—সেজন্যে ভাববেন না প্রভু, ঘাটশিলাতেই উঠিয়ে দেব আপনাকে।-ক্যাবলা আশ্বাস দিলে।
–না–না বৎস, অত তাড়াতাড়ি জাগাবার দরকার নেই। ঘাটশিলায় মাঝরাত।
—তাহলে টাটানগরে?
—সেটা শেষরাত, বৎস—অজ ব্যস্ত হয়ো না। মুরিতে উঠিয়ে দিলেই চলবে। টেনিদা বললে, আচ্ছা তাই দেব। এবার আপনি যোগনিদ্রায় শুয়ে পড়তে পারেন।
—তা পারি। ঘুটঘুটানন্দ এবার চারিদিকে তাকালেন : কিন্তু শোব কোথায়? চারজনে। তো চারটে নীচের বেঞ্চি দখল করে বসেছ। আমি সন্ন্যাসী মানুষবাঙ্কে উঠলে যোগনিদ্রার ব্যাঘাত হবে।
টেনিদা বললে, আপনি উঠবেন কেন প্রভু—প্যালা বাঙ্কে শোবে। ও ব্যাঙ্কে শুতে ভীষণ ভালবাসে।
দ্যাখো তো কী অন্যায়! বাঙ্কে ওঠা আমি একদম পছন্দ করি না, খালি মনে হয় কখন ছিটকে পড়ে যাব—আর টেনিদা কিনা আমাকেই
আমি বললাম, কক্ষনো নাবাঙ্কে শুতে আমি মোটেই ভালোবাসি না! টেনিদা চোখ পাকাল।
—দ্যাখ প্যালা—সাধু-সন্নিসি নিয়ে ফাজলামো করিসনি–নরকে যাবি! প্রভু, আপনি প্যালার বিছানা ফেলে দিয়ে ওইখানেই লম্বা হোন—প্যালা যেখানে তোক শশাবে।
—আহা, বেঁচে থাকো বৎস বলে ঘুটঘুটানন্দ আমার বিছানা ওপরে তুলে দিয়ে নিজের বিছানাটা পাতলেন। আমি জুলজুল করে চেয়ে রইলাম।
তারপর শোয়ার আগে সেই সন্দেহজনক হাঁড়িটি নিজের বেঞ্চির তলায় টেনে নিলেন। টেনিদা অনেকক্ষণ লক্ষ করছিল, জিজ্ঞেস করল, হাঁড়িতে কী আছে প্রভু?
শুনেই ঘুটঘুটানন্দ চমকে উঠলেন; হাঁড়িতে? হাঁড়িতে বড় ভয়ঙ্কর জিনিস আছে বৎস! যোগসৰ্প!
—যোগসৰ্প?—হাবুল বললে, সেইটা আবার কী প্রভু?
ঘুটঘুটানন্দ চোখ কপালে তুলে বললেন, সে বড় সাংঘাতিক ব্যাপার! ভীষণ সমস্ত বিষধর সাপ-তপস্যাবলে আমি তাদের বন্দি করে রেখেছি। তারা দুধকলা খায় আর হরিনাম করে।
–সাপে হরিনাম করে!—আমি জিজ্ঞাসা না করে থাকতে পারলুম না।
-তপস্যায় সব হয় বৎস! ঘুটঘটানন্দ হাসলেন : তা বলে তোমরা ওর ধারেকাছে যেও! যোগবল না থাকলে বোঁ করে ছোবল মেরে দেবে। সাবধান!
–আজ্ঞে আমরা খুব সাবধানে থাকব-টেনিদা গোবেচারির মতো বললে।
ঘুটাঘুটানন্দ আর-একবার সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে আমাদের দিকে তাকালেন। বললেন, হ্যাঁ, খুব সাবধান! ওই হাঁড়ির দিকে ভুলেও তাকিও না। তাহলে আমি নিশ্চিন্ত হয়ে শুয়ে পড়ি?
–পড়ুন।
তারপর পাঁচ মিনিট কাটল না। ঘর-ঘ-ঘরাৎ করে ঘুটঘুটানন্দের নাক ডাকতে লাগল।
বাঙ্কের উপরে দুলুনি খেতে খেতে আমি কখন ঘুমিয়ে পড়েছি মনে নেই। হঠাৎ কার যেন খোঁচা খেয়ে ঘুম ভেঙে গেল। দেখি, টেনিদা, আমার পাঁজরায় সুড়সুড়ি দিচ্ছে।
—নেমে আয় না গাধাটা। সাধুবাবা জেগে উঠলে তখন লবডঙ্কা পাবি।
চেয়ে দেখি, টেনিদার বিছানার ওপর যোগসর্পের হাঁড়ি। আর তার ঢাকনা খুলে ক্যাবলা আর হাবুল সেন পটাপট রসগোল্লা আর লেডিকেনি সাবড়ে দিচ্ছে।
টেনিদা আবার ফিসফিসিয়ে বললে, হাঁ করে দেখছিস কী? নেমে আয় শিগগির। যোগসপের হাঁড়ি শেষ করে আবার তো মুখ বেঁধে রাখতে হবে।
আর বলবার দরকার ছিল না। একলাফে নেমে পড়লুম এবং এক থাবায় দুটো লেডিকেনি তুলে ফেললুম।
টেনিদা এগিয়ে এসে বললে, দাঁড়া দাঁড়া—সবগুলো মেরে দিসনি! দুটো-একটা আমার জন্যেও রাখিস।
ট্রেন টাটানগর ছেড়ে আবার অন্ধকারে ঝাঁপ দিয়ে পড়ল। স্বামী ঘুটঘুটানন্দের নাক সমানে ডেকে চলল : ঘরাৎ-ফোঁ—ফর্র্ ফোঁ-ফুরুৎ–ফুর্র্–
চারজনে মিলে যেভাবে আমরা স্বামী ঘুটঘুটানন্দের হাঁড়ির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিলুম, তাতে সেটা চিচিং ফাঁক হতে পাঁচ মিনিট সময় লাগল না। অর্ধেকের ওপর টেনিদা সাবড়ে দিলে বাকিটা আমি আর হাবুল সেন ম্যানেজ করে নিলুম। বয়েসে ছোট ক্যাবলাই বিশেষ জুত করতে পারল না। গোটা-দুই লেডিকেনি খেয়ে শেষে হাত চাটতে লাগল।
টেনিদা তবু হাঁড়িটাকে ছাড়ে না। শেষকালে মুখের ওপর তুলে চোঁ করে রসটা পর্যন্ত নিকেশ করে দিলে। তারপর নাক-টাক কুঁচকে বললে, দুত্তোর, গোটাকয়েক ডেয়ো পিঁপড়েও খেয়ে ফেললুম রে! জ্যান্তও ছিল দু-তিনটে! পেটের ভেতরে গিয়ে কামড়াবে না তো?
হাবুল বললে, কামড়াইতেও পারে।
কামড়াক গে, বয়ে গেল! একবার ভীমরুল-সুদ্ধ একটা জামরুল খেয়ে ফেলেছিলুম, তা সে-ই যখন কিছু করতে পারলে না, তখন কটা পিঁপড়েতে আর কী করবে!
—ইচ্ছে করলে গোটাকয়েক বাঘ-সুদ্ধ সুন্দরবন পর্যন্ত তুমি খেয়ে ফেলতে পারো—তোমাকে ঠেকাচ্ছে কে!—হাত চাটা শেষ করে একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলল ক্যাবলা।
এর মধ্যে স্বামী ঘুটঘটানন্দের নাক সমানেই ডেকে চলছিল। যোগসিদ্ধ নাক কিনা—সেনাকের ডাকবার কায়দাই আলাদা। ঘ-ঘোঁ-ঘুরৎ!
টেনিদা বললে, যতই ঘুরুৎ-ঘুরুৎ করো না কেন—তোমার হাঁড়ি ফুড়ৎ! চালাকি পেয়েছে। কাঁধের ওপর দেড়মনি বিছানা ফেলে দেওয়া। ঘাড়টা টনটন করছে এখনও। প্রতিশোধ ভালোই নেওয়া হয়েছে কী বলিস প্যালা?
আমি বললুম, প্রতিশোধ বলে প্রতিশোধ! একেবারে নির্মম প্রতিশোধ!
যোগসর্পের শূন্য হাঁড়িটার মুখ টেনিদা বেশ করে বাঁধল। তারপর বিছানায় লম্বা হয়ে পড়ে বললে, এবার একটু ঘুমোনো যাক। পেটের জ্বলুনিটা এতক্ষণে একটু কমেছে।
আমার আর হাবুলেরও তাতে সন্দেহ ছিল না। কেবল ক্যাবলাই গজগজ করতে লাগল : তোমরাই সব খেয়ে নিলে, আমি কিছু পেলুম না!
টেনিদা বললে, যা যা, মেলা বকিসনি। ছেলেমানুষ, বেশি খেয়ে শেষে কি অসুখে পড়বি? নে, চুপচাপ ঘুমো–
ক্যাবলা ঘুমোলো কি না কে জানে, কিন্তু টেনিদার ঘুমোতে দু-মিনিটও লাগল না। স্বামীজীর, নাক বললে, ঘুরুৎ—টেনিদার নাক সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিলে, ফুড়ৎ। এই উত্তর-প্রত্যুত্তর কতক্ষণ চলল জানি না—মুখের ওপর থেকে দেওয়ালি পোকা তাড়াতে আমিও ঘুমিয়ে পড়লুম।
০৩. কলার খোসা
মুরি। মুরি জংশন।