আর সেই জ্বলন্ত খড়ের আঁটি নিয়ে সে এগিয়ে গেল ভালুকের দিকে।
আগুন দেখে ভালুক থমকে গেল। তারপর বীর বাহাদুর আর-এক পা সামনে বাড়াতেই সব বীরত্ব কোথায় উবে গেল তার! অতবড় পেল্লায় জানোয়ার চার পায়ে একেবারে চোঁ-চোঁ দৌড়–বোধহয় সোজা পাহাড়ে পৌঁছে তবে থামল।
কুট্টিমামার গল্প শুনে আমরা ভীষণ খুশি।
টেনিদা বললে, মামা, আমাদের কিন্তু শিকারে নিয়ে যেতে হবে।
কুট্টিমামা বললেন, যে-সব বীরপুরুষ, বাঘের ডাক শুনলেই—
হাবুল সেন বললে, না মামা, ভয় পামু না। আমরাও বাঘেরে ডাকতে থাকুম।
ডাইক্যা কমু—আইসো বাঘচন্দর, তোমার লগে দুইটা গল্পসল্প করি।
ক্যাবলা বললে, আর বাঘও অমনি হাবুলের পাশে বসে গলা জড়িয়ে ধরে গল্প আরম্ভ করে দেবে।
তখন আমি বললুম, আর মধ্যে-মধ্যে হাবলাকে আলুকাবলি আর কাজুবাদাম খেতে দেবে।
টেনিদা দাঁত খিঁচিয়ে বললে, কী যে বাজে বকবক করিস তোরা—একদম ভালো লাগে। হচ্ছে একটা দরকারি কথা-খামকা ফাজলামি জুড়ে দিয়েছে।
কুট্টিমামা হাই তুলে বললেন, আচ্ছা, সে হবে-এখন। এখন যাও শুয়ে পড় গে সবাই। কালকে ভাবা যাবে এসব।
টেনিদা, হাবুল আর কুট্টিমামা শুয়েছেন বড় ঘরে। এ-পাশের ছোট ঘরটায় আমি আর ক্যাবলা।
বিছানায় শুয়েই কুর-কুর করে ক্যাবলার নাক ডাকছে। কিন্তু অচেনা জায়গায় এত সহজেই আমার ঘুম আসে না। মাথার কাছে টিপয়ের উপর একটা ছোট্ট নীল টেবিল ল্যাম্প জ্বলছে। আমি ল্যাম্পটাকে একেবারে বালিশের পাশে টেনে আনলুম। তারপর সুটকেস খুলে শিবরামের নতুন হাসির বই জুতো নিয়ে জুতোজুতি আরাম করে পড়তে লেগে গেলুম।
পড়ছি আর নিজের মনে হাসছি। পাশেই খোলা জানালা দিয়ে মিঠে হাওয়া আসছে। দুধের মতো জ্যোৎস্নায় স্নান করছে চায়ের বাগান আর পাহাড়ের বন। কতক্ষণ সময় কেটেছে। জানি না। হাসতে হাসতে এক সময় মনে হল, জানালার গায়ে যেন খড়খড় করে আওয়াজ হচ্ছে।
তাকিয়ে দেখি, একটা বেশ বড়সড় বেড়াল। জানালার ওপর উঠে বসেছে—আর জ্বলজ্বল করে তাকাচ্ছে আমার দিকে।
বললুম, যাঃ—যাঃ—পালা—
পালাল না। বললে, গর্—র্—র্–
তখন আমার ভালো করে চোখে পড়ল।
শুধু একটা নয়—তার পাশে আর একটা বেড়াল। সেটার হাঁড়ির মতো প্রকাণ্ড মাথা—ভাঁটার মতো চোখ আর গায়ে ঘন হলদের ওপর কালো ফোঁটা।
এত বড় বেড়াল! আর, এ কেমন বেড়াল!
সেই প্রকাণ্ড বেড়ালটাও বললে, গর্—র্—র্–ঘুঁ!
আর ঘুঁ! আমি তৎক্ষণাৎ আকাশ-ফাটানো চিৎকার করলুম একটা। তারপর ক্যাবলাকে জড়িয়ে ধরে সোজা আছড়ে পড়লুম বিছানা থেকে। টেবিল ল্যাম্পটাও সেইসঙ্গে ভেঙে চুরমার।
আর সেই অথই অন্ধকারের ভেতর—
০৭. অন্ধকারে দুজনে
অন্ধকারে দুজনে কুমড়োর মতো গড়াগড়ি খেলুম কিছুক্ষণ। ক্যাবলা যতই বলে, ছাড়—ছাড়—আমি ততই গোঁ-গোঁ করতে থাকি : বা—বা–বা–
এর ভেতরে লণ্ঠন হাতে টেনিদা, হাবলা আর কুট্টিমামা এসে হাজির। ছোট্টুলালও সেইসঙ্গে।
–কী হল? কী হল?
—আরে ই ক্যা ভৈল বা?
ক্যাবলা তড়াক করে উঠে পড়ে বললে, দেখুন না কুট্টিমামা, ঘুমের ঘরে প্যালাটা আমাকে জাপটে ধরে খাট থেকে নীচে ফেলে দিলে। কিছুতেই ছাড়ে না। খালি বলছে : বা—বা–বা–
বা—বা–বা?—টেনিদা দাঁত খিঁচিয়ে বললে, তার মানে, বাঃ—বেশ মজার খেলা হচ্ছে! এই প্যালাটাকে নিয়ে সব সময় একা কেলেঙ্কারি হবে। ওর গাধার মতো লম্বা কান দুটোকে ইপের মতো পেঁচিয়ে দিলে তবে ঠিক হয়। এই প্যালা, এই গাড়লরাম উঠে পড় বলছি
আমি কি উঠি নাকি অত সহজে? ক্যাবলার পাশেই তো সেই একজোড়া বড় বেড়াল বসে আছে।
চোখ বুজেই বলি, ওই জা–জা–জা—
হাবুল বললে, কারে যাইতে কস? কেডা যাইব?
বললুম, জা—নালায়!
হাবুল বিচ্ছিরি চটে গেল। বললে, কী, আমি নালায় যামু? ক্যান, আমি নালায় যামু ক্যান? তর ইচ্ছা হইলে তুই যা–নালায় যা, নর্দমায় যা–-গোবরের গাদায় যা–
আমি তেমনি চোখ বুজে বললুম, দুত্তোর! জানালায় তা—তাকিয়ে দ্যাখো না একবার! বা–বাঘ বসে আছে ওখানে।
—অ্যাাঁ, জানালায় বাঘ! বলেই টেনিদা লাফ দিয়ে প্রায় হাবুলের ঘাড়ে গিয়ে পড়ল।
হাবুল বললে, ইঃ-খাইছে, খাইছে!
কুট্টিমামা হেসে উঠলেন।
–জানালায় বাঘ? এই বাগানের ভেতর? ঘুমের ঘোরে তুমি স্বপ্ন দেখেছ প্যালারাম।
ক্যবলা খিকখিক করে হাসতে লাগল, হাবুল খ্যাখ্যা করে হাসতে লাগল, টেনিদা খ্যাঁচর-খ্যাঁচর করে হেসে চলল। আর পেট চেপে ধরে খৌ-খৌ করে সবচেয়ে বেশি করে হাসতে লাগল ছোট্টুলাল।
—খৌ—খো—খৌ! আরে খৌ—খৌ-বাঘ কাঁহাসে আসবে! বাঘের মাসি এসেছিল হোবে— খৌ —খৌ—খৌ-! কী খুশি সবাই, আর কী হাসির ধুম! যেন আমাকে পাগল পেয়েছে ওরা!
রাগে গা জ্বলে গেল, আমি উঠে বসলুম।
–চলে গেছে কিনা, তাই সবাই হাসছে। যদি দেখতে—
টেনিদা বললে, আমিও তো দেখেছিলুম। এই একটু আগেই। দুটো গণ্ডার আর তিনটে জলহস্তী আমার দিকে তেড়ে আসছিল। আমি এক ঘুষিতে একটা গণ্ডারকে মেরে ফেললুম—দুই চড়ে দুটো জলহস্তী কাত হয়ে গেল। বাকি দুটো ল্যাজ তুলে পাঁই-পাঁই করে দৌড়ে পালাল। অবিশ্যি স্বপ্নে।
আবার হাসি। ছোট্টুলাল তো প্রায় নাচতে লাগল। আমার এত রাগ হল যে ইচ্ছে করতে লাগল ছোটুলালের ঠ্যাঙে ল্যাং মেরে মাটিতে ফেলে দিই কিংবা ওর কানের ভেতরে কতগুলো লাল পিঁপড়ে ঢেলে দিই।
কুট্টিমামা বললেন, থামো—থামো। সবটা ওকে বলতে দাও। আচ্ছা প্যালারাম, তুমি তো ঘুমুচ্ছিলে?
-মোটেই না। আমি শুয়ে শুয়ে গল্পের বই পড়ছিলুম।