এদিক-ওদিক তাকিয়ে দেখি, গজেশ্বর কিংবা ঘুটঘুটানন্দের টিকির ডগাটিও কোথাও নেই।
ঢুকে তো পড়ি।
দোকানের ভেতরে একটা ছোট্ট খাবারের ঘর। বসেই শেঠজী ফরমাস করলেন, স্পেশাল এক ডজন লাড়ু আর ছ-ঠো সিঙাড়া—
আমি বিনয় করে বললুম, আবার অত কেন শেঠজী?
ঢুণ্ডুরাম বললেন, আরে বাচ্চা খাও না! বহুৎ বড়িয়া চিজ আছে।
শালপাতায় করে বড়িয়া চিজ এল। একটা লাড়ু খেয়ে দেখি—যেন অমৃত! সিঙাড়া তো নয়—যেন কচি পটোল দিয়ে শিঙিমাছের ঝোল। আর বলতে হল না, আমি কাজে লেগে গেলুম।
গোটা চারেক লাড়ু আর গোটা দুই সিঙাড়া খেয়েছি–এমন সময় হঠাৎ মাথাটা কেমন ঝিমঝিম করে উঠল। তারপর চোখে অন্ধকার দেখলুম। তারপর–
স্পষ্ট শুনলুম—গজেশ্বরের অট্টহাসি!
—পেয়েছি এটাকে। এক নম্বরের বিচ্ছু। আজই এটাকে আমি আলুকাবলি বানিয়ে খাব।
ব্যস—দুনিয়া একেবারে অথই অন্ধকার। আমি চেয়ার-টেয়ারসুদ্ধ হুড়মুড় করে মাটিতে উলটে পড়ে গেলুম।
১৭. খেল খতম!
চটকা ভাঙতেই মনে হল, এ কোথায় এলুম?
কোথায় ঝন্টিপাহাড়ের বাংলো–কোথায় রামগড়-কোথায় কী? চারিদিকে তাকিয়ে নিজের চোখকেই ভালো করে বিশ্বাস হল না।
দেখলুম মস্ত একটা পাহাড়ের চূড়ায় বসে আছি। ঠিক চূড়ায় নয়, তা থেকে একটু নীচে। আর চূড়ার মুখে একটা উনুনের মতো—তা থেকে লকলক করে আগুন বেরুচ্ছে।
ভূগোলের বইয়ে পড়েছি…সিনেমার ছবিতেও দেখেছি। ঠিক চিনতে পারলুম আমি। বলে ফেললুম, এটা নিশ্চয় আগ্নেয়গিরি!
যেই বলা, সঙ্গে সঙ্গে কারা যেন হা-হা করে হেসে উঠল। সে কী হাসি! তার শব্দে পাহাড়টা থর-থর করে কেঁপে উঠল—আর আগ্নেয়গিরির মুখ থেকে একটা প্রকাণ্ড আগুনের শিখা তড়াক করে লাফিয়ে উঠল আকাশের দিকে।
চেয়ে দেখি একটু দূরে বসে তিনটে লোক হেসে লুটোপুটি। একজন শেঠ ঢুণ্ডুরাম-হাসির তালে-তালে শেঠজীর ভুঁড়িটা ঢেউয়ের মতো দুলে-দুলে উঠছে। তাঁর পাশেই বসে আছেন স্বামী ঘুটঘুটানন্দ—হাসতে হাসতে নিজের দাড়ি ধরেই টানাটানি করছেন। আর পাহাড়ের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে দৈত্যের মতো গজেশ্বর আকাশ-জোড়া হাঁ মেলে অট্টহাসি হাসছে।
ওদের তিনজনকে দেখেই আমার আত্মারাম খাঁচাছাড়া! পেটের পিলেতে একেবারে ভূমিকম্প জেগে উঠল।
আমি ঘাবড়ে গিয়ে বললুম, এত হাসছ কেন তোমরা? হাসির কী হয়েছে?
শুনে আবার একপ্রস্থ হাসি। আর গজেশ্বর পেটে হাত দিয়ে ধপাস্ করে বসে পড়ল।
শেঠ ঢুণ্ডুরাম বললেন, হোঃ হোঃ! আগ্নেয়গিরিই হচ্ছেন বটে। এইটা কোন্ আগ্নেয়গিরি জানো খোঁকা?
-কী করে জানব? এর আগে তো কখনও দেখিনি।
—এইটা হচ্ছেন ভিসুভিয়াস।
—ভিসুভিয়াস? —শুনে আমার চোখ কপালে উঠল। ছিলুম রামগড়ে, সেখান থেকে ভিসুভিয়াস যে এত কাছে এ খবর তো আমার জানা ছিল না!
আমি বললুম, ভিসুভিয়াস তো জার্মানিতে! না কি, আফ্রিকায়?
শুনে গজেশ্বর চোখ পাকিয়ে এক বিকট ভেংচি কাটল।
–ফুঃ, বিদ্যের নমুনাটা দ্যাখো একবার। এই বুদ্ধি নিয়েই উনি স্কুলফাইন্যাল পাশ করবেন। ভিসুভিয়াস জার্মানিতে ভিসুভিয়াস আফ্রিকায়। ছোঃ ছোঃ।
আমি নাক চুলকে বললুম তা হলে বোধহয় আমেরিকায়?
শুনে গজেশ্বর বললে, এ, এর মগজে গোরও নেই—একদম খটখটে খুঁটে। সাধে কি পরীক্ষায় গোল্লা খায়। ভিসুভিয়াস তো ইটালিতে।
–ওহো–তাও হতে পারে। তা, ইটালি আর আমেরিকা একই কথা।
—একই কথা? গজেশ্বর বললে, তোমার মুখ আর ঠ্যাং একই কথা? পাঁঠার কালিয়া আর পলতার বড়া একই কথা?
স্বামী ঘুটঘুটানন্দ বললেন, ওর কথা ছেড়ে দাও। ওর পা-ও যা মুণ্ডুও তাই। সে মুণ্ডুতে কিছু নেই—স্রেফ কচি পটোল আর শিঙিমাছের ঝোল।
শিঙিমাছ আর পটোলের বদনাম করলে আমার ভীষণ রাগ হয়। আমি চটে বললুম, থাকুক যে, তাতে তোমাদের কী? কিন্তু কথা হচ্ছে রামগড় থেকে আমি ইটালিতে চলে এলুম কী করে? কখনই বা এলুম? টেনিদা, হাবুল সেন, ক্যাবলা এরাই বা সব গেল কোথায়? কাউকেই তো দেখতে পাচ্ছি না।
—পাবেও না—গজেশ্বর মিটিমিটি হাসল : তারা সব হজম।
–হজম! তার মানে?
–মানে? পেটের মধ্যে, খেয়ে ফেলেছি।
—খেয়ে ফেলেছ! আমার পেটের পিলেটা একেবারে গলা বরাবর হাইজাম্প মারল : সে কী কথা!
আবার তিনজনে মিলে বিকট অট্টহাসি। সে-হাসির শব্দে ভিসুভিয়াসের চূড়ার ওপর লকলকে আগুন লাফিয়ে লাফিয়ে উঠতে লাগল। আমি দুহাতে কান চেপে ধরলুম।
হাসি থামলে স্বামী ঘুটঘুটান বললেন, বাপু হে, আমাদের সঙ্গে চালাকি! পুঁটিমাছ হয়ে লড়াই করতে এসেছ হুলো বেড়ালের সঙ্গে। পাঁঠা হয়ে ল্যাং মারতে গেছ রয়েল বেঙ্গল টাইগারকে! যোগবলে চারটেকে এখানে উড়িয়ে নিয়ে এসেছি। আর তারপরে–
শেঠজী বললেন, হাবুলকে রোস্ট পাকিয়েছি—
গজেশ্বর বললে, তোমাদের লিডার টেনিকে কাটলেট বানিয়েছি—
স্বামীজী বললেন, ওই ফরফরে ছোকরা ক্যাবলাকে ফ্রাই করেছি।
শেঠজী বললেন, তারপর খেয়ে লিয়েছি।
আমার ঝাঁটার মতো চুল ব্ৰহ্মতালুর ওপরে কাঁটার মতো খাড়া হয়ে উঠল। বারকয়েক খাবি খেয়ে বললুম, অ্যাঁ।
স্বামীজী বললেন, এবার তোমার পালা।
—অ্যাঁ।
—আর অ্যাাঁ অ্যাঁ করতে হবে না, টের পাবে এখুনি।—স্বামীজী ডাকলেন, গজেশ্বর। গজেশ্বর হাতজোড় করে বললে, জী মহারাজ।
–কড়াই চাপাও।
বলতে বলতে দেখি কোথেকে একটা কড়াই তুলে ধরেছে গজেশ্বর। সে কী কড়াই। একটা নৌকোর মত দেখতে। তার ভেতরে শুধু আমি কেন, আমাদের চার মূর্তিকেই একসঙ্গে ঘণ্ট বানিয়ে ফেলা যায়।