আমার খুব মজা লাগল। থাকত কলাগাছ–লম্ফঝম্ফ তোমার বেরিয়ে যেত! এখন দাপাদাপি করো—যত ইচ্ছে!
আরে, মারা যখন গেছিই, তখন আর ভাবনা কী! শজারুটার ফোঁসফোঁসানি দেখে আমার দস্তুরমতো গান পেয়ে গেল। তোমরা তো জানোই—দেখতে আমি রোগা-পটকা হলে কী হয়—গান ধরলে আমার গলা থেকে এমনি হালুষ রাগিণী বেরুতে থাকে যে ক্যাবলাদের রামছাগলটা পর্যন্ত দারুণ ঘাবড়ে গিয়ে ম্যা-হা-হা বলে চিৎকার ছাড়ে। শজারুটা যাতে তেড়ে এসে আমাকে কয়েকটা খোঁচা-টোচা না লাগিয়ে দেয়, সেজন্যে ওকে ভেবড়ে দেবার জন্যে আমি হাউ-মাউ করে হ-য-ব-র-ল থেকে গাইতে শুরু করলাম :
বাদুড় বলে, ওরে ও ভাই শজারু,
আজকে রাতে হবে একটা মজারু—
সেই বন্ধ গর্তের ভেতর আমার বেয়াড়া গলার বাজখাঁই গান যে কেমন খোলতাই হল—সে বোধহয় না বললেও চলে। এমন পিলে কাঁপানো আওয়াজ বেরুল যে শুনে নিজেই আমি চমকে গেলুম। শজারুটা তিড়িক করে একটা লাফ মারল।
এই রে, তেড়ে আসে নাকি আমার দিকে! ওর গোটাকয়েক কাঁটা গায়ে ফুটিয়ে দিলেই তো গেছি—একেবারে ভীষ্মের শরশয্যা! প্রাণের দায়ে জোর গলা-খাঁকারি দিয়ে আবার আরম্ভ করলুম :
আসবে সেথায় প্যাঁচা এবং প্যাঁচানি—
শজারুটা এবার কেমন একটা আওয়াজ করলে। তারপর আমার দিকে আর না এগিয়ে–সুড়সুড়িয়ে আরও পেছনে সরে গেল, কাঁটা ফুলিয়ে কোণে গোল হয়ে বসে রইল। আমার গানের তোয় আপাতত বিপর্যস্ত হয়ে গেছে মনে হল—সহজে যে আর আক্রমণ করবে এমন বোধ হচ্ছে না।
ও থাক বসে। আমিও বসি। কিন্তু আমিও বসব? বসে থেকে আমার কী লাভ? আমি তো এখনও মরিনি। উপর থেকে হাত-দশেক নীচে একটা গর্তের মধ্যে পড়েছি বটে, তাই বলে এখনও তো আমার পঞ্চত্ব পাওয়ার মতো কিছু ঘটেনি। একটু চেষ্টা করলে হয়তো আরও কিছুদিন শেয়ালদা বাজারের শিঙিমাছ আর কচি পটোল সাবাড় করবার জন্যে আমি বেঁচে থাকতে পারি।
আর শুধু নিজের বাঁচাটাই কি বড় কথা? আমাদের বাংলার প্রফেসর একদিন পড়াতে পড়াতে বলেছিলেন, নিজের জন্যে বাঁচে জানোয়ারেরা, সকলের জন্য বাঁচে মানুষ। আমি পটলডাঙার প্যালারাম-রোগা-পটকা হতে পারি, ভিতু হতে পারি, কিন্তু আমি মানুষ। খালি আমার নিজের কথাই তো ভাবলে চলবে না। আমাদের লিডার টেনিদাকে যেমন করে হোক উদ্ধার করতে হবে, চার মূর্তির আর সবাই কোথাও যদি কেউ বিপদে পড়ে থাকে তাদের বাঁচাতে হবে। আমি বাঁচব-সকলের জন্যেই বাঁচব!
গর্তের কোনায় গোল-হয়ে বসে থাকা শজারুটা কেমন ফ্যাঁচ-ফ্যাঁচ করে উঠল। আমার মনে হল, যেন রাষ্ট্রভাষায় বললে, কেয়াবাৎ-কেয়াবাৎ! অথাৎ কিনা শাবাশ, শাবাশ!
আবার মাথা তুলে চাইলুম। ওপরে গর্ত জুড়ে সেই গোল আকাশটুকু। একটা গাছের ডাল নেমে এসেছে, তার পাতা কাঁপছে ঝিরঝিরিয়ে। পারব না—একটু চেষ্টা করলে উঠে যেতে পারব না? তেনজিং এভারেস্টের চূড়ায় উঠতে পারলেন—আমি একটা গর্ত বেয়ে উঠে যেতে পারব না ওপরে? তেনজিংয়ের তো আমার মতো দুখানা হাত আর দুখানা পা-ই ছিল! তবে?
দেখিই না একবার চেষ্টা করে। সেই-যে বইতে আছে না, যে মাটিতে পড়ে লোক, উঠে তাই ধরে? মাটির ভেতর দিয়ে আছড়ে পড়েছি, মাটি ধরেই উঠে যাব।
যা থাকে কপালে বলে উঠতে যাচ্ছি, আর ঠিক তখন–
হঠাৎ কানে এল বনবাদাড় ভেঙে কে যেন দুড়দাড় করে ছুটে আসছে। তার পরেই হুড়মুড় সরসরঝরঝর করে আওয়াজ। ঠিক মনে হল, গোল আকাশটা তালগোল পাকিয়ে নীচে আছড়ে পড়ল। আমার মুখ-চোখে ধুলো-মাটি আর গাছের পাতার পুষ্পবৃষ্টি হল, আর কী একা পেল্লায় জিনিস ধপধপপাস করে নেমে এল গর্তে প্রায় আমার গা ঘেঁষে। তার প্রকাণ্ড ল্যাজটা চাবুকের মতো আমার গায়ে ঘা মারল।
আর সেই বিরাট জন্তুটা গুরুর—হুম–বলে কানফাটানো এক চিৎকার ছাড়ল।
সে-চিৎকারে আমার মাথা ঘুরে গেল। চোখের সামনে দেখলুম সারি সারি সর্ষে ফুলের শোভা। উৎকট দুর্গন্ধে যেন দম আটকে আসতে চাইল।
গর্তে যে পড়েছে তাকে আমি দেখেছি। সে বাঘ! বাঘ ছাড়া আর কেউ নয়।
আমার তা হলে বারোটা নয় সাড়ে দেড়টাও নয়, পুরো সাড়ে আড়াইটে বেজে গেল। একবার আমি হাঁ করলুম, খুব সম্ভব গাঁ-গাঁ করে খানিক আওয়াজ বেরুল, তারপর
তারপর থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে গর্তের মাটিতে একেবারে পপাত।
১৩. বাঘ ভার্সাস ঘোগ
খুব সম্ভব মরেই গিয়েছিলাম। কিন্তু মরা মানুষকেও যে জাগিয়ে তুলতে পারে সে হল বাঘের ডাক। কানের পাশে যেন একসঙ্গে পঁচিশটা বাজ পড়ল এইরকম মনে হল আমার, আর মুখের ওপর ফটাস করে মোটা কাছির মতো কিসের একটা ঘা লাগল। বুঝতে পারলুম, বাঘের ল্যাজ।
মাত্র একহাত দূরে আমার বাঘ পড়েছে–তারপরেও কি আমার বেঁচে থাকা সম্ভব? আমি—পটলডাঙার প্যালারাম–এ-যাত্রা নির্ঘাত তা হলে মারাই গৈছি। আর যদি মরেই গিয়ে থাকি তা হলে আর কিসের ভয় আমার? আমি তো এখন ভূত। ভূতকে কি কখনও বাঘে ধরে?
আবার বিশটা বাজের মতো আওয়াজ করে, গর্ত ফাটিয়ে বাঘ হাঁক ছাড়ল–তারপরেই একটা পেল্লায় লাফ। আমি ঝট করে একটু সরে গিয়েছিলুম বলে বাঘ আমার গায়ে পড়ল না, কিন্তু ল্যাজটার ঘায়ে আমার নাক প্রায় থেঁতলে গেল। আর বাঘের নখের আঁচড়ে গর্তের গা থেকে খানিক মাটি ঝুরঝুর করে চোখময় ছড়িয়ে গেল।
এ তো ভালো ল্যাঠা দেখছি! বাঘ যদি আমাকে না-ও ধরে–বাঘের দাপাদাপিতেই আমি–মানে আমার ভূতটা মারা যাবে। কিংবা নাকে যখন ল্যাজের ঘা এসে এমন বেয়াড়াভাবে লেগেছে যে মনে হচ্ছে হয়তো আমি বেঁচেই আছি।