—পটলডাঙা—
—জিন্দাবাদ!
–চার মূর্তি—
–জিন্দাবাদ!
তারপরেই দেখি, ওরা দুজনে দুদিকে বনের মধ্যে সুট করে কোথায় চলে গেল। আমি এখন একা। এই বাঘ-সাপ-হাতির জঙ্গলে একেবারে একা। নিজেকে বললুম, বুকে সাহস আনো পটলডাঙার প্যালারাম! তুমি যে কেবল শিঙিমাছ দিয়েই পটোলের ঝোল খেতে এক্সপার্ট তা নও, তার চাইতে আরও অনেক বেশি। আজ তোমার চরম পরীক্ষা। তৈরি হও সেজন্যে।
একটা শুকনো ডাল পড়ে ছিল সামনে। সেইটে কুড়িয়ে নিয়ে আমিও চলতে শুরু করলুম। মরবার আগে অন্তত কষে এক ঘা তো বসাতে পারব! সে হাতিই হোক আর বাঘই হোক।
কিন্তু বেশিদূর যেতে হল না আমাকে।
একটা ঝোপের ওপর যেই পা দিয়েছি, অমনি—
সড়াক্–ঝরঝরাৎ–
পায়ের তলার থেকে মাটি সরে গেল। আর তৎক্ষণাৎ বুঝতে পারলুম, মহাশূন্য বেয়ে আমি কোথায় কোন পাতালের দিকে পড়ে যাচ্ছি।
-মা-
তারপরেই আমার চোখ বুজে এল।
১২. শজারু সঙ্গীত
গর্তে পড়ে মনে হয়েছিল—পটলডাঙার প্যালারাম এবার একদম ফিনিশ—হাড়গোড় কিছু বুঝি আর রইল না। মরে গেছি—মরে গেছি–ভাবতে ভাবতে দেখি, আমি মোটেই মারা যাইনি। দিব্যি বহাল তবিয়তে একরাশ নরম কাদার ওপর পা ছড়িয়ে বসে আছি পিঠটা ঠেস দেওয়া রয়েছে মাটির দেওয়ালে।
কোমরটা কেবল একটু ঝনঝন করছে—মাথাতেও ঝাঁকুনি লেগেছে। সেটুকু সামলে নিয়ে চোখ মেলে তাকালুম। মাথার হাত-দশেক ওপরে একটা গোল আকাশ-আরও ওপরে একটা গাছের ডাল দুলছে। আশেপাশে চেয়ে দেখলুম অন্ধকার, গর্তটা কত বড় কিংবা আমি ছাড়া এর ভেতরে আর কী আছে, কিছু বুঝতে পারলুম না।
এমন সময় খুব কাছেই যেন একটা ঝমঝম করে শব্দ শুনতে পেলুম। ঠিক মনে হল কেউ যেন হাতে করে টাকার তোড়া বাজাচ্ছে।
আমার খাড়া খাড়া কান দুটো আরও খাড়া হয়ে উঠল। ব্যাপারখানা কী?
গর্তে যখন পড়েছি তখন তো মারাই গেছি। কিন্তু মরবার আগে সব ভালো করে জেনেশুনে নেওয়া দরকার, কারণ বইতেই পড়েছি : মৃত্যুকাল পর্যন্ত জ্ঞান সঞ্চয় করিবে। ওটা কীসের আওয়াজ?
মাথায় ঝাঁকুনি লাগবার জন্যেই বোধহয় চোখ এখনও ঝাপসা হয়ে রয়েছে। খুব লক্ষ করেও একদিকে ছোট একটা ছায়ার মতো ছাড়া আর কিছুই দেখতে পেলুম না। কিন্তু আবার শুনলুম কে যেন ফোঁসফোঁস করে নিশ্বাস ফেলছে, আর শব্দ উঠছে : ঝম-ঝম-ঝম–
অ্যাঁ–যখের গর্ত নাকি?
ভাবতেই আমার কানের ভেতরে গুবরে পোকারা কুরকুর করতে লাগল, নাকের ওপর যেন উচ্চিংড়ে লাফাতে লাগল, পেটের মধ্যে ছোট হয়ে-যাওয়া সেই পালাজ্বরের পিলেটা কচ্ছপের মতো শুড় বের করতে লাগল। শেষকালে কি পাতালে যখের রাজ্যে এসে পৌঁছে গেলুম? সেই কি অমন করে মোহরের থলি বাজিয়ে আওয়াজ করছে? একটু পরেই থলিটা আমার হাতে গুঁজে দিয়ে বলবে : বস প্যালারাম, অনেক কষ্ট করে তুমি এখানে এসে পৌঁছেছ দেখে ভারি খুশি হয়েছি, এবার এই মোহর নিয়ে তুমি দেশে চলে যাও বিরাট অট্টালিকা বানাও-ঘোড়াশালে ঘোড়া, হাতিশালে হাতি–
হাতির কথা ভাবতেই মনে হল, আমাদের লিডার টেনিদা বুনো হাতির পিঠে চড়ে কোথায় যেন উধাও হয়ে গেছে। আমরা তাকে খুঁজতে বেরিয়েছিলুম। কিন্তু কোথায় টেনিদা—আমিই বা কোথায়? এই বিচ্ছিরি আফ্রিকার জঙ্গলেদানা, ম্যাডাগাস্কারের অরণ্যে—দুত্তোর ড়ুয়ার্সের এই যাচ্ছেতাই বনের ভেতর, আমাদের চারমূর্তিরই বারোটা বেজে গেল।
সব ভুলে গিয়ে আমার এখন একটু একটু কান্না পেতে লাগল। মাকে মনে পড়ছে, বাবা, ছোড়দি, বড়দা, ছোট বোন দুটোকে মনে পড়ছে, এমনকি, যে-মেজদা একবার পেট কামড়েছে বললেই দেড় হাত লম্বা একটা সিরিঞ্জ নিয়ে আমার পেটে ইঞ্জেকশন দিতে আসে, তাকেও মনে পড়ে যাচ্ছে। খুব ছোটবেলায় বড়দা একবার আমায় বলেছিল ঘড়ি দেখে আসতে। ঘড়ি দেখে এসে আমি খুব গম্ভীর চালে বলেছিলুম, সাড়ে দেড়টা বেজেছে, আর শুনেই বড়দা আমার একটা লম্বা কানে তিড়িং করে চিড়িং মেরে দিয়েছিল। হায় বড়দা আর কোনও দিন অমন করে আমার কানে মোচড় দেবে না!
বারোটা নয়, এবার সত্যিই আমার সাড়ে দেড়টা বেজে গেল!
আবার সেই ঝমঝম শব্দ! চমকে উঠলুম।
চোখটা মুছে চাইতে এবার আমার জ্ঞান লাভ হয়। ধ্যেৎ–যখ-টখ কিছু না—সব বোগাস। এতক্ষণে গর্তের ভেতরকার অন্ধকারটা চোখে খানিকটা ফিকে হয়ে এসেছে। দেখলুম বেড়ালের চাইতে একটু বড় কী একটা জন্তু হাত-চারেক দূরে দাঁড়িয়ে সমানে ফোঁসফোঁস আওয়াজ করছে। তার খুদে-খুদে চোখ দুটো অন্ধকারে চিকচিক করছে আর তার সারা শরীরে মোটা মোটা ঝাঁটার কাঠির মতো কী সব খাড়া হয়ে রয়েছে।
আমি বলে ফেললুম, তুই আবার কে রে? ঝাঁটা বাঁধা বেড়ালের মতো দেখতে?
শুনেই জন্তুটা গা ঝাড়া দিলে। আর তক্ষুনি আওয়াজ হল : ঝন-ঝম—ঝুমুর-ঝুমুর!
আরে, তাই বল! এইবারে বুঝেছি। মিস্টার শজারু। ছেলেবেলায় মল্লিকা মাসিমার বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিলুম শক্তিগড়ে। ওঁদের বাড়ির পাশে আমবাগানে রাত্তির বেলা শজারু ঘুরে বেড়াত আর ভয় পেলেই কাঁটা বাজিয়ে আওয়াজ করত ঝুম ঝুম! মল্লিকা মাসিমা বলতেন, শজারুর মাংস খেতে খুব ভালো। যখন কাঁটা উঁচিয়ে দাঁড়ায়, তখন দুম করে ওর পিঠের উপর একটা কলাগাছ ফেলে দিতে হয়। ব্যস—জব্দ। কাঁটা কলাগাছে আটকে যায়—আর পালাতে পারে না।
বুঝতে পারলুম, আমি পড়বার আগে শজারু মশাইও কী করে গর্তে পড়েছেন। তাই আমি আসাতে খুব রাগ হয়েছে—ভাবছেন, আমিই বুঝি প্যাঁচ কষিয়ে ওঁকে ফেলে দিয়েছি। তাই খুব কাঁটা ফুলিয়ে আমাকে ভয় দেখানো হচ্ছে।