প্ল্যান ছিল ঝিলের ধারে বিকেলে মন খুলে বেড়ানো যাবে, কিন্তু এখন যেন কেমন ছম-ছম করে উঠল শরীর। মনে পড়ে গেল, কলকাতার পথে পথে-বাড়িতে বাড়িতে এখন ঝলমলে আলো জ্বলে উঠেছে, ভিড় জমেছে সিনেমার সামনে। আর এখানে জমেছে কালো রাতক্রমাগত বেড়ে চলেছে ঝিঝির চিৎকার, একটা চাপা আতঙ্কের মতো কী যেন ছড়িয়ে যাচ্ছে আশেপাশে।
বারান্দায় বসে আমরা গল্প করার চেষ্টা করতে লাগলুম কিন্তু ঠিক জমতে চাইল না। ঝণ্টুরাম একটা লণ্ঠন জ্বেলে দিয়ে গেল সামনে, তাইতে চারিদিকের অন্ধকারটা কালো মনে হতে লাগল।
শেষ পর্যন্ত টেনিদা বললে, আয়, আমরা গান গাই।
ক্যাবলা বললে, সেটা মন্দ নয়। এসো-কোরাস ধরি।-বলেই চিৎকার করে আরম্ভ করলে—
আমরা ঘুচাব মা তোর কলিমা,
মানুষ আমরা নহি তো মেষ—
আর বলতে হল না। সঙ্গে সঙ্গেই আমরা তিনজনে গলা জুড়ে দিলুম। সে কী গান!
আমাদের চারজনের গলাই সমান চাঁছাছোলা—টেনিদার তো কথাই নেই। একবার টেনিদা নাকি অ্যাঁয়সা কীর্তন ধরেছিল যে তার প্রথম কলি শুনেই চাটুজ্যেদের পোষা কোকিলটা হার্টফেল করে। আমরা এমনই গান আরম্ভ করে দিলুম যে ঝণ্টুরাম পর্যন্ত ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে ছুটে এল।
আমরা সবাই বোধ হয় একটা কথাই ভাবছিলুম। ঝন্টিপাহাড়ের বাংলোতে যদি ভূত থাকে, তবুও এ-গান তাকে বেশিক্ষণ সইতে হবে না—আপনি ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে পালাবে এখান থেকে।
কিন্তু সেই রাত্রে–
আমি আর ক্যাবলা এক ঘরে শুয়েছি—পাশের ঘরে হাবুল সেন আর টেনিদা। একটা লণ্ঠন আমাদের ঘরে মিটিমিট করছে ঘরের চেয়ার টেবিল আয়নাগুলো কেমন অদ্ভুত মূর্তি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে যেন। ভয়টা আমার বুকের ভেতরে চেপে বসল। অনেকক্ষণ বিছানায় আমি এপাশ-ওপাশ করতে লাগলুম কান পেতে শুনলুম, টেনিদার নাকেসা রে গা মার সাতটা সুর বাজছে। কাচের জানালা দিয়ে দেখলুম বাইরে কালো পাহাড়ের মাথায় একরাশ জ্বলজ্বলে তারা। তারপর কখন যেন ঘুমিয়ে গেছি।
হঠাৎ খুট—খুট—খটা–খটাৎ–
চমকে জেগে উঠলাম। কে যেন হাঁটছে।
কোথায়?
এই ঘরের মধ্যেই। যেন পায়ে বুট পরে কে চলে বেড়াচ্ছে ঘরের ভেতর। হাত বাড়িয়ে লণ্ঠনটা বাড়িয়ে দিলুম। না—ঘরে তো কিছু নেই! তবু সেই জুতোর আওয়াজ। কেউ হাঁটছে—নির্ঘাত হাঁটছে! খুট-খুট–খটাত-খটাত–
আমি চেঁচিয়ে উঠলাম : ক্যাবলা!
ক্যাবলা লাফিয়ে উঠল : কী–কী হয়েছে?
-কে যেন হাঁটছে ঘরের ভেতর?
কী গোঁয়ার-গোবিন্দ এই পুঁচকে ক্যাবলা! তক্ষুনি তড়াক করে নেমে পড়ল মেঝেতে। আর সঙ্গে সঙ্গেই একটা ইঁদুর দুড়দুড় করে দরজার চৌকাটের গর্ত দিয়ে বাইরে দৌড়ে পালাল।
ক্যাবলা হেসে উঠল।
–তুই কী ভিতু রে প্যালা! একটা পুরোনো ঘেঁড়া জুতোর মধ্যে ঢুকে ইঁদুরটা নড়ছিল—তাই এই আওয়াজ। এতেই এত ভয় পেলি!
শুনেই আমি বীরদর্পে বললুম—যাঃ—যাঃ—আমি সত্যিই ভয় পেয়েছি নাকি!–বেশ ডাঁটের মাথায় বললুম, ইঁদুর তো ছার–সাক্ষাৎ ব্ৰহ্মদত্যি যদি আসে–
কিন্তু মুখের কথা মুখেই থেকে গেল আমার। সেই মুহূর্তেই কোথা থেকে জেগে উঠল এক প্রচণ্ড অমানুষিক আর্তনাদ। সে-গলা মানুষের নয়। তারপরেই আর-একটা বিকট অট্টহাসি। সে-হাসির কোনও তুলনা হয় না। মনে হল, পাতালের অন্ধকার থেকে তা উঠে আসছে, আর তার শব্দে ঝন্টিপাহাড়ির বাংলোটা থর-থর করে কেঁপে উঠছে!
০৬. রোমাঞ্চকর রাত
সে-ভয়ঙ্কর হাসির শব্দটা যখন থামল, তখনও মনে হতে লাগল ঝন্টিপাহাড়ির ডাকবাংলোটা ভয়ে একটানা কেঁপে চলেছে। আমি বিদ্যুৎবেগে আবার চাদরের তলায় ঢুকে পড়েছি, সাহসী ক্যাবলাও এক লাফে উঠে গেছে তার বিছানায়। আমার হাত-পা হিম হয়ে এসেছে—দাঁতে-দাঁতে ঠকঠকানি শুরু হয়েছে। যতদূর বুঝতে পারছি, ক্যাবলার অবস্থাও বিশেষ সুবিধের নয়।
প্রায় দশ মিনিট।
তারপর ক্যাবলাই সাহস ফিরে পেল। শুকনো গলায় বললে, ব্যাপার কী রে প্যালা?
চাদরের তলা থেকেই আমি বললাম, ভু–ভূ-ভূত!
ক্যাবলা উঠে বসেছে। আমি চাদরের তলা থেকে মিটমিট করে ওকে দেখতে লাগলাম।
ক্যাবলা বললে, কিন্তু কথা হল, ভূত এখানে খামকা হাসতে যাবে কেন?
ভুতুড়ে বাড়িতে ভূত হাসবে না তো হাসবে কোথায়? তারও তো হাসবার একটা জায়গা চাই। আমি বলতে চেষ্টা করলুম।
ক্যাবলা মাথা চুলকে বললে, তাই বলে মাঝরাতে অমন করে হাসতে যাবে কেন? লোকের ঘুম নষ্ট করে অমন বিটকেল আওয়াজ ঝাড়বার মানে কী?
আমি বললুম, ভূত তো মাঝরাতেই হাসে। নইলে কি দুপুরবেলা কলকাতার কলেজ স্কোয়ারে বসে হাসবে নাকি?
ক্যাবলা বললে, তাই তো উচিত! তাহলে অন্তত ভূতের সঙ্গে একটা মোকাবিলা হয়ে যায়। তা নয়, সময় নেই অসময় নেই, যেন ‘হাহা’ শব্দরূপ আউড়ে গেল–হাহা-হাহৌ-হাহাঃ! আচ্ছা প্যালা, ভূতদের যখন-তখন এরকম যাচ্ছেতাই হাসি পায়। কেন বল দিকি?
আমি চটে গিয়ে বললুম, তার আমি কী জানি! তোর ইচ্ছে হয় ভূতের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করে আয় না।
ক্যাবলা আবার চুপ করে নেমে পড়ল খাট থেকে। বললে, তাই চল না প্যালা—ভূতের চেহারাটা একবার দেখেই আসিগে! সেইসঙ্গে একথাও বলে আসি যে আপাতত এবাড়িতে চারটি ভদ্রলোকের ছেলে এসে আস্তানা নিয়েছে। এখন রাত দুপুরে ওরকম বিটকেল হাসি হেসে তাদের ঘুমের ব্যাঘাত করা নিতান্ত অন্যায়।
বলে কী ক্যাবলা! আমার চুল খাড়া হয়ে উঠল।
-খেপেছিস নাকি তুই?
—খেপব কেন? বুকের পাটা আছে বটে ক্যাবলার! একটুখানি হেসে বললে, আমার কী মনে হয় জানিস? ভূতও মানুষকে ভয় পায়।