- বইয়ের নামঃ চার মূর্তি
- লেখকের নামঃ নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়
- প্রকাশনাঃ আজকাল প্রকাশনী
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
০১. মেসোমশায়ের অট্টহাসি
স্কুল ফাইন্যাল পরীক্ষা শেষ হয়ে গেল।
চাটুজ্যেদের বোয়াকে আমাদের আড্ডা জমেছে। আমরা তিনজন আছি। সভাপতি টেনিদা, হাবুল সেন, আর আমি প্যালারাম বাঁড়ুজ্যে—পটলডাঙায় থাকি আর পটোল দিয়ে শিঙিমাছের ঝোল খাই। আমাদের চতুর্থ সদস্য ক্যাবলা এখনও এসে পৌঁছয়নি।
চারজনে পরীক্ষা দিয়েছি। লেখাপড়ায় ক্যাবলা সবচেয়ে ভালো—হেডমাস্টার বলেছেন। ও নাকি স্কলারশিপ পাবে। ঢাকাই বাঙাল হাবুল সেনটাও পেরিয়ে যাবে ফাস্ট ডিভিশনে। আমি দুবার অঙ্কের জন্যে ডিগবাজি খেয়েছি—এবার থার্ড ডিভিশনে পাশ করলেও করতে পারি। আর টেনিদা—
তার কথা না বলাই ভালো। সে ম্যাট্রিক দিয়েছে কে জানে এনট্রান্সও দিয়েছে কি না। এখন স্কুল ফাইন্যাল দিচ্ছে—এর পরে হয়তো হায়ার সেকেন্ডারিও দেবে। স্কুলের ক্লাস টেন-এ সে একেবারে মনুমেন্ট হয়ে বসে আছে—তাকে সেখান থেকে টেনে এক ইঞ্চি নড়ায় সাধ্য কার!
টেনিদা বলে, হেঁ—হেঁ–বুঝলিনে? ক্লাসে দু-একজন পুরনো লোক থাকা ভালো মানে, সব জানে-টানে আর কি! নতুন ছছাকরাদের একটু ম্যানেজ করা চাই তো!
তা নতুন ছেলেরা ম্যানেজ হচ্ছে বইকি। এমনকি টেনিদার দুদে বড়দা—যাঁর হাঁক শুনলে আমরা পালাতে পথ পাই না, তিনি সুষ্ঠু ম্যানেজড় হয়ে এসেছেন বলতে গেলে। তিন-চার বছর আগেও টেনিদার ফেলের খবর এলে চেঁচিয়ে হাট বাধাতেন, আর টেনিদার মগজে ক-আউন্স, গোবর আছে তাই নিয়ে গবেষণা করতেন। এখন তিনিও হাল ছেড়ে দিয়েছেন। টেনিদার ফেল করাটা তাঁর এমনি অভ্যাস হয়ে গেছে যে, হঠাৎ যদি পাশ করে ফেলে তা হলে সেইসঙ্গে তিনি একেবারে ফ্ল্যাট হয়ে পড়বেন।
অতএব নিশ্চিন্তে আড্ডা চলছে।
ওরই মধ্যে হতভাগ্য হাবুলটা একবার পরীক্ষার কথা তুলেছিল, টেনিদা নাক কুঁচকে বলেছিল, নেঃ—নেঃ—রেখে দে! পরীক্ষা-ফরীক্ষা সব জোচ্চুরি! কতকগুলো গাধা ছেলে গাদাগাদা বই মুখস্থ করে আর টকাটক পাশ করে যায়। পাশ না করতে পারাই সবচেয়ে শক্ত। দ্যাখ না বছরের পর বছর হলে গিয়ে বসছি, সব পেপারের অ্যাঁনসার লিখছি—তবু দ্যাখ কেউ আমাকে পাশ করাতে পারছে না। সব এগজামিনারকে ঠাণ্ডা করে দিয়েছি। বুঝলি, আসল বাহাদুরি এখানেই।
আমি বললাম, যা বলেছ। এইজন্যেই তো দুবছর তোমার শাগরেদি করছি। ছোটকাকা কান দুটো টেনে-টেনে প্রায় আধ-হাত লম্বা করে দিয়েছে—তবু ইস্কুল কামড়ে ঠিক বসে আছি!
টেনিদা বললে, চুপ কর, মেলা বকিসনি! তোর ওপরে আমার আশা-ভরসা ছিল—ভেবেছিলুম, আমার মনের মতো শিষ্য হতে পারবি তুই। কিন্তু দেখছি তুই এক-নম্বর বিশ্বাসঘাতক! কোন্ আক্কেলে অঙ্কের খাতায় ছত্রিশ নম্বর শুদ্ধ করে ফেললি? আর ফেললিই যদি, ঢ্যারা দিয়ে কেটে এলিনে কেন?
আমি ঘাড়-টাড় চুলকে বললাম, ভারি ভুল হয়ে গেছে!
টেনিদা বললে, দুনিয়াটাই নেমকহারাম! মরুক গে! কিন্তু এখন কী করা যায় বল দিকি? পরীক্ষার পর স্রেফ কলকাতায় বসে ভ্যারেন্ডা ভাজব? একটু বেড়াতে-টেড়াতে না গেলে কি ভালো লাগে?
আমি খুশি হয়ে বললাম, বেশ তো চলো না। লিলুয়ায় আমার রাঙা-পিসিমার বাড়ি আছে—দুদিন সেখানে বেশ হই-হল্লা করে—
-থাম বলছি প্যালা—থামলি?-টেনিদা দাঁত খিচিয়ে বললে, যেমন তোর ছাগলের। মতো লম্বা লম্বা কান, তেমনি ছাগলের মতো বুদ্ধি! লিলুয়া! আহা ভেবে-চিন্তে কী একখানা জায়গাই বের করলেন! তার চেয়ে হাতিবাগান বাজারে গেলে ক্ষতি কী? ছাতের ওপরে উঠে হাওয়া খেলেই বা ঠ্যাকাচ্ছে কে? যতসব পিলে রুগি নিয়ে পড়া গেছে, রামোঃ!
হাবুল সেন চিন্তা করে বললে, আর অ্যাঁকটা জায়গায় যাওন যায়। বর্ধমানে যাইবা? সেইখানে আমার বড়মামা হইল গিয়া পুলিশের ডি. এস. পি–
দুদ্দুর। সেই ধ্যাড়ধেড়ে বর্ধমান?–টেনিদা নাক কোঁচকাল : ট্রেনে চেপেছিস কি রক্ষে নেই বর্ধমানে যেতেই হবে। মানে, যে-গাড়িতেই চড়বি—ঠিক বর্ধমানে নিয়ে যাবে। সেই রেলের ঝকঝক আর পি পিঁ—প্ল্যাটফর্মে যেন রথের মেলা! তবে চাঁদির ওপরটা একবার চুলকে নিয়ে টেনিদা বললে—তবে হ্যাঁ-সীতাভোগ মিহিদানা পাওয়া যায় বটে। সেদিক থেকে বর্ধমানের প্রস্তাবটা বিবেচনা করা যেতে পারে বইকি। অন্তত লিলুয়ার চাইতে ঢের ভালো।
রাঙা-পিসিমার বাড়িকে অপমান! আমার ভারি রাগ হল।
বললাম, সে তো ভালোই হয়। তবে, বর্ধমানের মশার সাইজ প্রায় চড়ুই পাখির মতো, তাদের গোটাকয়েক মশারিতে ঢুকলে সীতাভোগ মিহিদানার মতো তোমাকেই ফলার করে ফেলবে। তা ছাড়া আমি বলে চললাম—আরও আছে। শুনলে তো, হাবুলের মামা ডি. এস. পি.। ওখানে যদি কারও সঙ্গে মারামারি বাধিয়েছ তা হলে আর কথা নেই সঙ্গে সঙ্গে হাজতে পুরে দেবে।
টেনিদা দমে গিয়ে বললে, যাঃ–যাঃ-মেলা বকিনি! কী রে হাবুল—তোর মামা কেমন লোক?
হাবুল ভেবে-টেবে বললে, তা, প্যালা নিতান্ত মিথ্যা কথা কয় নাই! আমার মামায় আবার মিলিটারিতে আছিল মিলিটারি মেজাজ
—এই সেরেছে! না—এ ঢাকার বাঙালটাকে নিয়ে পিরবার জো নেই! ওসব বিপজ্জনক মামার কাছে খামকা মরতে যাওয়া কেন? দিব্যি আছি-মিথ্যে ফ্যাচাঙের ভেতরে কে পড়তে চায় বাপু!
আলোচনাটা এ-পর্যন্ত এসেছে—হঠাৎ বেগে ক্যাবলার প্রবেশ। হাতে একঠোঙা আলুকাবলি।