—সে তো বেশ ভালো কথা, কিন্তু ভূতগুলোকে সেকথা বোঝায় কে! টেনিদা দীর্ঘশ্বাস ফেলল : যেতে চাস তো চল্। কিন্তু সত্যি, ভারি মায়া লাগছে রে! এমন আরাম, এমন খাওয়া-দাওয়া, ঝন্টেটা আবার রুটির সঙ্গে কতটা করে মাখন দিয়েছিল—দেখেছিস তো? এখানে দিনকয়েক থাকলে আমরা লাল হয়ে যেতুম।
আমি বললাম, তার আগে ভূতেরাই লাল হয়ে যাবে।
টেনিদা সামনে থেকে একটা প্লেট তুলে নিয়ে তার তলায় লেগে থাকা একটুখানি মাখন চট করে চেটে নিলে। তারপরের আর একটা বুক-ভাঙা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলল।
তা হলে আজই? আমি আর হাবুল সমস্বরে বললাম, হ্যাঁ হ্যাঁ, আজই।
ক্যাবলার কথা এতক্ষণ আমাদের মনেই ছিল না। সেই যে ভোরবেলা ঝাঁঝরি-দাওয়াই দিয়ে আমাদের জ্ঞান ফিরিয়েছে, তারপর আর তার পাত্তা নেই। কোথায় গেল ক্যাবলা?
আমি বললাম, ক্যাবলা গেল কোথায়?
টেনিদা চমকে বললে, তাই তো! সকাল থেকে তো ক্যাবলাকে দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না!
হাবুল সেন জানতে চাইল; ভূতের সঙ্গে মস্করা করতে আছিল, ভূতে তারে লইয়া যায় নাই তো?
টেনিদা মুখ-টুক কুঁচকে বললে, বয়ে গেছে ভূতের! ওটা যা অখাদ্যি—ওকে ভূতেও হজম করতে পারবে না। কিন্তু গেল কোথায়? আমাদের ফেলেই চম্পট দিলে না তো?
ঠিক এই সময় হঠাৎ বাজখাঁই গলায় গান উঠল :
ছপ্পর পর কৌয়া নাচে, নাচে বগুলা—
আরে রামা হো–হো রামা—
গানটা এমন বেখাপ্পা যে আমি চেয়ারসুদ্ধ উটে পড়তে পড়তে সামলে গেলুম। এ আবার কী রে বাবা! দিন-দুপুরে এসে হানা দিলে নাকি! কিন্তু ভূতে রাম নাম করতে যাবে কোন্ দুঃখে?
ভূত নয়—ক্যাবলা। কোখেকে একগাল হাসি নিয়ে বারান্দায় উঠে পড়ল।
গিয়েছিলি কোথায়? অমন ষাঁড়ের মত চেঁচাচ্ছিসই বা কেন?—টেনিদা জানতে চাইলে।
বলছি ক্যাবলা করুণ চোখে সামনের পেয়ালা-পিরিচগুলোর দিকে তাকাল : এর মধ্যেই ব্রেকফাস্ট শেষ? আমার জন্যেই কিছু ই বুঝি?
—সে আমরা জানিনে, ঝণ্টুরাম বলতে পারে -টেনিদা বললে, ব্রেকফাস্ট পরে করবি, কোথায় গিয়েছিলি তাই বল।
ক্যাবলা মিটমিট করে হেসে বলল, ভূতের খোঁজে গিয়েছিলুম। ভূত পাওয়া গেল না পাওয়া গেল একঠোঙা চীনেবাদাম।
চীনেবাদাম!
ক্যাবলা বললে, তাতে অর্ধেক খোসা, অর্ধেক বাদাম। মানে অর্ধেকটা খাওয়ার পরে আর সময় পায়নি।
—কে সময় পায়নি? —আমি বেকুবের মতো জিজ্ঞস করলুম।
জানালার ও ধারে ঝোপের ভেতরে বসে যারা মড়ার মাথা ছুঁড়েছিল, তারাই। যদি ভূতও হয়—তাহলে কিন্তু বেশ মডার্ন ভূত, টেনিদা! মানে বাদাম খায়, মুড়ি খায়, তেলেভাজাও খায়। তেলেভাজার শালপাতা আর মুড়িও পাওয়া গেল কিনা!
টেনিদা বললে, তার মানে—
ক্যাবলা বললে, তার মানে হল, এ সব কোনও বদমাস আদমি কা কারসাজি! তারাই। রাত্তিরে অমনি করে যাচ্ছেতাই রকম হেসেছে, ঘরের ভেতরে মড়ার মাথা ফেলেছে—অর্থাৎ আমাদের তাড়ানোর মতলব। তুমি পটলডাঙার টেনিদা—গড়ের মাঠে গোরা পিটিয়ে চ্যাম্পিয়ন—তুমি এসব বদমায়েসদের ভয়ে পালাবে এখান থেকে।
—ঠিক জানিস? ভূত নয়?
—ঠিক জানি।-ক্যাবলা বললে, ভূতে তেলেভাজা আর চীনেবাদাম খায়, একথা কে কবে শুনেছে? তার ওপর তারা বিড়িও খেয়েছে। দু-চারটে পোড়া বিড়ির টুকরোও ছিল।
–তা হলে বদমাস লোক!—পটলডাঙার টেনিদা হঠাৎ বুক ঠুকে সোজা দাঁড়িয়ে পড়ল; মানুষ যদি হয়, তবে বাবাজীদের এবার ঘুঘু আর ফাঁদ দুই-ই দেখিয়ে ছাড়ব! চলে আয় সব–কুইক মার্চ–
বলে এমনিভাবে আমাকে একটা হ্যাঁচকা টান মারল যে আমি ছিটকে সামনের মেঝেয় গিয়ে পড়লুম।
হাবুল সেন প্যাঁচার মতো ব্যাজার মুখে বললে, কোথায় যেতে হবে?
—লোকগুলোর সঙ্গে একবার মোলাকাত করতে। আমরা কলকাতার ছেলে আমাদের বক দেখিয়ে কেটে পড়বে ইয়ার্কি নাকি! চল-চল, ভালো করে একবার চারদিকটা ঘুরে দেখি।
ক্যাবলা বললে, কিন্তু আমার ব্রেকফাস্ট–
—সেটা একেবারে লাঞ্চের সময়েই হবে। নে—চলহাবুল আর ক্যাবলা উঠে দাঁড়িয়েছিল, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই একটা অদ্ভুত কাণ্ড ঘটল স্পষ্ট দিনের আলোয়—সেই বেলা আটটার সময়—ঠিক আমাদের মাথার ওপর কে যেন কর্কশ গলায় বলে উঠল : বাঃ—বেশ, বেশ!
তারপরেই হা-হা করে ঠাট্টার অট্টহাসি!
কে বললে, কে হাসল? কেউ না। মাথার ওপরে টালির চাল আর লাল ইটের ফাঁকা দেওয়াল–জন-মানুষের চিহ্নও নেই কোথাও। যেন হাওয়ার মধ্যে থেকে ভেসে এসেছে। আশ্চর্য শব্দগুলো।
০৮. ছপ্পর পর কৌয়া নাচে
রাত নয়—অন্ধকার নয়—একেবারে ফুটফুটে দিনের আলো। দেওয়ালের ওপরে টালির চাল—একটা চড়ুই পাখি পর্যন্ত বসে নেই সেখানে। অথচ ঠিক মনে হল ওই টালির চাল কুঁড়েই হাসির আওয়াজটা বেরিয়ে এল।
কী করে হয়? কী করে এমন সম্ভব?
আমরা কি পাগল হয়ে গেছি? না কি ঝণ্টুরাম চায়ের সঙ্গে সিদ্ধি ফিদ্ধি কিছু খাইয়ে দিলে? তাই বা হবে কেমন করে? ক্যাবলা তো চা খায়নি আমাদের সঙ্গে! তবু সেও ওই
অশরীরী হাসির আওয়াজটা ঠিক শুনতে পেয়েছে।
প্রায় চার মিনিট ধরে আমরা চারমূর্তি চারটে লাটুর মতো বসে রইলুম। আমরা অবশ্য লাটুর মতো ঘুরছিলুম না—কিন্তু মগজের সব ঘিলুগুলো ঝনঝনর করে পাক খাচ্ছিল। খাসা ছিলুম পটলডাঙায়, পটোল দিয়ে শিঙিমাছের ঝোল খেয়ে দিব্যি দিন কাটছিল। কিন্তু টেনিদার প্যাঁচে পড়ে এই ঝন্টিপাহাড়ে এসে দেখছি ভুতের কিল খেয়েই প্রাণটা যাবে।
আরও তিন মিনিট পরে যখন আমার পিলের কাঁপুনি খানিক বন্ধ হল, আমি ক্যাবলাকে বললুম, এবার?