কী ছোটলোক! সবগুলো খেয়ে গেছে। এক-আধটা রেখে গেলে কী এমন ক্ষতিটা ছিল!
—এই প্যালা—মাঝরাস্তায় দাঁড়িয়ে পড়লি ক্যান র্যা?—টেনিদার হাঁক শোনা গেল।
এমনিতেই খিদে পেয়েছে—ঘ্রাণে অর্ধভোজন হচ্ছিল, সেটা ওদের সইল না। চটপট ঠোঙাটা ফেলে দিয়ে আবার আমি ওদের পিছু পিছু হাঁটতে লাগলুম। ভারি মন খারাপ হয়ে গেল। ঠোঙাটা আরও একটু শোঁকবার একটা গভীর বাসনা আমার ছিল।
বড় রাস্তায় যখন এসে পড়েছি-তখন, ভোঁক-ভোঁক। একটা লরি।
আমি হাত তুলে বলতে যাচ্ছিলুম-রোকে—রোকে—কিন্তু ক্যাবলা আমার হাত চেপে ধরলে। বললে, কী যে করিস গাড়লের মতো তার ঠিক নেই। ওটা তো রামগড় থেকে আসছে!
—ওরা তো উল্টোদিকেও যেতে পারে।
—তুই একটা ছাগল! দেখছিস না কাঁচা রাস্তার ওপর ওদের মোটরের চাকা কীভাবে বাঁক নিয়েছে। অর্থাৎ ওরা নির্ঘাত রামগড়ের দিকেই গেছে। উল্টোদিকে হাজারিবাগ-সেদিকে যায়নি।
ইস–ক্যাবলার কী বুদ্ধি! এই বুদ্ধির জন্যেই ও ফার্স্ট হয়ে প্রমোশন পায়—আর আমার কপালে জোটে লাড়ু! তাও অঙ্কের খাতায়। আমার মনে হল, লাড়ু কিংবা গোল্লা দেবার ব্যবস্থাটা আরও নগদ করা ভালো। খাতায় পেনসিল দিয়ে গোল্লা বসিয়ে কী লাভ হয়? যে গোল্লা খায় তাকে একভাঁড় রসগোল্লা দিলেই হয়। কিংবা গোটা-আষ্টেক বড়বাজারের লাড়ু। কিন্তু তিলের নাড় নয়—একবার একটা খেয়ে সাতদিন আমার দাঁত ব্যথা করেছিল।
-ঘর্র্—ঘ্যাঁস।
পাশে একটা লরি এসে থামল। কাঠ-বোঝাই। ক্যাবলা হাত তুলে সেটাকে থামিয়েছে। লরি-ড্রাইভার গলা বের করে বললে, কী হয়েছে খোকাবাবু। তুমরা ইখানে কী করছেন?
আমাদের একটু রামগড়ে পৌঁছে দিতে হবে ড্রাইভার সাহেব।
—পয়সা দিতে হবে যে। চার আনা।
—তাই দেব।
—তবে উঠে পড়ো। লেকিন কাঠকে উপর বসতে হবে।
-ঠিক আছে। কাঠে আমাদের কোনও অসুবিধে হবে না।
ক্যাবলা আমাদের তাড়া দিয়ে বললে, টেনিদা—ওঠো। হাবলা আর দেরি করিসনি। তুই হাঁ করে দাঁড়িয়ে আছিস কেন প্যালা? উঠে পড় শিগগির–
ওরা তো উঠল। কিন্তু আমার ওঠা কি অত সহজ? টেনে-হিচড়ে কোনমতে যখন লরির ওপরে উঠে কাঠের আসনে গদিয়ান হলুম—তখন আমার পেটের খানিক নুন-ছাল উঠে গেছে। সারা গা চিড়-চিড় করে জ্বলছে।
আর তক্ষুনি–
ভোঁক-ভোঁক করে আরও গোটা-দুই হাঁক ছেড়ে গাড়ি ছুটল রামগড়ের রাস্তায়। একী যাচ্ছেতাই ভাবে নড়ছে যে কাঠগুলো! কখন ধপাস করে উটে পড়ে যাই—তার ঠিক নেই। আমি সোজা উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ে দুহাতে মোটা কাঠের গুড়িটা জাপটে ধরলুম।
লরিটা পাঁই-পাঁই করে ছুটতে লাগল। আমার মনে হতে লাগল, পেল্লায় ঝাঁকুনির চোটে আমার পেটের নাড়িভূঁড়িগুলো সব একসঙ্গে ক্যাঁ-ক্যাঁ করছে।
১৬. মোক্ষম লাড্ডু
কাঠের লরির সে কী দৌড়। একে তো হইহই করে ছুটছে, তায় ভেতরের কাঠগুলো যেন হাত-পা তুলে নাচতে শুরু করেছে। যদিও মোটা দড়ি দিয়ে কাঠগুলো বেশ শক্ত করে বাঁধা, তবু মনে হচ্ছিল কখন যেন আমাদের নিয়ে ওরা চারদিকে ছিটকে পড়ে যাবে।
জামঝাঁকানো দেখেছ কখনও? সেই যে দুটো বাটির মধ্যে পুরে ঝকরঝকর করে ঝাঁকায়—আর জামের আঁটিটাটিগুলো সব আলাদা হয়ে যায়? ঠিক তেমনি করে আমার জ্বরের পিলে-টিলে ঝাঁকিয়ে দিচ্ছিল। আমার সন্দেহ হতে লাগল, আর কিছুক্ষণ পরে আমি আর পটলডাঙার প্যালারাম থাকব না—একেবারে শ্রীবৃন্দাবনের শ্রীকচ্ছপ হয়ে যাব। মানে, সব মিলিয়ে একসঙ্গে তালগোল পাকিয়ে যাব।
এর মধ্যে ঝড়াৎ-ঋড়াৎ। নাকের ওপর দিয়ে কে যেন চাবুক হাঁকড়ে দিলে। একটা গাছের ডাল।
টেনিদা বললে, ইঃ-হতভাগা ক্যাবলার বুদ্ধিতে পড়েই আজ মাঠে মারা যাব!
ক্যাবলা ইস্টুপিডটা এর মধ্যেও রসিকতার চেষ্টা করলে : মাঠে নয় রাস্তায়। রামগড়ের রাস্তায়।
রাস্তায়। টেনিদা দাঁত খিচিয়ে বললে, দাঁড়া না একবার, রামগড় পৌঁছে যাই। তারপর–
তারপর বললে-কোঁৎ!
মানে, ক্যাবলাকে কোঁৎ করে গিলে খাবে তা বললে না। একটা মোক্ষম ঝাঁকুনি খেয়ে ওটা বেরিয়ে এল মুখ দিয়ে।
হাবুল সেন ঘ্যানঘ্যান করতে লাগল : ইস, কর্ম তো সারছে। প্যাটের মধ্যে গজাদার রসগোল্লা যে ছানা হইয়া গেল।
আমি বললুম, শুধু ছানা? এর পরে দুধ হয়ে যাবে।
টেনিদা শুরু করলে : দুধ? দুধেও কুলোবে না। একটু পরে পেট ফুড়ে শিং-টিং সুষ্ঠু একটা গোরুও বেরিয়ে আসছে—দেখে নিস।
হাবুল আবার ঘ্যানঘ্যান করে বললে, হঃসত্য কইছ। প্যাট ফুইড়া গোরই বাহির হইব অখনে।
ক্যাবলা চেঁচিয়ে গান ধরলে, প্রলয় নাচন নাচলে যখন আপন ভুলে হেনটাজ।
টেনিদা রেগেমেগে কী একটা বলে চেঁচিয়ে উঠতে যাচ্ছিল, এমন সময় আবার সেই পেল্লায় ঝাঁকুনি। টেনিদা সংক্ষেপে বললে, ঘোঁ-ঘোঁ ঘোৎ।
কিন্তু সব দুঃখেরই শেষ আছে। শেষ পর্যন্ত লরি-রামগড়ের বাজারে এসে পৌঁছুল।
গাড়িটা এখন একটু আস্তে আস্তে যাচ্ছে আমরা চারজন কোনওমতে কাঠের ওপর উঠে বসেছি। হঠাৎ
—আরে ভগলু, দেখ ভাইয়া! লরিকা উপর চার লেড়কা বারকা মাফিক বৈঠল বা।
তিনটে কালোকালো ছোকরা। আমাদের দেখে দাঁত বের করে হাসছে।
আমি ভীষণ রেগে বললুম, তুমলোগ্ বান্দর হো! তুমলোগ বুন্ধু হো।
শুনে একজন অমনি বোঁ করে একটা ঢিল চালিয়ে দিলে একটুর জন্যে আমার কানে লাগল না। আমাদের লরির ড্রাইভার চেঁচিয়ে বলল, মারকে টিকি উখাড় দেব।
ছোকরাগুলোর অবশ্য টিকি ছিল না, তবু দাঁত বের করে ভেংচি কাটতে কাটতে কোথায় যেন হাওয়া হয়ে গেল।