টেনিদা বললে, ছোঃ! ওসব বাজে কথা! ভূত-টুত বলে কিছু নেই মেসোমশাই। আমরা চারজনেই যাব। ভূত যদি থাকেই, তাহলে তাকে একেবারে রাঁচির পাগলাগারদে পাঠিয়ে দিয়ে তবে ফিরে আসব কলকাতায়। আর
কিন্তু তারপরেই আর কিছু বলতে পারল না টেনিদা হঠাৎ থমকে গিয়ে দুহাতে হারুল সেনকে প্রাণপণে জাপটে ধরল।
হাবুল ঘাবড়ে গিয়ে বললে, আহা-হা কর কী, ছাইড়্যা দাও, ছাইড়া দাও! গলা পর্যন্ত খাইছি, প্যাটটা ফ্যাইটা যাইব যে!
টেনিদা তবু ছাড়ে না। আরও শক্ত করে হাবুলকে জাপটে ধরে বললে, ও কী—ও কীবাড়ির ছাতে ও কী!
আকাশে চাঁদটা ঢাকা পড়েছে একফালি কালো মেঘের আড়ালে। চারিদিকে একটা অদ্ভুত অন্ধকার। আর সেই অন্ধকারে পাশের বাড়িতে ছাতে কার যেন দুটো অমানুষিক চোখ দপদপ করে জ্বলছে।
আর সেই মুহূর্তে ক্যাবলার মেসোমশাই আকাশ ফাটিয়ে প্রচণ্ড অট্টহাসি করে উঠলেন। সে-হাসিতে আমার কান বোঁ-বোঁ করে উঠল, পেটের মধ্যে খটখটিয়ে নড়ে উঠল পালাজ্বরের পিলে—মনে হল মুরগি-টুরগিগুলো বুঝি পেট-ফেট চিরে কঁক করতে করতে বেরিয়ে আসবে।
এমন বিরাট কিস্তুত অট্টহাসি জীবনে আর কখনও শুনিনি।
০২. যোগ-সর্পের হাঁড়ি
একে তো ক্যাবলার মেসোমশাইয়ের ওই উকট অট্টহাসি—তারপর আবার পাশের বাড়ির ছাতে দুটো আগুন-মাখা চোখ! জয় মা কালী বলে সিঁড়ির দিকে ছুট লাগাব ভাবছি, এমন সময় মিয়াঁও-মিয়াঁও—মিয়াঁও
সেই জ্বলন্ত চোখের মালিক এক লাফে ছাতের পাঁচিলে উঠে পড়ল, তারপর আর-এক লাফে আর-এক বাড়ির কার্নিশে।
পৈশাচিক অট্টহাসিটা থামিয়ে মেসোমশাই বললেন, একটা হুলো-বেড়াল দেখেই চোখ কপালে উঠল, তোমরা যাবে সেই ডাক বাংলোয়!—ভেংচি কাটার মতো করে আবার খানিকটা খ্যাঁকঘেঁকে হাসি হাসলেন ভদ্রলোক :বীর কী আর গাছে ফলে!
আমাদের ভেতর ক্যাবলাটা বোধহয় ভয়-টয় বিশেষ পায়নি—এক নম্বরের বিচ্ছু ছেলে। তাই সঙ্গে সঙ্গেই বললে, না—পটোলের মতো পটলডাঙায় ফলে।
টেনিদার কাছ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে হাবুল হাঁসফাঁস করে বললে, কিংবা ঢ্যাঁড়সের মতন গাছের ওপর ফলে।
এবার আমাকেও কিছু বলতে হল : কিংবা চালের ওপর চালকুমড়োর মতো ফলে।
টেনিদা দম নিচ্ছিল এতক্ষণ, এবার দাঁত খিঁচিয়ে উঠল,—থাম থাম সব বাজে বকিসনি! সত্যি বলছি মেসোমশাই ইয়ে—আমরা একদম ভয় পাইনি। এই প্যালাটা বেজায় ভিতু কিনা, তাই ওকে একটু ঠাট্টা করছিলাম।
বা রে, মজা মন্দ নয় তো! শেষকালে আমার ঘাড়েই চালাবার চেষ্টা। আমার ভীষণ রাগ হল। আমি ছাগলের মতো মুখ করে বললাম, না মেসোমশাই, আমি মোটে ভয় পাইনি। টেনিদার দাঁতকপাটি লেগে যাচ্ছিল কিনা, তাই চেঁচিয়ে ওকে সাহস দিচ্ছিলাম।
—ইঃ, সাহস দিচ্ছিল। ওরে আমার পাকা পালোয়ান রে!—টেনিদা নাক-টাক কুঁচকে মুখটাকে আমের মোরব্বার মতো করে বললে, দ্যাখ প্যালা, বেশি জ্যাঠামি করবি তো এক। চড়ে তোর কান দুটোকে কানপুরে পাঠিয়ে দেব!
মেসোমশাই বললেন, আচ্ছা থাক, থাক। তোমরা যে বীরপুরুষ এখন তা বেশ বুঝতে পারছি। কিন্তু আসল কথা হোক। তোমরা কি সত্যিই ঝন্টিপাহাড়ে যেতে চাও?
ঝন্টিপাহাড়! সে আবার কোথায়? যা-বাব্বা, সেখানে মরতে যাব কেন?—টেনিদা চটাং করে বলে ফেলল।
মেসোমশাই বললেন, কী আশ্চর্য—এক্ষুনি তো সেখানে যাওয়ার কথা হচ্ছিল।
-তাই নাকি?—টেনিদা মাথা চুলকে বললে, বুঝতে পারিনি। তবে কিনাঝন্টিপাহাড় নামটা, কী বলে ইয়ে—তেমন ভালো নয়।
হাবুল বললে, হ, বড়ই বদখত।
আমি বললাম, শুনলেই মনে হয় ব্রহ্মদৈত্য আছে।
মেসোমশাই আবার খ্যাঁক-খ্যাঁক করে হেসে বললেন, তার মানে তোমরা যাবে না? ভয় ধরছে বুঝি?
টেনিদা এবার তড়াক করে লাফিয়ে উঠল। তারপর সাঁ করে একটা বুকডন দিয়ে বললে, ভয়? দুনিয়ায় আছে বলে আমি জানিনে! নিজের বুকে একটা থাপ্পড় মেরে বললে, কেউ না যায় হাম জায়েঙ্গা! একাই জায়েঙ্গা!
ক্যাবলা বললে, আর যখন ভূতে ধরেঙ্গা?
—তখন ভূতকে চাটনি বানিয়ে খায়েঙ্গা!—টেনিদা বীররসে চাগিয়ে উঠল :সত্যি, কেউ যায় আমি একাই যাব! হঠাৎ আমার ভারি উৎসাহ হল।
—আমিও যাব।
ক্যাবলা বললে, আমিও!
হাবুল, সেন ঢাকাই ভাষায় বললে, হ, আমিও জামু!
মেসোমশাই বললেন, তোমরা ভয় পাবে না?
টেনিদা বুক চিতিয়ে বললেন, একদম না!
আমিও ওই কথাটা বলতে যাচ্ছিলাম, হঠাৎ হতভাগা ক্যাবলা একটা ফোড়ন কেটে দিলে তবে, রাত্তিরবেলা হুলোবেড়াল দেখলে কী হবে কিছুই বলা যায় না।
মেসোমশাই আবার ছাত-ফাটানো অট্টহাসি হেসে উঠলেন। টেনিদা গর্জন করে বললে, দ্যাখ ক্যাবলা, বেশি বকবক করবি তো এক ঘুষিতে তোর নাক—
আমি জুড়ে দিলাম : নাসিকে পাঠিয়ে দেব।
—যা বলেছিস! একখানা কথার মতো কথা।—এই বলে টেনিদা এমনভাবে আমার পিঠ চাপড়ে দিলে যে, আমি উহু-উহু শব্দে চেঁচিয়ে উঠলাম।
তার পরের খানিকটা ঘটনা সংক্ষেপে বলে যাব। কেমন করে আমরা চার মূর্তি বাড়ি থেকে পারমিশন আদায় করলাম সে-সব কথা বলতে গেলে মহাভারত হয়ে যাবে। সেসব এলাহি কাণ্ড এখন থাক। মোট কথা, এর তিনদিন পরে, কাঁধে চারটে সুটকেশ আর বগলে চারটে সতরঞ্চি জড়ানো বিছানা নিয়ে আমরা হাওড়া স্টেশনে পৌঁছুলাম।
ট্রেন প্রায় ফাঁকাই ছিল। এই গরমে নেহাত মাথা খারাপ না হলে আর কে রাঁচি যায়? ফাঁকা একটা ইন্টার ক্লাস দেখে আমরা উঠে পড়লাম, তারপর চারটে বিছানা পেতে নিলাম।
ভাবলাম, বেশ আরামে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ি, হঠাৎ টেনিদা ডাকল—এই প্যালা!