। আমরা উঠে বসতে না বসতেই ড্রাইভার স্টার্ট দিলে। মামা তাকে কী একটা জায়গায় যেতে বলে দিলেন, ঠিক বুঝতে পারলুম না।
বনের ভেতর তখন অল্প-অল্প করে সন্ধ্যা নামছে। হেডলাইটের আলো জ্বেলে গাড়ি ছুটল।
হাবুল ফিসফিস করে আমাকে জিজ্ঞেস করলে, এই প্যালা, আমরা কোথায় যাইতাছি ক দেখি?
বিরক্ত হয়ে বললুম, কুট্টিমামাকে জিজ্ঞেস কর, আমাকে কেন?
–না, খুব ক্ষুধা পাইছে কিনা! গাড়িতে টিফিন ক্যারিয়ার-ভর্তি খাবার তো উঠেছিল! সেইগুলি গেল কোথায়?
ঠিক আমার মনের কথা বলে দিয়েছে! এতক্ষণ ভুলে গিয়েছিলুম, এইবার টের পেলুম, পেটের ভেতর তিরিশটা ছুঁচো যেন একসঙ্গে হা-ড়ু-ড়ু খেলছে। টিফিন ক্যারিয়ারটা পেলে সত্যি খুব কাজ হত। ওতে লুচি, আলুর দম, ডিমসেদ্ধ এইসব ছিল।