আমি তখন আধ মাইল রাস্তা পার হয়ে গেছি ক্যাবলা গাছের মগডালে। হাবুল সমানে বলে চলেছে : ভূত আমার পুত, শাকচুন্নি আমার ঝি! টেনিদা তখনও গোবরের মধ্যেই ঠায় বসে আছে। ভিরমিই গেছে কি না কে জানে।
মূর্তিটা আবার বললে, কুছ ডর নেই খোঁকাবাবু, কুছ ডর নেই। আমি হচ্ছি ঝষ্টিপাহাড়ির ঝণ্টুরাম—আপনাদের নোকর—
০৫. চলমান জুতো
কী যে বিতিকিচ্ছিরি ঝামেলা! ভূত নয়—তবু কেমন ভূতের ভয় ধরিয়ে দিলে হতচ্ছাড়া ঝণ্টুরাম! আধ ঘণ্টা ধরে বুকের কাঁপুনি আর থামতেই চায় না!গোবর-টোবর মেখে টেনিদা উঠে দাঁড়াল। গোটাকয়েক অ্যাঁয়সা অ্যাঁয়সা কাঠ-পিঁপড়ের কামড় খেয়ে প্রাণপণে পা চুলকোতে চুলকোতে নামল ক্যাবলা। হাবুলের হাঁটু দুটো থেকে-থেকে ধাক্কা খেতে লাগল। আর মাইলখানেক বাঁই বাঁই করে দৌড়োনোর ফলে আমার পালা-জ্বরের পিলেটা পেট খুঁড়ে বেরিয়ে আসতে চাইল।
টেনিদাই সামলে নিলে সক্কলের আগে।
–ঝণ্টুরাম? দাঁত খিচিয়ে টেনিদা বললে, তা অমন ভূতের মতো চেহারা কেন?
-কী করব খোঁকাবাবু, ভগবান বানিয়েছেন।
–ভগবান বানিয়েছেন—ছোঃ!—টেনিদা ভেংচি কাটাল : ভগবানের আর খেয়েদেয়ে কাজ ছিল না! ভগবানের হাতের কাজ এত বাজে নয়—তোকে ভূতে বানিয়েছে, বুঝলি?
—হাঃ!–ঝণ্টুরাম আপত্তিও করলে না।।
এবার ক্যাবলা এগিয়ে এল : তা, এই ঝোপের মধ্যে ঢুকে বসেছিলি কেন? ঝণ্টুরাম কতকগুলো এলোমেলো দাঁত বের করে বললে, কী করব দাদাবাবু-ইস্টিশনে তো যাচ্ছিলাম। তা, পথের মধ্যে ভারি নিদ এসে গেল, ভাবলম একটু ঘুমিয়ে নিই। অ ঘুমাচ্ছি তো ঘুমাচ্ছি, শেষে নাকের ভেতরে দু-তিনটে মচ্ছর (মশা) ঘুসে গেল। উঠে দেখি, আপনারা আসছেন। আমি আপনাদের কাছে এলম তো আপনারা ডর খেয়ে অ্যাঁয়সা কারবার করলেন–
বলেই, খ্যাঁক-খ্যাঁক খিকখিক করে লোকটা ভুতুড়ে হাসি হাসতে আরম্ভ করে দিলে।
ক্যাবলা বললে, খুব হয়েছে, আর হাসতে হবে না! দাঁত তো নয়—যেন মুলোর দোকান খুলে বসেছে মুখের ভেতর! চল—চল এখন শিগগির, পথ দেখিয়ে নিয়ে চল ঝন্টিপাহাড়িতে—
সত্যি, চমৎকার জায়গা এই ঝন্টিপাহাড়ি! নামটা যতই বিচ্ছিরি হোক—এখানে পা দিলেই গা যেন জুড়িয়ে যায়। তিনদিকে পাহাড়ের গায়ে শাল-পলাশের বনপলাশ ফুল ফুটে তাতে যেন লাল আগুন জ্বলছে। নানারকমের পাখি উড়ে বেড়াচ্ছে কত যে রঙের বাহার তাদের গায়ে! সামনে একটা ঝিল—তার নীল জল টলমল করছে দুটো-চারটে কলমিলতা কাঁপছে, তার ওপর আবার থেকে-থেকে কেউটে সাপের ফণার মতো গলা-তোলা পানকৌড়ি টপাটপ করে ড়ুব দিচ্ছে তার ভেতরে।
ঝিলের কাছেই একটা টিলার ওপর তিনদিকে বনের মাঝখানে মেসোমশায়ের বাংলো। লাল ইটের গাঁথুনি-সবুজ দরজা জানালালাল টালির চাল। হঠাৎ মনে হয় এখানেও যেন একরাশ পলাশ ফুল জড়ো হয়ে রয়েছে আর দুটো-চারটে সবুজ পাতা উঁকি দিচ্ছে তাদের ভেতরে।
এমন সুন্দর জায়গা—এমন মিষ্টি হাওয়া—এমন ছবির মতো বাড়ি—এখানে ভূতের ভয়! রাম রাম! হতেই পারে না!
বাংলোর ঘরগুলোও চমত্তার সাজানো। টেবিল, চেয়ার, ডেক-চেয়ার, আয়না, আলনাকত কী? খাটো মোটা জাজিম। আমরা পৌঁছনোর সঙ্গে সঙ্গেই ঝণ্টুরাম দুখানা ঘরের চারখানা খাটে চমৎকার করে বিছানা পেতে দিলে। বাংলোর বারান্দায় বেতের চেয়ারে আমরা আরাম করে বসলুম। ঝণ্টুরাম ডিমের ওমলেট আর চা এনে দিলে। তারপর জানতে চাইল : খোকাবাবুরা কী খাবেন দুপুরে? মাছ, না মুরগি?
-মুরগি-মুরগি!—আমরা কোরাসে চিৎকার করে উঠলাম।
টেনিদা একবার উস করে জিভের জল টানল : আর হ্যাঁচটপট পাকিয়ে ফেলোবুঝলে? এখন বেলা বারোটা বাজে—পেটে ব্রহ্মা খাই-খাই করছেন। আর বেশি দেরি হলে চেয়ার-টেবিলই খেতে আরম্ভ করব বলে দিচ্ছি!
–হঃ, তুমি তা পারবা। হাবুল সেন ঠুকে দিলে।
–কী কী বললি হাবুল?
—না না—আমি কিছু কই নাই।—হাবুল সামলে দিলে, কইতেছিলাম ঝণ্টু খুব তাড়াতাড়ি রাঁধতে পারবে।
ঝণ্টুরাম চলে গেল। টেনিদা বললে, চেহারাটা যাচ্ছেতাই হলে কী হয় ঝণ্টুরাম লোকটা খুব ভালোনা রে?
আমি বললাম, হ্যাঁ, যত্ন-আত্তি আছে। রোজ যদি মুরগি-টুরগি খাওয়ায় সাতদিনে আমরা লাল হয়ে উঠব।
টেনিদা চোখ পাকিয়ে বললে, আর লাল হয়ে কাজ নেই তোর! পালা-জ্বরে ভুগিস, বাসক পাতার রস দিয়ে কবরেজি বড়ি খাস, তোর এসব বেশি সইবে না। কাল থেকে তোর জন্যে কাঁচকলা আর গাঁদালের ঝোল বরাদ্দ করে দেব। বিদেশে-বিভুঁয়ে এসে যদি পটাৎ করে পটল তুলি, তাহলে সে ম্যাও সামলাবে কে—শুনি?
আমি ব্যাজার হয়ে বললুম, আচ্ছা আচ্ছা, সেজন্যে তোমায় ভাবতে হবে না! গাঁদালের ঝোল খেতে বয়ে গেছে আমার! মরি তো মুরগি খেয়েই মরব!
—আর পরজন্মে মুরগি হয়ে জন্মাবি। ডাকবি, কঁকঁ—কোঁকোর—কোঁ ইস্টুপিড ক্যাবলাটা বদসিকতা করলে। আমি বেদম চটে বসে বসে নাক চুলকোতে লাগলাম।
খেতে খেতে দুটো বাজল। আহা, ঝণ্টুর রান্না তো নয়—যেন অমৃত! পেটে পড়তে পড়তেই যেন ঘুম জড়িয়ে এল চোখে। রাত্রে ট্রেনের ধকলও লেগেছিল কম নয়নরম বিছানায় এসে গা ঢালতেই আমাদের মাঝ রাত্তির।
বিকেলের চা নিয়ে এসে ঝণ্টুরাম যখন আমাদের ডেকে তুলল, পাহাড়ের ওপারে তখন সূর্য ড়ুবে গেছে। শাল-পলাশের বন কালো হয়ে এসেছে, শিসের মতো রঙ ধরেছে ঝিলের জলে। দুপুরবেলা চারিদিকের যে মন-মাতানো রূপ চোখ ভুলিয়েছিল, এখন তা কেমন থমথমে হয়ে উঠেছে। ঝাঁ ঝাঁ করে ঝিঝির ডাক উঠেছে ঝোপঝাড় আর বাংলোর পেছনের বন থেকে।