একটা গাছের তলায় কালো কালো কটা কী যেন পড়ে রয়েছে। একটা তুলে কামড় দিয়ে–দেখি–বাপরে! ইটের চাইতেও শক্ত–দাঁত বসবে না। একটু দুরেই লাল টুকটুকে গোটা-দুই ফল লতা থেকে ঝুলছিল—দৌড়ে গিয়ে একটা ছিড়ে নিলুম। কামড় দিতেই–আরে রামো-রামো! কী বিচ্ছিরি ভেতরটাতে, আর কী দারুণ বদ গন্ধ! থুথু করে ফেলে দিতে পথ পাই না। তখন মনে পড়ল–আরে, এ তো মাকাল! এ তো আমি দেখেছি আগেই! ছ্যা! ছ্যা!
মুনি-ঋষিদের নিকুচি করেছে! বনে ফল থাকে, না ঘোড়ার ডিম থাকে। এখন বুঝতে পাচ্ছি সব গুলপট্টি! আমাকে লাখ টাকা দিলেও আমি কখনও সাধুসন্নিসি হব না–প্রাণ গেলেও না।
কিন্তু খাই কী।
–ক্র্যাং!
পেছনে কেমন একটা বিটকেল আওয়াজ। আমি তড়াক করে লাফিয়ে উঠলুম।
আবার সেই শব্দ : ক্র্যাং! ক্র্যাং!
এ আবার কী রে বাবা! কোথাও কিছু দেখছি না অথচ থেকে থেকে অমন যাচ্ছেতাই আওয়াজ করছে কে!
ক্র্যাং—কর-র-র–
একটা দৌড় মারব কি না ভাবছি—এমন সময় হুঁ হুঁ! ঠিক আবিষ্কার করেছি। আমার সঙ্গে ইয়ার্কি!
দেখি না, পাশেই একটা নালা। তার ভিতরে গোলগাল একটি ভদ্রলোক। ওই আওয়াজ তিনিই করছেন।
ভদ্রলোক? আরে হ্যাঁ—হ্যাঁ–ভদ্রলোক ছাড়া কী বলা যায় আর? একটি নধর নিটোল কোলা ব্যাঙ! পিঠের ওপর বড় বড় টোপ তোলা মস্ত মস্ত চোখ দুটো কানের মতো খাড়া হয়ে রয়েছে। আমার দিকে ড্যাবডেবে চোখ তুলে চেয়ে রয়েছে, আর থেকে থেকে শব্দ করছে; ক্রাংক্রাংকর কুরু
করছে কী জানো? ফুটবলের ব্লাডারে হাওয়া দিলে যেমন করে ফোলে, তেমনিভাবে গলার দুপাশে বাতাস ভরে নিচ্ছে, গলাটা মোটা হয়ে উঠছে। আর বাতাসটা যেমনি ছেড়ে দিচ্ছে অমনি শব্দ হচ্ছে; ক্র্যাং—কড়াং–
বটে! তাহলে এমনি করেই কোলাব্যাঙ ডাকে। সারা বর্ষা এইভাবে গ্যাঙর-গ্যাঙর করে।
আমি ব্যাঙটাকে বললুম, খুব যে মেজাজে বসে আছিস দেখছি!
ব্যাঙ একটা মস্ত লাল জিভ বের করে দেখালে।
–আমাকে ভয় দেখাচ্ছিস বুঝি?
ব্যাঙ গলার দুধারে বাতাস জড়ো করতে লাগল।
—এক চাঁটিতে তোকে উড়িয়ে দিতে পারি তা জানিস?
ব্যাঙটা আওয়াজ করলে; ক্র্যাং—কুর্র্! মানে যেন বলতে চাইল; ইস, ইয়ার্কি নাকি? চেষ্টা করেই দেখ না একবার!
–বটে!
–ক্রুং—ফুর্র–
-জানিস, আমার বড্ড খিদে পেয়েছে? আমি ইচ্ছে করলে তোকে এক্ষুনি ভেজে খেতে পারি?
–তবে তাই খা—বলেই কে আমার পিঠে ঠাস্ করে একটা চাঁটি মারল।
–বাপরে–ভূত নাকি?
আমি হাত-তিনেক লাফিয়ে উঠলুম। তারপর দেখি, একমুখ দাঁত বের করে হাবুল সেন।
–হাবলা—তুই?
হাবুল বললে, হ, আমি। কিন্তু তোর এ কী দশা হইছে প্যালা? কাদা মাইখ্যা, ভূত সাইজ্যা অ্যাঁটা ব্যাঙের লগে মস্করা করতে আছস?
এই ফাঁকে ব্যাঙটা মস্ত লাফ দিয়ে ঝোপের মধ্যে কোথায় যেন চলে গেল।
আমি ব্যাজার হয়ে বললুম, খোশ-গল্প এখন থাক। কিছু খাবারের ব্যবস্থা করতে পারিস?
—আরে আমি খাবার পামু কই? সেই তখন থিক্যা জঙ্গলের মইধ্যে হারা উদ্দেশ্যে ঘুরতাছি। কে যে কোথায় চইলা গেল খুঁইজাই পাই না। শ্যাষে একটা গাছের নীচে শুইয়া ঘুম দিলাম।
–বনের মধ্যে ঘুমুলি?
-হ, ঘুমাইলাম।
—তোকে যদি বাঘে নিত?
হাবুল আবার একগাল হাসল; আমারে বাঘে খায় না।
–কী করে জানলি?
—আমি হাবুল স্যান না? উইঠ্যা বাঘেরে অ্যাঁমন অ্যাঁটা চোপড় দিমু যে—
বাকিটা হাবুল আর বলতে পারল না। হঠাৎ সমস্ত বন জঙ্গল কাঁপিয়ে কে যেন বিকট গলায় হ্যা-হ্যাঁ-হ্যাঁঃ করে হেসে উঠল। একেবারে আমাদের কানের কাছেই।
-ওরে বাপরে—
হাবুল আর ডাইনে বাঁয়ে তাকাল না। ঊধ্বশ্বাসে ছুট লাগাল।
আবার সেই শব্দ; হ্যা-হ্যা-হ্যাঃ—
এবার সেই ভিজে কাপড়ে জামায় আমিও হাবুলের পেছন দে ছুট–দে ছুট।
–ওরে হাবলা, দাঁড়া-দাঁড়া যাসনি আমাকে ফেলে যাসনি—
১৫. বেশি দূর দৌড়তে হল না
বেশি দূর দৌড়তে হল না। হাউ-মাউ করে খানিকটা ছুটেই একটা গাছের শেকড়ে পা লেগে হাবুল ধপাস্! সঙ্গে সঙ্গে আমিও তার পিঠের ওপর কুমড়োর মতো গড়িয়ে পড়লুম।
খাইছে–খাইছে!–হাবলা হাহাকার করে উঠল।
তারপর দুজনে মিলে জড়াজড়ি। ভাবছি পেছন থেকে এবার সেই অট্টহাসির ভূতটা এসে আমাদের দুজনকে বুঝি ক্যাঁক করে গিলে ফেলল।
কিন্তু মিনিট পাঁচেক গড়াগড়ি করেও যখন কিছুই হল না–আর মনে হল আমরা তো এখন কলেজে পড়ছি–ছেলেমানুষ আর নই, অমনি তড়াক করে উঠে পড়েছি। দুত্তোর ভূত! বাঘের গর্তে পড়েই উঠে এলুম–ভূতকে কিসের ভয়।
হাবুল সেন তো বিধ্বস্তভাবে পড়ে আছে, আর চোখ বুজে সমানে রাম রাম বলছে। বোধহয় ভাবছে ভূত ওর ঘাড়ের ওপর এসে চেপে বসেছে। থাক পড়ে। আমি উঠে জুল-জুল চোখে চারিদিকে চেয়ে দেখলুম।
অমনি আবার সেই হাসির আওয়াজ; হ্যাঁ-হ্যাঃ—হ্যাঃ।
শুনেই আমি চিংড়িমাছের মতো তিড়িং করে লাফ মেরেছি। হাবুল আবার বললে, খাইছে–খাইছে!
কিন্তু কথাটা হল, হাসছে কে! আর আমাদের মতো অখাদ্য জীবকে খেতেই বা চাচ্ছে কে!
আরে ছ্যা ছা! মিথ্যেই দৌড় করালে! কাণ্ডটা দেখেছ একবার! ওই তো বকের মতো একটা পাখি, তার চাইতে গলাটা একটু লম্বা, কদমছাঁট চুলের মতো কেমন একটা মাথা কালচে রং, কুতকুতে চোখ। আবার দুটো বড়বড় ঠোঁট ফাঁক করে ডেকে উঠল : হ্যঃ–হ্যাঃ—
—ওরে হাবলা, উঠে পড়! একটা পাখি!
হাবুল সেন কি সহজে ওঠে? ঠিক একটা জগদ্দল পাথরের মতো পড়ে আছে। চোখ বুজে, তিনটে কুইনাইন একসঙ্গে খাচ্ছে এইরকম ব্যাজার মুখ করে বললে, রামনাম কর প্যালা–রামনাম কর। এইদিকে ভূতে ফ্যাকর ফ্যাকর কইর্যা হাসতাছে আর অর অখন পাখি দেখনের শখ হইল!