ক্যাবলা বললে, গুল!
টেনিদা চোখ পাকিয়ে বললে, কী বললি?
ক্যাবলা বললে, না—মানে, বলছিলুম–গুল বাঘ আর ভোরাদার বাঘ–দুরকমের বাঘ হয়।
হাবুল বললে, আর-এক রকমের বাঘও হয়। বিছানায় থাকে আর কুটুস কইর্যা কামড়ে দেয়। তারে বাগ কয়।
আমিও ভেবে-চিন্তে বললুম, আর তাকে কিছুতেই বাগানো যায় না। কামড়েই সে হাওয়া হয়ে যায়।
টেনিদা রেগেমেগে বললে, দুত্তের খালি বাজে কথা! এদের কাছে কিছু বলতে যাওয়াই ঝকমারি! এই তিনটের নাকে তিনখানা মুগ্ধবোধ বসিয়ে নাকভাঙা বুদ্ধদেব বানিয়ে দিলে তবে ঠিক হয়। ফাজলামি নয়–সোজা জবাব দে–যাবি কি যাবি না? না যাস একাই যাচ্ছি প্লেনে চেপে তোরা এখানে ভ্যারেণ্ডা ভাজ বসে বসে।
আমি বললুম, বাঘে কামড়াবে না?
বললুম তো সে আজকাল ভেজিটেবিল খায়। আলুর দম আর মুলো হেঁচকি খেতে দারুণ ভালবাসে।
ক্যাবলা জিজ্ঞেস করলে, তার আত্মীয়স্বজন?
—তারা কুট্টিমামাকে দেখলেই ভয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়বে। তখন আর শিকার করবারও দরকার নেই–স্রেফ গলায় দড়ি বেঁধে বাড়িতে নিয়ে এলেই হল।
আমি ভারি খুশি হয়ে বললুম, তা হলে তো যেতেই হয়! আমরা সবাই একটা করে বাঘ সঙ্গে করে বেঁধে আনব।
হাবুল বললে, সেই বাঘে দুধ দিব। ক্যাবলা বললে, আর সেই বাঘের দুধ বিক্রি করে আমরা বড়লোক হব। টেনিদা চেঁচিয়ে উঠে বললে ডি-লা-এ্যাণ্ডি মেফিস্টোফিলিস–আমরা সবাই আরও জোরে চিৎকার করে বললুম ইয়াক-ইয়াক! বাবা অফিস যাওয়ার সময় বলে গেলেন, সাতদিনের মধ্যে ফিরে আসবি একদিনও যেন কলেজ কামাই না হয়।
কোর্টে বেরুতে বেরুতে বড়দা মনে করিয়ে দিলে, দু-একখানা পড়ার বইও সঙ্গে নিয়ে যাস–খালি ইয়ার্কি দিয়ে বেড়াসনি।
ছুটির ভিতরে পড়ার বই নিয়ে বসতে বয়ে গেছে আমার। আমি সুটকেসের ভেতর হেমেন রায় আর শিবরামের নতুন বই ভরে নিয়েছি খানকয়েক।
মা এসে বললে, যা-তা খাসনি। তুই যেরকম পেটরোগা–বুঝেসুঝে খাবি।
কোত্থেকে আধুলি এসে জুড়ে দিলে, দুটো কাঁচকলা নিয়ে যা ছোড়দা–আর হাঁড়ির ভেতরে গোটাকয়েক শিঙিমাছ।
আমি আধুলির বিনুনিটা চেপে ধরতে যাচ্ছি সেই সময় মেজদা এসে হাজির। এসেই বলতে লাগল : প্লেনে চেপে যদি কানে ধাপা লাগে তা হলে হাই তুলতে থাকবি। যদি বমি আসে তা হলে অ্যাঁভোমিন ট্যাবলেট দিচ্ছি–গোটা কয়েক খাবি। যদি–
উঃ, উপদেশের চোটে প্রাণ বেরিয়ে গেল! এর মধ্যে আবার ছোড়দি এসে বলতে আরম্ভ করল; দার্জিলিঙের কাছাকাছি তো যাচ্ছিস। যদি সস্তায় পাস কয়েক ছড়া পাথরের মালা কিনে আনিস তো!
—দুত্তোর বলে চেঁচিয়ে উঠতে যাচ্ছি, ঠিক সেই সময়েই বাইরে মোটরের হর্ন বেজে উঠল। আর টেনিদার হাঁক শোনা গেল; কি রে প্যালা–রেডি?
—রেডি। আসছি—
তক্ষুনি সুটকেস নিয়ে লাফিয়ে উঠলুম। হাবুলদের মোটরে চেপে ওরা সবাই এসে পড়েছে। মোটরে করে সোজা দমদমে গিয়ে আমরা প্লেনে উঠব। তারপর দুঘণ্টার মধ্যে পৌঁছে যাব ড়ুয়ার্সের জঙ্গলে। তখন আর পায় কে! কুট্টিমামার ওখানে মজাসে খাওয়া-দাওয়া চা বাগান আর বনের মধ্যে বেড়ানো–দু-একদিন শিকারে বেরিয়ে গলায় দড়ি বেঁধে বাঘ-টাঘ নিয়ে আসা। ডি-লা-এ্যাণ্ডি মেফিস্টোফিলিস!
সকলকে চটপট প্রণাম-ট্রনাম সেরে নিয়ে গেট খুলে বেরুতে যাচ্ছি, হঠাৎ
পেছনে বিটকেল ব-ব-ব আওয়াজ আর শাটের কোনা ধরে এক হ্যাঁচকা টান। চমকে লাফিয়ে উঠলুম। তাকিয়ে দেখি, হতচ্ছাড়া গঙ্গারাম। দাড়ি নেড়ে নেড়ে আমার জামাটা খাওয়ার চেষ্টা করছে।
–তবে রে অযাত্রা! পেছু টান।
ধাঁই করে একটা চাঁটি বসিয়ে দিলুম গঙ্গারামের গালে। গঙ্গারাম ম্যা-আ-আ করে উঠল। আর আমার হাতে যা লাগল সে আর কী বলব! গঙ্গারামটার গাল যে এমন ভয়ানক শক্ত, সেকথা সে জানত!
মোটর থেকে টেনিদা আবার হাঁক ছাড়ল;কী রে প্যালা, দেরি করছিস কেন?
—আসছি বলে এক ছুটে বেরিয়ে আমি গাড়িতে উঠে পড়লুম। তখনও গঙ্গারাম সমানে ডাকছে; ম্যা-অ্যাঁ-অ্যাঁভ্যা-অ্যাঁ-অ্যাঁ। ভাবটা এই : খামকা আমায় একটা রামচাঁটি লাগালে? আচ্ছা যাও ড়ুয়ার্সের জঙ্গলে। এর ফল যদি হাতে-হাতে না পাও–তা হলে আমি ছাগলই নই।
হায় রে, তখন কি আর জানতুম–গঙ্গারামের ভাগনে যা দশগণ্ডা করে মারে, তারই পাল্লায় পড়ে আমার অদৃষ্টে অশেষ দুঃখ আছে এরপর!
গাড়ি দমদম এয়ারপোর্টের দিকে ছুটল।
০২. বিমানে চৈনিক রহস্য
ভজহরি মুখার্জি–স্বর্ণেন্দু সেন-কুশল মিত্র–কমলেশ ব্যানার্জি
নামগুলো শুনে চমকে চমকে উঠছ তো? ভাবছ–এ আবার কারা? হুঁ হুঁ ভাববার কথাই বটে। এ হল আমাদের চারমূর্তির ভালো নাম আগে স্কুলের খাতায় ছিল। এখন কলেজের খাতায়। ভজহরি হচ্ছে আমাদের দুর্দান্ত টেনিদা, স্বর্ণেন্দু হল ঢাকাই হাবুল, কুশল হচ্ছে হতচ্ছাড়া ক্যাবলা আর কমলেশ? আন্দাজ করে নাও।
এসব নাম কি ছাই আমাদের মনে থাকে? প্লেনে উঠতে যেতেই একটা লোক কাগজ
নিয়ে এইসব নাম ডাকতে লাগল। আমরাও–এই যে–এই যে বলে টকটক উঠে পড়লুম। হাবলা তো অভ্যাসে বলেই ফেলল, প্রেজেন্ট স্যার।
আরে রামো–এ কী প্লেন!
এর আগে আমি কখনও প্লেনে চাপিনি–কিন্তু বড়দা ও মেজদার কাছে কত গল্পই যে শুনেছি! চমৎকার সব সোফার মতো চেয়ার–থেকে-থেকে চা-কফি-লজেন্স-স্যাণ্ডউইচ-সন্দেশ খেতে দিচ্ছে, উঠে বসলেই সে কী খাতির। কিন্তু এ কী! প্লেনের বারো আনা বোঝাই কেবল বস্তা আর কাপড়ের গাঁট, কাঠের বাক্স, আবার এক জায়গায় দড়ি দিয়ে বাঁধা কয়েকটা হুঁকোও রয়েছে।