—তারপরে?
–জানালায় একটা গর আওয়াজ। তাকিয়ে দেখি—
বলতে বলতে আমি থেমে গেলুম। বুকের ভেতর দুরুদুরু করে উঠল।
–কী দেখলে?
–প্রথমে একটা বাচ্চা বড়সড় বেড়ালের মতো দেখতে। তারপরে আর একটা। জালার মতো মাথা-ভাঁটার মতো চোখ, কাঁটার মতো গোঁফ–
ক্যাবলা বললে, ধামার মতো পিলে—
টেনিদা বললে, শিঙিমাছের মতো শিং—
হাবুল জুড়ে দিলে, আর পটোলের মতন দাঁত–
বুঝতে পারছ তো? আমার সেই পালা-জ্বরের পিলে আর পটোল দিয়ে শিঙিমাছের ঝোলকে ঠাট্টা করা হচ্ছে।
শুনে কুট্টিমামা পর্যন্ত মুচকে মুচকে হাসলেন, আর খৌয়া—খৌ-খেী বলে আবার নাচতে শুরু করে দিলে ছোট্টুলাল।
ভাবছি ছোট্টুলালকে এবার সত্যিই ঘ্যাঁচ করে একখানা ল্যাং মেরে দেব যা থাকে কপালে, এমন সময় টেনিদা বললে, না কুট্টিমামা, প্যালাকে আর এখানে রাখতে ভরসা হচ্ছে না!
ক্যাবলা বললে, ঠিক। বাঘের কথা শুনেই যেমন করছে, তাতে তো—
হাবুল বললে, বাঘ একখান চক্ষের সামনে দেখলে ভয়েই মইরা যাইব নে।
টেনিদা বললে, কালই ওকে প্লেনে তুলে দেওয়া যাক।
ক্যাবলা বললে, বেয়ারিং পোস্টে।
হাবুল বললে একটা বস্তার মইধ্যে কইর্যা তুইল্যা দিলেই হইব—পয়সা লাগব না।
অপমানে আমার কান কটকট করতে লাগল, খালি মনে হতে লাগল নাকের ডগায়। কতগুলো উচ্চিংড়ে লাফাচ্ছে। কিন্তু এদের কোনও কথা বলে লাভ নেই—এরা বিশ্বাস করবে না। আমি রেগে গোঁজ হয়ে বসে রইলুম।
কুট্টিমামা বললেন, যাও–যাও, সব শুয়ে পড় এখন। আর রাত জেগে শরীর খারাপ করে লাভ নেই।
আমি শেষবার বলতে চেষ্টা করলুম : আপনারা বিশ্বাস করছেন না—
টেনিদা ভেংচি কেটে বললে, ঝা—যা খুব হয়েছে। আর ওস্তাদি করতে হবে না তোকে! রাক্ষসের মতো খাবি আর শেষে পেট-গরম হয়ে উমধুটুম স্বপ্ন দেখবি! দরজা-জানালা বন্ধ করে চুপচাপ শুয়ে পড়। কাল ভোরের প্লেনে যদি তোকে কলকাতায় চালান না করি তো
দাঁত বের করে আরও কী সব বলতে যাচ্ছিল, ঠিক এমনি সময় একটা বিকট হইহই চিৎকার। সেটা এল কুলি লাইনের দিক থেকে। তারপরেই জোর টিন-পেটানোর আওয়াজ।
আমরা সবাই ভীষণভাবে চমকে উঠলুম। সবচাইতে বেশি করে চমকালেন কুট্টিমামা।
—ও কী! ও আওয়াজ কেন?
চিৎকারটা আরও জোরালো হয়ে উঠল। আকাশ ফেটে যেতে লাগল টিন-পেটানোর শব্দে! তারপরেই কে একজন ছুটতে ছুটতে এসে বাইরে থেকে হাঁক পাড়ল : বাবু-ছোট ম্যানেজারবাবু–
ছোট্রলাল দরজা খুলে দিলে। দেখা গেল, লণ্ঠন হাতে কুলিদের একজন সর্দার।
কুট্টিমামা বললেন, কী হয়েছে রে? অমন চেঁচামেচি করছিস কেন?
–কুলি-লাইনে বাঘ এসেছিল বাবু!
বাঘ!
ঘরে যেন বাজ পড়ল। আর দেখি—সবাই যেন হাঁ করে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। আর ছোট্টলালের চোখ দুটো একেবারে গোল গোল হয়ে গেছে টিকিটা খাড়া হয়ে ওঠবার চেষ্টা করছে।
এইবারে জুত পেয়ে আমি বললুম, কেমন বাপু ছোট্টলাল—আভি খেয়া-খৌয়া করকে হাসছ না কেন?
কুলি-সর্দার বললে, একটা চিতা, সঙ্গে বাচ্চাও ছিল। একটা গোরুকে জখম করেছে আর একটা ছাগল মেরে নিয়ে পালিয়েছে।
কারও মুখে আর কথাটি নেই।
আর তক্ষুনি আমি ঘর কাঁপিয়ে হাসতে শুরু করলুম। সেই হাসির আওয়াজে টেনিদা লাফিয়ে হাবুলের ঘাড়ের উপর পড়ল হাবুল গিয়ে পড়ল ছোটুলালের গায়ে, আর—আঁই দাদা বলে চিৎকার ছেড়ে একেবারে চিৎপাত হল ছোট্টুলাল।
০৮. কুট্টিমামা বললেন
কুট্টিমামা বললেন, তাই তো! আবার চিতাবাঘের উৎপাত শুরু হল।
সর্দার বললে, ওদিকের জঙ্গলে বাঘ বড় বেড়ে গেছে বাবু। মাসখানেক ধরেই আশেপাশে ঘোরাঘুরি করছিল। এখন একেবারে বাগানে ঢুকে পড়েছে। আর আসতে যখন শুরু করেছে। তখন সহজে ছাড়বে না!
কুট্টিমামা মাথা নেড়ে বললেন, দু-একটা মারলে চলছে না। আচ্ছা, এখন যাও। দেখি কাল সকালে কী করা যায়।
সর্দার চলে গেল। কুট্টিমামা বললেন, তোমরাও সব শুয়ে পড় গে। আর প্যালারাম—এবার ভালো করে জানালা বন্ধ করে দিয়ো।
আমরা সব চুপচাপ চলে এলুম। হাবুলের বকবকানি, টেনিদার চালিয়াতি আর ফুট কাটা একদম বন্ধ। সব একেবারে স্পিকটি নট। আর ছোট্টলাল? সে তো তক্ষুনি—আঁই দাদা হো–বলে একটা কম্বল চাপা দিয়ে শুয়ে পড়েছে।
খড়খড়ি আর কাচের জানালা দুটোই বন্ধ করে দিতে যাচ্ছি, ক্যাবলা বললে, খড়খড়িটা খুলে রাখ না প্যালা! বাইরের প্রাকৃতিক দৃশ্য বেশ দেখা যাবে। কী সুন্দর চাঁদ উঠেছে রে!
আমি দাঁত-মুখ খুব বিচ্ছিরি করে বললুম, থাক—আর পাকিতিক দিরিশ্যি দেখে দরকার নেই! চাঁদের আলোয় খুশি হয়ে বাঘ এসে যদি জানালার বাইরে দাঁত খিঁচোয়?
—আমরাও বাঘকে ভেংচে দেব।
—আর যদি জানালা ভেঙে ঢোকে?
—আমরা দরজা ভেঙে পালিয়ে যাব!
দেখেছ ইয়ার্কিটা একবার! বাঘ যেন আমাদের পটলডাঙার একাদশী কুণ্ডু-পেছন থেকে হাঁড়ি ফাটল হাঁড়ি ফাটল বলে চেঁচিয়ে চটিয়ে দিলেই হল!
বললুম, বেশি ফেরেব্বাজি করিসনে ক্যাবলা, ঘুমোত বলে আমি দুটো জানালাই শক্ত করে এঁটে দিলুম। ঘুমোতে চেষ্টা করছি কিন্তু ঘুম কি ছাই আসে? খালি বন্ধ জানালায় চোখ পড়ছে। এই মনে হচ্ছে বাইরের খড়খড়ি কেউ কড়কড় করে আঁচড়াচ্ছে, আবার যেন শুনছি ঘাসের উপর দিয়ে কী সব হাঁটছে হুমহাম করে কী একটা ডেকেও উঠল। এদিকে আবার নাকের ডগায় দু-তিনটে মশা বিন-বিন করছে। ক্যাবলাটা তো দেখতে-না-দেখতেই ঘুমিয়ে পড়ল। আমি কী করি? মশারি একটা আছে—ফেলে দেব? কিন্তু মশারির ভেতরে আমি একদম শুতে পারি না—কেমন দম আটকে আসে।