সামনেই কয়েকটা শুকনো মাটির ঢেলা পড়ে ছিল। তার দু-একটা তুলে নিয়ে বললুম, চলা আও—চলা আও—
সঙ্গে সঙ্গে নাকের ওপর আর-একটা ফল এসে পড়ল। বাঘের ল্যাজের ঘা খেয়ে নাকটা এমনিতেই বোঁচা হওয়ার জো–তার ওপর বাঁদরের এই বর্বর অত্যাচার! আমার শরীরে দস্তুরমতো ব্ৰহ্মতেজ এসে গেল।
চালাও ঢিল—লাগাও—
দমাদ্দম গাছের ওপর ঢিল চালাতে লেগে গেলুম। একেবারে মরিয়া হয়ে।
হঠাৎ বোঁ—ওঁ—ওঁ করে কেমন বেয়াড়া বিচ্ছিরি আওয়াজ।
এরোপ্লেন নাকি? আরে না-না–এরোপ্লেন কোথায়? গাছের একটা ডাল থেকে দল বেঁধে উড়ে আসছে ওরা কারা? চিনতে আমার একটুও কষ্ট হল না–ছেলেবেলায় মধুপুরে ওদের একটার মোক্ষম কামড় আমি খেয়েছিলুম। সেই থেকে ওদের আমি হাড়ে হাড়ে চিনি।
ভীমরুল! আমার ঢিল বাঁদরের গায়ে লাগুক আর না-লাগুক—ঠিক ভীমরুলের চাকে গিয়ে লক্ষ্যভেদ করেছে।
–মাঁরুচি–মাঁরুচি—খাউঞ্চি বলে বাঁদরটা এক লাফে কোথায় হাওয়া হল কে জানে! ওর মধ্যেই দেখতে পেলুম ওর নাকে মুখে ল্যাজে ভীমরুলেরা চেপে বসেছে। বোঝো–আমাকে ভ্যাংচানোর আর ঢিল মারবার মজাটা বোঝো!
কিন্তু এ কী! আমার দিকেও যে ছুটে আসছে ঝাঁক বেঁধে! এখন?
দৌড়দৌড়-মার দৌড়!
তবু সঙ্গ ছাড়ে না যে! যত ছুটছি, ততই যে পেছনে পেছনে আসছে ঝাঁক বেঁধে! এল–এল—এই এসে পড়ল–! গেছি এবার! কামড়ে আমাকে আর আস্ত রাখবে না!
এখন কী করি? বাঘের হাত থেকে বেঁচে গিয়ে শেষে কি ভীমরুলের হাতে মারা যাব? আমি ঠিক এই সময়েই–
জয় গুরু। সামনে একটা পচা ডোবা!
ঝপাং করে আমি সেই ডোবাতেই সোজা ঝাঁপ মারলুম।
১৪. কী পচা পাঁক
কী পচা পাঁক, আর কী বিচ্ছিরি গন্ধ! কতক্ষণ আর মাথা ড়ুবিয়ে থাকা যায় তার ভেতরে! একটু মাথা তুলি, আর বোঁ–ওঁ–ওঁ! সমানে চক্কর দিচ্ছে ভীমরুলেরা। এ কী ল্যাঠায় পড়া গেল!
ভাগ্যিস ডোবাটায় বেশি জল নেই, নইলে তো ড়ুবে মরতে হত! হাঁটুসমান কাদা আর একটুখানি জলের ভেতর কোনওমতে ঘাপটি মেরে বসে আছি। চারিদিকে ব্যাঙ লাফাচ্ছে–নাকে কানে পোকা ঢুকছে, ঠাণ্ডায় হাত-পা জমে যাচ্ছে। বাঘের গর্ত থেকে উঠে কি শেষতক পচা ডোবার মধ্যেই মারা যাব নাকি?
একবার মাথা ওঠাই–অমনি বোঁ-ও-ওঁ। আবার ড়ুব! অমনি করে কতক্ষণ কাটল জানি। তারপর যখন ভীমরুলেরা হতাশ হয়ে সরে পড়ল, তখন ভালো করে তাকিয়ে দেখে-টেখে আমি ডোবা থেকে উঠে এলুম।
ইঃ–কী খোলতাই চেহারাখানাই হয়েছে। একটু আগে আমি ছিলুম পটলডাঙার প্যালারাম ওজন ছিল সর্বসাকুল্যে এক মন সাত সের। এখন আমি যে কে–ঠাহরই করতে পারলুম না। সারা গায়ে কাদার আস্তর পড়েছে, নিজের হাত-পা জামা কাপড় কিছু দেখতে পাচ্ছি না–পা তো ফেলছি না, যেন হাতির মতো পদক্ষেপ করছি। আমি এখন ওজনে অন্তত সাড়ে তিন মন–মাথার ওপর আরও পোয়াটাক ব্যাঙাচি নাচানাচি করছে।
কিন্তু এমন কী করি! কোন্ দিকে যাই?
কাদা-টাদাগুলো খানিক পরিষ্কার করলুম, জামা জুতো ডোবার জলেই ধুয়ে নিলুম। কিন্তু এখন কোন দিকে যাই! শীতে সারা শরীর জমে যেতে চাইছে। চারিদিকে ঘন জঙ্গল কোথায় যাব, কী করব কিছুই ঠিক করতে পারলুম না। টেনিদার কী হল–চারমূর্তির বাকি তিনজনই বা কোথায় কুট্টিমামা তাঁর শিকারিদের নিয়েই বা কোন্ দিকে গেলেন?
সে ভাবনা পরে হবে। এখন এই শীতের হাত থেকে কেমন করে রেহাই পাই?
বনের পাতার ফাঁক দিয়ে এক জায়গায় ঝলমলে রোদ পড়েছে খানিকটা। বেলা এখন বোধহয় দুপুরের দিকে। আমি সেই রোদের মধ্যে এসে দাঁড়ালুম। বেশ ঝাঁঝালো রোদ–এতক্ষণে একটু আরাম পাচ্ছি।
কিন্তু ল্যাঠা কি আর একটা নাকি? এইবারে টের পেলুম–পেটের মধ্যে ছুঁই ছুঁই করে উঠেছে। মানে—জোর খিদে পেয়েছে।
যেই খিদেটা টের পেলুম অমনি মনে হল আমি যেন কতকাল খাইনি–নাড়িভুঁড়িগুলো সব আবার ছিড়ে টুকরো টুকরো হয়ে যেতে চাইছে। খিদের চোটে আর দাঁড়াতে পারছি না আমি। মনে পড়ল, আসবার সময় টিফিন ক্যারিয়ার-ভর্তি খাবার আনা হয়েছিল—তাতে লুচি ছিল, আলুর দম ছিল, বেগুন ভাজা ছিল, সন্দেশ ছিল—
হায়, কোথায় ভ্যান–কোথায় লুচি আর আলুর দম! জীবনে কোনও দিন কি আর আলুর দমের মুখ দেখতে পাব আমি। কিছুক্ষণ পরে বনের ভেতরই পটলডাঙার প্যালারামের বারোটা বেজে যাবে। যদি বাঘ-ভালুকে না খায়, খিদেতেই মারা যাব।
নাঃ, আর পারা যায় না! কিছু একটা খাবার-দাবার জোগাড় করা দরকার।
যেই খাবার-দাবারের কথা ভাবলুম অমনি শরীরে তেজ এসে গেল। আমি দেখেছি, আমার এই রকমই হয়। সেই একবার হাবুলের ছোট ভাই বাবুলের অন্নপ্রাশনে নেমন্তন্ন ছিল। আগের দিন রাতে কোঁ-কোঁ করে জ্বর এসে গেল। ভাবলুম, পরদিন ওরা সবাই প্রেমসে মাংস-পোলাও সাঁটবে আর আমার বরাতে কেবল বার্লির জল। দারুণ মনের জোর নিয়ে এলুম। বললে বিশ্বাস করবে না, সকালেই জ্বর একদম রেমিশন। খেয়েছিলুমও ঠেসে। অবশ্য সেদিন রাত থেকে…কিন্তু সে কথা বলে আর কাজ নেই। মানে, নেমন্তন্নটা তো আর ফসকাতে দিইনি!
আপাতত আমায় খেতেই হবে। শীতফীত চুলোয় যাক।
বনে তো অনেক রকম ফল-পাকড় থাকে শুনেছি। মুনি-ঋষিরা সেইসব খেয়েই তপস্যা করেন। আমি গাছের দিকে তাকাতে তাকাতে গুটিগুটি এগোলুম। দু ফল কোথায়? কেবল পাতা আর পাতা! ছাগল হলে অবিশ্যি ভাবনা ছিল না। বড়দা আমাকে ছাগল বলে বটে, কিন্তু আমি তো সত্যিই-সত্যিই ঘাস-পাতা খেতে পারি না! ফল পাই কোথায়।