—উনুনে কড়াই বসাও, ঘুটঘুটানন্দ আবার হুকুম করলেন। গজেশ্বর তক্ষুনি সোজা গিয়ে উঠল ভিসুভিয়াসের চূড়ায়। তারপর ঠিক উনুনে যেমনি করে বসায়, তেমনি করে কড়াইটা আগ্নেয়গিরির মুখের ওপর চাপিয়ে দিলে।
স্বামীজী বললেন, তেল আছে তো?
গজেশ্বর বললে, জী মহারাজ।
–খাঁটি তেল?
শেঠ ঢুণ্ডুরাম বললেন, আমার নিজের ঘানির তেল আছে মহারাজ। একদম খাঁটি। থোরাসে ভি ভেজাল নেহি।
স্বামী ঘুটঘুটানন্দ দাড়ি চুমরে বললেন, তবে ঠিক আছে। ভেজাল তেল খেয়ে ঠিক জুত হয় না—কেমন যেন অম্বল হয়ে যায়।
আমি আর থাকতে পারলুম না। হাউমাউ করে বললুম, খাঁটি তেল দিয়ে কী হবে?
—তোমাকে ভাজব। গজেশ্বর গাড়ইয়ের জবাব এল।
স্বামীজী বললেন, তারপর গরম গরম মুড়ি দিয়ে—
শেঠ ঢুণ্ডুরাম বললেন, কুড়মুড় করে খাইয়ে লিব।
পটলডাঙার প্যালারাম তাহলে গেল! চিরকালের মতোই বারোটা বেজে গেল তার! শেয়ালদার বাজারে আর কেউ তার জন্যে কচি পটোল কিনবে না—শিঙিমাছও না। এই তিন-তিনটে রাক্ষসের পেটে গিয়ে সে বিলকুল বেমালুম হজম হয়ে যাবে।
তখন হঠাৎ আমার মনটা কেমন উদাস হয়ে গেল। কেমন স্বর্গীয় স্বর্গীয় মনের ভাব এসে দেখা দিলে। ব্যাপারটা কী রকম জানো? মনে করো, তুমি অঙ্কের পরীক্ষা দিতে বসেছ। দেখলে, একটা অঙ্কও তোমার দ্বারা হবে না—মানে তোমার মাথায় কিছু ঢুকছে না। তখন প্রথমটায় খানিক দরদরিয়ে ঘাম বেরুল, মাথাটা গরম হয়ে গেল, কানের ভেতর ঝিঝি পোকা ডাকতে লাগল আর নাকের ওপরে যেন ফড়িং এসে ফড়াং ফং করে উড়তে লাগল। তারপর আস্তে আস্তে প্রাণে একটা গভীর শান্তির ভাব এসে গেল। বেশ মন দিয়ে তুমি খাতায় একটা নারকোল গাছ আঁকতে শুরু করে দিলে। তার পেছনে পাহাড়—তার ওপর চাঁদ—অনেকগুলো পাখি উড়ছে, ইত্যাদি ইত্যাদি। মানে সব আশা ছেড়ে দিয়ে তুমি তখন। আর্টিস্ট হয়ে উঠলো।
এখানেও যখন দেখছি প্রাণের আশা আর নেই—তখন আমার ভারি গান পেল। মনে হল, আশ মিটিয়ে একবার গান গেয়ে নিই। বাড়িতে কখনও গাইতে পাইনে-মেজদা তার মোটা-মোটা ডাক্তারি বই নিয়ে তাড়া করে আসে। চাটুজ্যেদের রোয়াকে বসে দুচারদিন গাইতে চেয়েছি—টেনিদা আমার চাঁদিতে চাঁটি বসিয়ে তক্ষুনি থামিয়ে দিয়েছে। এখানে একবার শেষ গান গেয়ে নেব। এর আগে কখনও গাইতে পাইনি—এর পরেও তো আর কখনও সুযোগ পাব না।
বললুম, প্রভু, স্বামীজী!
স্বামীজী বললেন, কী চাই বলল? কী হলে তুমি খুশি হও : তোমায় বেসম দিয়ে ভাজবনা এমনি নুন-হলুদ মাখিয়ে?
আমি বললুম, যেভাবে খুশি ভাজুন—আমার কোনও আপত্তি নেই। কেবল একটা নিবেদন আছে। একটুখানি গান গাইতে চাই। মরবার আগে শেষ গান।
গজেশ্বর গাঁ-গাঁ করে বললে, সেটা মন্দ হবে না প্রভু। খাওয়া-দাওয়ার আগে এক-আধটু গান-বাজনা হলে মন্দ হয় না। আফ্রিকার লোকেও মানুষ পুড়িয়ে খাওয়ার আগে বেশ নেচে নেয়। লাগাও হে ছোকরা–
শেঠ ঢুণ্ডুরাম বললেন, হাঁ হাঁ-প্রেমসে একঠো আচ্ছা গানা লগা দেও—
আমি চোখ বুজে গান ধরে দিলুম :
একদা এক নেকড়ে বাঘের গলায়
মস্ত একটি হাড় ফুটিল–
বাঘ বিস্তর চেষ্টা করিল—
হাড়টি বাহির না হইল।
শেঠজী বিরক্ত হয়ে বললেন, ই কী হচ্ছেন? ই তো কথামালার গল্প আছেন। স্বামীজী বললেন, না হে—এতেও বেশ ভাব আছে। আহা-হা কী সুর, কী প্যাঁচামাকা গলার আওয়াজ। গেয়ে যাও ছোকরা, গেয়ে যাও।
আমি তেমনি চোখ বুজেই গেয়ে চললুম :
তখন গলার ব্যথায় নেকড়ে বাঘের
চোখ ফাটিয়ে জল আসিল,
ভ্যাঁও-ভ্যাঁও রবে কাঁদিতে কাঁদিতে
সে এক সারসের কাছে গেল—
এই পর্যন্ত গেয়েছি হঠাৎ ঝুমুর ঝুমুর করে ঘুঙুরের শব্দ কানে এল। মনে হল কেউ যেন নাচছে। চোখ মেলে যেই তাকিয়েছি—দেখি–
গজেশ্বর নাচছে।
হ্যাঁ—গজেশ্বর ছাড়া আর কে? এর মধ্যে কখন একটা ঘাগরা পরেছেনাকে একটা নথ লাগিয়েছে, পায়ে ঘুঙুর বেঁধেছে আর ঘুরে-ঘুরে ময়ুরের মতো নাচছে। সে কী নাচ। রামায়ণের তাড়কা রাক্ষসী কখনও ঘাগরা পরে নেচেছিল কি না জানি না, কিন্তু যদি নাচত তাহলেও যে সে গজেশ্বরের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারত না, এ আমি হলফ করে বলতে পারি! আমি হাঁ করে তাকিয়ে আছি দেখে গজেশ্বর মিটমিট করে হাসল।
বলি, কী দেখছ? অ্যাঁ-অমন করে দেখছ কী? এসব নাচ নাচতে পারে তোমাদের উদয়শঙ্কর? ছোঃ-ছেঃ! এই যে নাচছি—এর নাম হচ্ছে আদত কথাকলি।
স্বামীজী বললেন, মণিপুরীও বলা যায়।
শেঠজী বললেন, হাঁ হাঁ কখক ভি বলা যেতে পারে।
আমি বললুম, তাড়কা-নৃত্যও বলা যায়।
গজেশ্বর বললেন, কী বললে?
আমি তক্ষুনি সামলে নিয়ে বললুম, না না, বিশেষ কিছু বলিনি।
—তোমাকে বলতেও হবে না।ঘাগরা ঘুরিয়ে আর-এক পাক নেচে গজেশ্বর বললে, কই, গান বন্ধ হল যে? ধরো—গান ধরো। প্রাণ খুলে একবার নেচে নিই।
কিন্তু গান গাইব কী! গজেশ্বরের নাচ দেখে আমার গান-টান তখন গলার ভেতরে হালুয়ার মতো তাল পাকিয়ে গেছে।
গজেশ্বর বললে, ছোঃ-ছোঃ—এই তোমার মুরোদ। তুমি ঘোড়ার ডিমের গান জানো। শোননা—আমি নেচে নেচে একখানা ক্ল্যাসিক্যাল গান শোনাচ্ছি তোমায়।
এই বলে গজেশ্বর গান জুড়ে দিলে :
এবার কালী তোমায় খাব–
হুঁ—হুঁ–তোমায় খাব তোমায় খাব–
তোমার মুণ্ডুমালা কেড়ে নিয়েই—হুঁ—হুঁ–
মুড়িঘণ্ট বেঁধে খাব—
আর সেই সঙ্গে আবার সেই নাচ। সে কী নাচ! মনে হল, গোটা ভিসুভিয়াস পাহাড়টাই গজেশ্বরের সঙ্গে ধেই-ধেই করে নাচছে! স্বামীজী তালে-তালে চোখ বুজে মাথা নাড়তে লাগলেন, শেঠজী বললেন, উ-হু-হু। কেইসা বঢ়িয়া নাচ। দি একেবারে ত হোয়ে গেলো!