—সে হরিণ শিকার হলে নিয়ে যাওয়া যেত। কিন্তু চিতাবাঘ বড্ড শয়তান। কিছু বিশ্বাস নেই ওদের।
টেনিদাও বোধহয় মওকা খুঁজছিল। বললেন, আমরা তো শিকার করবার জন্যেই এসেছিলুম। কিন্তু কুট্টিমামার অসুবিধে হলে কী আর করা যায়—মনে ব্যথা পেলেও বাংলোতেই বসে থাকব।
ক্যাবলা বললে, সমঝ গিয়া। তোমার ভয় ধরেছে, তাই না যেতে পারলে বাঁচো। ওরা থাকুক মামা—আমি সঙ্গে যাব।
হাবলা সঙ্গে সঙ্গেই পোঁ ধরলে : হঃ–ক্যাবলা সাহস কইরা যাইতে পারব—আর আমি পারুম না। আমারেও লইতে হইব।
আমার যে কী বিচ্ছিরি স্বভাব—ওদের উৎসাহ দেখলে সঙ্গে সঙ্গে আমারও দারুণ তেজ। এসে যায়। তখন মনে হয় পালাজ্বর-ফালাজ্বর পিলে-টিলে কিচ্ছু না—আমি সাক্ষাৎ ভীম-ভবানী, এক্ষুনি গরিলার সঙ্গে দমাদম বসিং লড়তে পারি। মনে হয়, মনের দুঃখে মরে যাওয়ার কোনও মানে হয় না-মরি তো একটা কিছু করেই মরব।
একটু আগেই ভয় ধরে গিয়েছিল, হঠাৎ বুক চিতিয়ে বলে ফেললুম, আমিও যাব—নিশ্চয় যাব!
টেনিদা কেমন করুণ চোখে আমাদের দিকে তাকাল। তারপর ঘাড়-টাড় চুলকে নিয়ে বললে, সবাই যদি যায়—তবে আমিই আর বাদ থাকি কেন?
ক্যাবলা বললে, কিন্তু তুমহারা ডর লাগ গিয়া।
—ডর? হেঁঃ! আমি পটলডাঙার টেনি শর্মা—আমি ভয় করি দুনিয়ায় এমন কোন—
কথাটা শেষ হতেও পেল না। হঠাৎ বাইরে চ্যাঁ-চ্যাঁ করে এক বিটকেল আওয়াজ। টেনিদা তড়াং করে লাফিয়ে উঠল : ও কী—ও কী মামা?
কুট্টিমামা কী যেন বলতে গিয়েই হঠাৎ থমকে গেলেন। আমরা দেখলুম তাঁর মুখের চেহারা কেমন পাল্টে গেছে—দুচোখে অমানুষিক ভয়ের ছাপ।
কুট্টিমামা কেবল ফিসফিস করে বললেন, সর্বনাশ-কী সর্বনাশ! তারপর এক হাতে গলাটা চেপে ধরলেন।
বাইরে আবার চ্যাঁ-চ্যাঁ করে সেই বীভৎস ধ্বনি। আর কুট্টিমামার আতঙ্কে স্তব্ধ মুখের দিকে তাকিয়ে আমরাও একটা রহস্যময় ভয়ের অতলে ড়ুবে যেতে লাগলুম।
বাইরে ও কী ডাকল? কোন্ অদ্ভুত আতঙ্ক—কোন্ ভয়াল ভয়ঙ্কর?
১০. টেনিদার বিদায়
খানিক পরে হাবুল সেনই সামলে নিলে। মামার কপালে-তোলা মুখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলে, কী হইল মামা? অমন কইর্যা চক্ষু আকাশে তুইল্যা বইস্যা আছেন ক্যান?
কী ডাকল বাইরে? ভূত না রাইস?
কুট্টিমামার মুখখানা এবার ভীষণ ব্যাজার হয়ে গেল।
—দূর কী আর ডাকব? ও তো প্যাঁচা।
–প্যাঁচা ক্যাবলা আশ্চর্য হয়ে বললে, তাতে আপনি ভয় পেলেন কেন?
—ভয় পেলুম কখন? আমি বললুম, বা-রে, এই তো আপনি বললেন, কী সর্বনাশ কী সর্বনাশ। তারপরেই ভীষণ ঘাবড়ে গেলেন।
—আরে, ঘাবড়ে গেছি সাধে?কুট্টিমামার ব্যাজার মুখটা আরও ব্যাজার হয়ে গেল : একটা বাঁধানো দাঁত ছিল, সেটা গেল খুলে আর মনের ভুলে ক্লিপ-টিপসুদ্ধ সেটাকে টক করে গিলে ফেললুম! যাই—এক্ষুনি একটা জোলাপ খেয়ে ফেলি-গে।
কুট্টিমামা উঠে চলে গেলেন।
হাবুল বললে, দাঁতটা প্যাটে থাকলেই বা ক্ষতি কী! মামার তো সুবিধাই হইল। যা খাইব তারে ডবল চাবান দিতে পারব: একবার চাবাইব মুখে, আর একবার কইস্যা প্যাটের মধ্যে চাবান দিতে পারব।
টেনিদা দাঁত খিঁচিয়ে বললে, চুপ কর, তোকে আর ওস্তাদি করতে হবে না! কাল আমি তোকে একটা দেশলাই, খানিক সর্ষের তেল আর আধসের বেগুন গিলিয়ে দেব। পেটের মধ্যে বেগুন ভাজা করে খাস!
ছোট্টুলাল এসে বললে, খানা তৈয়ার।
সঙ্গে সঙ্গে লাফিয়ে উঠে পড়লুম আমরা। টেনিদা বললে, কেয়া বানায়া আজ?
ছোট্টুলাল বললে, ডিমের কারি, মাছের ফ্রাই—
টেনিদা বললে, ট্রা-লা-লা-লা-লা! কাল তো শিকারে যাচ্ছি। আমরা বাঘের পেটে যাব, হিপোপটেমাসেই গিলে খাবে কে জানে! চল—আজ প্রাণ ভরে ফাঁসির খাওয়া খেয়ে নিই!
ক্যাবলা বলতে যাচ্ছিল, ড়ুয়ার্সের জঙ্গলে কি হিপো—
কিন্তু বলবার সুযোগ পেলে না। তার আগে টেনিদা চেঁচিয়ে উঠল : ডি-লা গ্র্যান্ডি মেফিস্টোফিলিস–
আমরা কোরাস তুলে বললুম, ইয়াক-ইয়াক!
আর ছোট্টলাল চোখ দুটোকে আলুর দমের মতো করে আমাদের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।
সকালে উঠেই সাজ-সাজ রব।
দেখি, বেশ বড় একটা মোটর ভ্যান এসে গেছে। ওদিকে কুট্টিমামা বুট আর হাফপ্যান্ট পরে একেবারে তৈরি। গলায় টোটার মালা হাতে বন্দুক। কুলিদের সর্দারও এসে হাজির—তারও হাতে একটা বন্দুক। সদারের নাম রোশনলাল।
মামা বললেন, রোশনলাল খুব পাকা শিকারি। ওর হাতের তাক ফস্কায় না।
আমরাও চটপট কাপড়-জামা পরে নিলুম। কিন্তু টেনিদার আর দেখা নেই।
কুট্টিমামা বললেন, টেনি কোথায়?
টেনিদা—ভদ্রভাষায় যাকে বলে বাথরুম-তার মধ্যে ঢুকে বসে আছে। আর বেরুতেই চায় না। শেষে দরজায় দমাদম ঘুষি চালাতে লাগল ক্যাবলা।
—শিকারে যাওয়ার আগেই কি অজ্ঞান হয়ে গেলে নাকি টেনিদা? যদি সত্যিই অজ্ঞান হয়ে থাকো, দরজা খুলে দাও। আমরা তোমার নাকে স্মেলিং সল লাগিয়ে দিচ্ছি।
এর পরে কোনও ভদ্রলোকই অজ্ঞান হয়ে থাকতে পারে না। রেগেমেগে দরজা খুলে বেরিয়ে এল টেনিদা।
-টেক কেয়ার ক্যাবলাকে বলে আমি অজ্ঞান হয়েছি? কেবল পেটটা একটু চিন-চিন করছিল—
কুট্টিমামার হাঁক শোনা গেল : কী হল টেনি–রেডি?
হাবুল বললে, টেনিদার প্যাট চিন-চিন করে।
আমি বললুম, মাথা ঝিন-ঝিন করে—
ক্যাবলা বললে, বাঘ দেখার আগেই প্রাণ টিন-টিন করে।
টেনিদা ঘুষি বাগিয়ে ক্যাবলাকে তাড়া করলে–ক্যাবলা পালিয়ে বাঁচল।
হাঁড়ির মতো মুখ করে টেনিদা বললে, ভাবছিস আমি ভিতু? আচ্ছা—চল শিকারে। পটলডাঙার এই টেনি শর্মা কাউকে কেয়ার করে না! বাঘ-ফাগ যা সামনে আসবে—স্রেফ হাঁড়িকাবাব করে খেয়ে নেব দেখে নিস!