হাবুল টেনিদার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বললে, তখন দুইজনে মিল্যা ভূতের পা ধইরা একটা হ্যাঁচকা টান মারুম—আর ভূতে—
টেনিদা বললে, একদম ফ্ল্যাট! ক্যাবলা খিকখিক করে হাসতে লাগল।
টেনিদা চটে গিয়ে বললে, অমন করে হাসছিস যে ক্যাবলা? জানিস ওতে আমার ইনসাল্ট হচ্ছে? টেক কেয়ার! গুরুজনকে যদি অমন করে তুরু করবি, তা হলে চটে গিয়ে এমন একখানা মুগ্ধবোধ বসিয়ে দেব
টেনিদা বোধহয় ক্যাবলার নাকে একটা মুগ্ধবোধ বসাবার কথাই ভাবছিল, সেই সময় আবার একটা ভীষণ কাণ্ড ঘটল।
পাশের জানালাটার কাচে ঝনঝন করে শব্দ হল একটা। কতকগুলো ভাঙা কাচ ছিটকে পড়ল চারিদিকে আর সঙ্গে সঙ্গে মধ্যে শাদা বলের মতো কী একটা ঠিকরে পড়ল এসে—একেবারে ক্যাবলার পায়ের কাছে গড়িয়ে এল।
আর লণ্ঠনের আলোয় স্পষ্ট দেখলুম-ওটা আর কিছু নয়, স্রেফ মড়ার মাথার খুলি।
—ওরে দাদা।
আমি মেঝেতে ফ্ল্যাট হলুম সঙ্গে সঙ্গেই। হাবুল আর টেনিদা বিদ্যুৎবেগে আবার খাটের তলায় অদৃশ্য হল। শুধু লণ্ঠন হাতে করে ক্যাবলা ঠায় দাঁড়িয়ে রইল—শুয়ে পড়ল না, বসেও পড়ল না।
সঙ্গে সঙ্গে আবার সেই পৈশাচিক অট্টহাসি উঠল। সেই হাসির সঙ্গে থরথর করে কাঁপতে লাগল ঝন্টিপাহাড়ির ডাকবাংলো।
০৭. কে তুমি হাস্যময়?
বাকি রাতটা যে আমাদের কী ভাবে কাটল, সে আর খুলে না বললেও চলে।
টেনিদা আর হাবুল সেনের কী হল জানি না আমি তো প্রায় অজ্ঞান। তার মধ্যেই মনে। হচ্ছিল, দুটো তালগাছের মতো পেল্লায় ভূত আমাকে চ্যাংদোলা করে নিয়ে যাচ্ছে। একজন যেন বলছে : এটাকে কালিয়া রান্না করে খাব, আর-একজন বলছে : দুরদুর! এটা একেবারে শুটকো চামচিকের মতো গায়ে একরত্তি মাংস নেই। বরং এটাকে তেজপাতার মতো ডাল সম্বরা দেওয়া যেতে পারে।
আমি বোধহয় ভেউ-ভেউ করে কাঁদছিলুম, হঠাৎ তিড়িক করে লাফিয়ে উঠতে হল। মুখের ওপর কে যেন আঁজলা-আঁজলা করে জল দিচ্ছে। আর, কী ঠাণ্ডা সে জল! বাঘের নাকে সে জল ছিটিয়ে দিলে বাঘ-সুদ্ধ অজ্ঞান হয়ে পড়বে।
বাঘ অজ্ঞান হোক কিন্তু আমার জ্ঞান ফিরে এল, মানে, আসতেই হল তাকে।
আর কে? ক্যাবলা। করেছে কী-বাগানে জল দেবার একটা ঝাঁঝরি নিয়ে এসেছে, তাই দিয়ে আমাকে স্রেফ চান করিয়ে দিচ্ছে।
–ওরে থাম থাম—
ক্যাবলা কি থামে! আমার মুখের ওপর আবার একরাশ জল ছিটিয়ে দিয়ে বললে, কী রে, মাথা ঠাণ্ডা হয়েছে তো?
ঠাণ্ডা মানে? সারা গা ঠাণ্ডা হবার জো হল—আমি তড়াক করে ঝাঁঝরির আক্রমণ থেকে পাশ কাটালুম।
কাচের জানালা দিয়ে বাইরের ভোরের আলো দেখা যাচ্ছে। ঝন্টিপাহাড়ির ডাকবাংলোয় একটা দুঃস্বপ্নের রাত শেষ হয়ে গেছে। সামনে লেকের নীল জলটার ওপর ভোরের লালচে রং। পাখির মিষ্টি ডাক শুরু হয়েছে চারদিকে শিশিরে ভেজা শাল-পলাশের বন যেন ছবির মতো দেখাচ্ছে।
কোঁচার খুঁটে মুখটা মুছতে মুছতে আমার মনে হল, এমন সুন্দর জায়গায় এমন বিচ্ছিরি ভূতের ব্যাপার না থাকলে দুনিয়ায় কার কী ক্ষতি হত।
আমি তো এসব ভাবছি, ওদিকে ক্যাবলার ঝাঁঝরি সমানে কাজ করে চলেছে। খানিক পরে হাঁই-মাই কাঁই-কাঁই আওয়াজ শুনে তাকিয়ে দেখি, ঝাঁঝরির আক্রমণে জর্জরিত হয়ে খাটের তলা থেকে বেরিয়ে আসছে টেনিদা আর হাবুল।
ক্যাবলা হেসে বললে, তোমাদের জ্ঞান ফিরিয়ে আনবার জন্যে কেমন দাওয়াইটি বের করেছি! দেখলে তো!
টেনিদা গাঁক-গাঁক করে বললে, থাক, বকিসনি। আমরা অজ্ঞান হয়েছিলাম কে বললে তোকে? দুজনে চুপি-চুপি প্ল্যান আঁটছিলুম, আর তুই রাস্কেল ঠাণ্ডা জল দিয়ে–
বলেই টেনিদা ফ্যাঁচ করে হেঁচে ফেললে। বললে, ইঃ গেছি—গেছি! এই শীতের সকালে যেভাবে নাইয়ে দিয়েছিস, তাতে এখন ডবল-নিউমোনিয়া না হলে বাঁচি!
ঝণ্টুরামকে জিজ্ঞেস করে কোনও হদিশ পাওয়া গেল না।
সে ডাকবাংলোয় থাকে না। এখান থেকে মাইলখানেক দূরে তার বাড়ি। আমাদের খাইয়ে-দাইয়ে নিজের বাড়িতে চলে গিয়েছিল। সকালবেলায় এসেছে।
টেনিদা বললে, ওটা কোনও কম্মের নয়—একেবারে গাড়ল! হাবুল সেন মাথা চুলকে বললে, ও নিজেই ভূত কি না সেই কথাটাই বা কেডা কইব? চেহারাখানা দেখতে আছ না? য্যান তালগাছের থন নাইম্যা আসছে।
আমি আঁতকে উঠলাম : সত্যিই কি ভূত নাকি?
টেনিদা বললে, তোরা দুটোই হচ্ছিস্ গোর্ভূত! জানিনে, ভূত আগুন দেখলেই পালায়? ও ব্যাটা নিজে উনুন ধরিয়ে চা করে দিলে, রাত্তিরে ওর রান্না মুরগির ঝোল আর ভাত দু-হাতে সাঁটলি, সেকথা মনে নেই বুঝি?
আমরা আর সাঁটতে পেরেছি কইমুরগির দু-এক টুকরো হাড় কেবল চুষতে পেরেছি, বাকি সবটাই টেনিদার পেটে গেছে। কিন্তু এখন আর সে কথা বলে কী হবে!
আমি বললুম, ঝণ্টুরাম ভূত হোক আর না-ই হোক, তাতে কিছু আসে যায় না। সোজা কথা হচ্ছে, পটল যদি তুলতেই হয়, তাহলে পটলডাঙাতে গিয়েই তুলব। এখানে ভূতের হাতে মরতে আমি রাজি নই। আমি আজকেই কলকাতায় ফিরে যাব।
হাবুল উৎসাহিত হয়ে বললে, হ–হ, আমিও সেই কথাই কইতে আছিলাম।
টেনিদা খাঁড়ার মতো নাকটা চুলকোতে লাগল।
আমি বললুম, তোমাদের ইচ্ছে হয় থাক। ভূতেরা ধরে ধরে তোমাদের হাঁড়ি কাবাব করে খাককাটলেট বানাক, রোস্ট করে ফেলুক—আমার কিছুই আপত্তি নেই।
আজই আমি পালাব।
টেনিদা বললে, তাই তো! কিন্তু জায়গাটা খাসা—বেশ প্রেমসে খাওয়া-দাওয়াও করা যাচ্ছিল, কিন্তু ভূতগুলোই সব মাটি করে দিলে!
হাবুল মাথা নেড়ে বললে, হ, সইত্য কথা। এখানে জঙ্গলের মধ্যে থাইক্যা ভূতগুলানে কী যে সুখ হয়—তাও তো বুঝি না। আমাগো কইলকাতায় গিয়া বাসা করত, থাকতও ভালো, আমরাও ছুটি পাইতাম। আর যদি বাইছা বাইছ্যা হেড পণ্ডিতের ঘাড়ে উইঠ্যা বসত, তাহলে আমাগো আর শব্দরূপ মুখস্থ করতে হইত না!