লরিটা আর-একটু এগোতেই ক্যাবলা বললে,—টেনিদা কুইক। ওই যে নীল মোটর।
তাকিয়ে দেখি, সত্যিই তো। আমাদের থেকে বেশ খানিকটা আগে একটা মিঠাইয়ের দোকানের সামনে শেঠ ঢুণ্ডুরামের নীল রঙের মোটরটা দাঁড়িয়ে আছে।
আমার বুকের ভেতর ধড়াস ধড়াস করতে লাগল। আবার সেই গজেশ্বর। সেই ষণ্ডা জোয়ান ভয়ঙ্কর লোকটা! এর চাইতে লরির ওপরে কচ্ছপরাম হয়ে থাকলেই ভালো হত—অনেক বেশি আরাম পাওয়া যেত।
কিন্তু ক্যাবলা ছাড়বার পাত্র নয়। টেনে নামাল শেষ পর্যন্ত।
—শোন্ প্যালা। তুই আর হাবলা এই পিপুল গাছটার তলায় বসে থাক। বসেবসে ওই নীল মোটরটাকে ওয়াচ কর। আমরা ততক্ষণে একটা কাজ সেরে আসি।
লরিটা ভাড়া বুঝে নিয়ে চলে গিয়েছিল। কাছে থাকলে আমি আবার তড়াক করে ওটার ওপরে উঠে বসতুম—তারপর যেদিকে হোক সরে পড়তুম। কিন্তু এ কী গেরো রে বাপু! এই পিপুল গাছতলায় বসে ওয়াচ করতে থাকি, আর এর মধ্যে গজেশ্বর এসে ক্যাঁক করে আমার ঘাড় চেপে ধরুক।
আমি নাক-টাক চুলকে বললুম, আমি তোমাদের সঙ্গেই যাই না। হাবুল এখানে একাই সব ম্যানেজ করতে পারবে।
ক্যাবলা বললে, বেশি ওস্তাদি করিসনি। যা বললুম তাই কর বসে থাক ওখানে। গাড়িটার ওপরে বেশ করে লক্ষ রাখিস। আমরা দশ মিনিটের মধ্যেই ফিরব। এসো টেনিদা—
এই বলে, পাশের একটা রাস্তা দিয়ে ওরা টুক করে যেন কোন্ দিকে চলে গেল।
আমি বললুম, হাবলা!
উঁ?
—দেখলি কাণ্ডটা?
হাবলা তখন পিপুল গাছের গোড়ায় বসে পড়েছে। মস্ত একটা হাই তুলে বললে : হঃ সইত্য কইছ।
—এ-ভাবে বোকার মতো এখানে বসে থাকবার কোনও মানে হয়?
হাবুল আর-একটা হাই তুলে বললে, নাঃ! তার চাইতে ঘুমানো ভালো। আমার কাঁচা ঘুমটা তোরা মাটি কইর্যা দিছস—তার উপর লরির ঝাঁকানি!—ইস–শরীরটা ম্যাজম্যাজ করতে আছে।
এই বলেই হাবুল পিপুল গাছটায় ঠেসান দিলে। আর তখুনি চোখ বুজল। বললে বিশ্বাস করবে না—আরও একটু পরে ফর ফোঁ-ফোঁ করে হাবুলের নাক ডাকতে লাগল।
কাণ্ডটা দ্যাখো একবার!
আমি ডাকলুম, হাবলা-হাবলা—
নাকের ডাক নামিয়ে হাবুল বললে, উঁ?
—এই দিন-দুপুরে গাছতলায় বসে ঘুমুচ্ছিস কী বলে?
হাবুল ব্যাজার হয়ে বললে, বেশি চিল্লাচিল্লি করবি না প্যালাকইয়া দিলাম। শান্তিতে একটু ঘুমাইতে দে। সঙ্গে সঙ্গেই পরম শান্তিতে সে ঘুমিয়ে পড়ল। আর নাকের ভেতর ঘেথকে ফুড়ৎ ফুড়ুৎ করে শব্দ হতে লাগল—যেন ঝাঁক বেঁধে চড়ই উড়ে যাচ্ছে।
কী ছোটলোক কী ভীষণ ছোটলোক! এখন আমি একা বসে ঠায় পাহারা দিই। কী যে রাগ হল বলবার নয়। ইচ্ছে করতে লাগল ওর কানে কটাং করে একটা চিমটি দিই। কিন্তু তক্ষুনি দেখলুম, তার চাইতেও ভালো জিনিস আছে। বেশ মোটা-মোটা একদল লাল পিঁপড়ে যাচ্ছে মার্চ করে। ওদের গোটাকয়েক ধরে ক্যাবলার নাকের ওপর ছেড়ে দিলে কেমন হয়?
একটা শুকনো পাতা কুড়িয়ে লাল পিঁপড়ে ধরতে যাচ্ছি, হঠাৎ–
—আরে খোঁকা—তুমি এহিখানে?
তাকিয়ে দেখি, শেঠ ঢুণ্ডুরাম।
ভয়ে আমার পেটের মধ্যে এক ডজন পটোল আর দুডজন শিঙিমাছ একসঙ্গে লাফিয়ে উঠল। আমি একটা মস্ত হাঁ করলুম, শুধু বললুম-আ-আ-আ-
শেঠ ঢুণ্ডুরাম হাসলেন : রামগড়ে বেড়াইতে এসেছ? তা বেশ, বেশ। কিন্তু এহিখানে গাছের তলায় বসিয়ে কেনো? লেকিন মুখ দেখে মনে হচ্ছে, তোমার বহুৎ খিদে পেয়েছে।
খিদে? বলে কী? সেই শালপাতার ঠোঙাটা শোঁকার পর থেকে আমার সমস্ত মেজাজ বিগড়ে রয়েছে। মনে হচ্ছে—আকাশ খাই, পাতাল খাই। এমন অবস্থা হয়েছে যে শেঠ ঢুণ্ডুরামের ভুড়িটাতেই হয়ত কড়াৎ করে কামড় বসিয়ে দিতে পারি। কিন্তু সে কথা কি আর বলা যায়?
শেঠ ঢুণ্ডুরাম বললেন, আরে খিদে পেয়েছে তাতে লজ্জা কী? আইসো হামার সঙ্গে। ওই দোকানে বহুৎ আচ্ছা লাড়ু মিলে—গরমাগরম সিঙাড়া ভি আছে। খাবে? হামি খিলাবো–তোমাকে পয়সা দিতে হবে না।
এই পটলডাঙার প্যালারামকে বাঘ বালুক কায়দা করতে পারে না—টেনিদার গাঁট্টা দেখেও সে বুক টান করে দাঁড়িয়ে থাকে, অঙ্কে গোল্লা খেলেও তার মন-মেজাজ বিগড়ে যায় না। কিন্তু খাবারের নাম করেছ কি, এমন দুর্ধর্ষ প্যালারাম একেবারে বিধ্বস্ত।
আমি আমতা আমতা করে বললুম-লেকিন শেঠজী, গজেশ্বর—
ঢুণ্ডুরাম চোখ কপালে তুলে বললেন, গজেশ্বর? কোন্ গজেশ্বর?
আমি বললুম, সেই যে একটা প্রকাণ্ড জোয়ান–হাতির মতো চেহারা আপনার গাড়িতে এসেছে–
ঢুণ্ডুরাম বললেন, রাম রাম-সীতারাম! আমি কোনও গজেশ্বরকে জানে না। আমার গাড়িতে হামি ছাড়া আর কেউ আসেনি।
—তবে যে স্বামী ঘুটঘুটানন্দের দাড়ি—
ঘুটঘুটানন্দ? ঢুণ্ডুরাম ভেবে-চিন্তে বললেন, হাঁ হাঁ একঠো বুড়া রাস্তায় হামার গাড়িতে উঠেছিল বটে। হামাকে বললে, শেঠজী, রামগড় বাজারে আমি নামবে। আমি তাকে নামাইয়ে দিলম। সে ইস্টেশনের দিকে চলিয়ে গেল।
এর পরে আর অবিশ্বাসের কী থাকতে পারে?
ঢুণ্ডুরাম বললে, আইসসা খোকা—আইসো। ভালো লাজু আছে—গরম সিঙাড়া ভি আছে—
আর থাকা গেল না। পটলডাঙার প্যালারাম কাত হয়ে গেল। হাবলা তখনও নাক। ডাকিয়ে ঘুমুচ্ছে আর ওর নাকের ভেতর থেকে সমানে চড়ুই পাখি উড়ছে। একবার মনে হল ওকে জাগাই—তারপরেই ভাবলুম : না—থাক পড়ে। আমি একাই গুটিগুটি ঢুণ্ডুরামের সঙ্গে গেলাম।
মস্ত খাবারের দোকান। থরেথরে লাড়ু আর মোতিচুর সাজানো। প্রকাণ্ড কড়াইয়ে গরম সিঙাড়া ভাজা হচ্ছে। গন্ধেই প্রাণ বেরিয়ে যেতে চায়!
শেঠজী বললেন, আইসসা খোকা—ভিতরে আইসো।