মৃত্যুক্ষুধা – ০৫
সন্ধে হব-হব সময় প্যাঁকালে হাতে চাল-ডাল, বগলতলায় ফুটগজ, পকেটে কন্নিকসুত, আর মুখে পান ও বিড়ি নিয়ে ঘরে ঢুকল।
ছেলেমেয়ে তাকে যেন ছেঁকে ধরল।
চাল-ডালের মধ্যে একটা বোয়াল মাছ দেখে তারা একযোগে চিৎকার করে উঠল। যেন সাপের মাথায় মানিক দেখেছে।
প্যাঁকালে তার কোটের হাতায় হাত দুটো মুছে তিনটে ছোট্ট কাগজের পুরিয়া বের করে বললে, “আজ নলিত ডাক্তারের বাড়ির খানিকটা পলস্তারা করে দিয়ে এই ওষুধ নিয়ে এসেছি সোজা-ভাবির তরে। দাঁড়া, এক পুরিয়া খাইয়ে দিই আগে।”
সেজোবউ ওষুধ দেখে খুশি হয়ে বলে উঠল, “ই কোন ওষুধ ছোটো-মিয়েঁ? এলোপাতাড়ি না হৈমুবাতিক?”
প্যাঁকালে বিজ্ঞতার হাসি হেসে বললে, “ই এলিওপাতি নয় সেজো-ভাবি, হোমিওবাতি। গুড়ের মতো মিষ্টি। খেয়েই দেখো।”
ওষুধ খেয়ে সেজোবউয়ের মনে হতে লাগল, সে যেন ক্রমেই চাঙ্গা হয়ে উঠছে। সে তার খুশি আর চেপে না রাখতে পেরে বলতে লাগল, “আর দুটো দিন যদি ওষুধ পাই মেজোবুবু, তাহলে আসছে-মাস থেকেই আমি একা একরাশ ধান ভানতে পারব।”
মেজোবউ চাল-ডাল তুলতে তুলতে বললে, “ তাই ভালো হয়ে ওঠ ভাই আল্লা করে, আমি আর পারি না ঢেঁকিতে পাড় দিতে। আমার কাপড় সেলাই-ই ভালো, ওতে দু পয়সা কম পেলেও সোয়াস্তি আছে।”
বড়োবউ বাঁশের চেঁচাড়ি দিয়ে তার ঘুঁটে-দেওয়া হাতের গোবর চেঁছে তুলতে তুলতে বললে, “ওই সেলাইটা আমায় শিখিয়ে দিতে পারিসনে মেজোবউ! তবে রিপু করাটা কিন্তু আমায় দিয়ে হবে না।”
মেজোবউ হাসে, আর গুন গুন করে গান করতে করতে মাছ কোটে। ছেলেমেয়েদের দল মেজোবউকে ঘিরে হাঁ করে মাছ কোটা দেখে আর কে মাছের কোন অংশটা খাবে, এই নিয়ে কলহ করে। যেন কাঁচাই খেয়ে ফেলবে ওরা।
বড়ো ছেলেমেয়ে দুটোতে মিলে ইঁদারায় জল তুলে দিতে দিতে বলে, “আচ্ছা ছোটো চাচা, আজ মাছের মুড়োটা তো তুমিই খাবে? পটলি বলছিল, ছোটো-চা আজ আমায় দেবে মুড়োটা!”
প্যাঁকালে স্নান করতে করতে কী ভাবে! শুধু বলে, ‘হুম’!
তার এই ‘হুঁ’ শুনে ছেলেটি আতঙ্কিত হয়ে উঠে বলে, “আচ্ছা ছোটো-চা, আমাকে কাল থেকে ‘জোগাড়’ দিতে নিয়ে যাবে? উ-ই ও পাড়ার ভুলো তো আমার চেয়ে অনেক ছোটো, সে রোজ দু আনা করে আনে ‘জোগাড়’দিয়ে। – আচ্ছা ছোটো-চা, দু আনায় একটা মাছ পাওয়া যায় না?” – তারপর তার বোনের দিকে তাকিয়ে বলে, “কাল থেকে আমার একা একটা মাছ! দেখাব আর খাব! ওই পটলিকে যদি একটা আঁশ ঠেকাই তবে আমার নাম গোরাই নয়, হুঁ হুঁ।”
তার বোন মুখ চুন করে দাঁড়িয়ে কী একটা মতলব ঠাওরায়। তারপর হঠাৎ বলে ওঠে, “আমিও কাল থেকে দারোগা সায়েবের খুকির গাড়ি ঠেলব – হুঁ হুঁ! আমায় সায়েব তিন ট্যাকা করে মাইনে দেবে বলেছে! দু আনা লয় – তিন ট্যাকা। আমিও তখন ছোটো-টাকে দিয়ে জিলিবি আর মেঠাই আনাব!”
প্যাঁকালে স্নান সেরে তার বোনের আঁতুড়-ঘরে ঢুকে বললে, “কই রে পাঁচি, তোর ছেলে দেখা!”
পাঁচি কিছু বলবার আগেই ওর মা ছুটে এসে বললে, “হ্যাঁরে প্যাঁকালে, শুধু হাতে দেখবি কী করে!”
প্যাঁকালে নিজের রিক্ততায় সংকুচিত হয়ে বলে উঠল, “আচ্ছা, কাল কিংবা আর একদিন দেখব এসে। আমার – শালা – মনেই ছিল না যে, শুধু হাতে দেখতে নেই।” বলেই সে তাড়াতাড়ি রান্নাঘরে মেজোবউয়ের কাছে গিয়ে বসল।
মাছটা চড়িয়ে দিয়ে তখন মেজোবউ ভাতের ফ্যান গালছিল। এধার ওধার একটু চেয়ে নিয়ে সে বললে, “সেজোবউ কিন্তু বাঁচবে না ছোটো-মিয়েঁ!” বলেই দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবার বলতে লাগল, “ওরা মায়েপোয়েই যাবে এবার। আজ সারাদিন যা করেছে ছেলেটা! মায়ের বুকে এক ফোঁটা দুধ নাই, আজ এই সব হাঙ্গামে আবার ছাগলটাও ছেড়ে ফেলেছিলাম। ওই ছাগলের দুধই তো বাছার জান! একটুকু দুধের জন্য ছেলেটা যেন ডাঙার মাছের মতো তড়পেছে! তবু ভাগ্যিস, দারোগা সায়েবের বিবি একটুকু দুধ দিয়েছিল। তারই একটুকু রেখেছিলাম, কিন্তু ছেলে তার দু চামচের বেশি খেলে না। কেঁদে কেঁদে এই একটু ঘুমিয়েছে।” বলেই ভাতের হাঁড়িতে ঝাঁকানি দিয়ে ভাতগুলো উলটে নিয়ে মুখের সরাটা একটু ফাঁক করে পাশে রেখে দিল।
প্যাঁকালে কিছু না বলে আস্তে আস্তে উঠে বাইরে বেরিয়ে গেল।
মৃত্যুক্ষুধা – ০৬
হঠাৎ সেদিন সেজোবউয়ের অবস্থা একেবারে যায়-যায় হয়ে উঠল। ‘ছিটেন’পাড়ার নকড়ি ডাক্তার তাঁর বৈঠকখানাটা বিনি পয়সায় চুনকাম করে দেওয়ার চুক্তিতে দেখতে এলেন। বললেন, “গরিব লোক তোরা, ভিজিট আমি নেব না বাপু – আমার বৈঠকখানাটায় একটু গোলা দিয়ে দিবি, তা দিনতিনেক খাটলেই চলে যাবে! এ্যাঁ কি বলিস?”
প্যাঁকালে চোখের জল মুছে কৃতজ্ঞদৃষ্টিতে ডাক্তারবাবুর দিকে চেয়ে ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানালে।
নকড়ি ডাক্তার নাড়ি দেখে বললেন, “অবস্থা বড়ো ভালো ঠেকছে না রে, হার্টফেল করার বড্ড ভয়।”
মেজোবউ ইশারায় প্যাঁকালেকে ডেকে ফিস ফিস করে বললে, “আচ্ছা বেঁহুশ ডাক্তার তো, রোগীর কাছে তার অবস্থা এমনি করে বলে নাকি?”
নকড়ি ডাক্তার বোধ হয় ততক্ষণে মেজোবউয়ের ইশারার মানে বুঝে নিয়েছিল। তাড়াতাড়ি সে প্যাঁকালেকে ডেকে বললে, “ওরে, তোদের বাড়ি মুরগির বাচ্চা আছে তো? একটু ঝোল করে খাওয়া দেখি। এক্ষুণি চাঙ্গা হয়ে উটবে। ভাবিসনে কিছু, ও ভালো হয়ে যাবে খন।” বলেই হাই তুলে দুটো তুড়ি মেরে মেজোবউয়ের মুখের পানে হাঁ করে তাকিয়ে দেখতে লাগল। যেন গিলে খাবে! মেজোবউ একটু হেসে হেঁসেল ঘরে সরে গেল। বড়োবউ বলে উঠল, “কি লা, হাসছিস যে বড়ো!”
মেজোবউ ডাক্তার শুনতে পায় এমনই জোরেই বলে উঠল, “আখার বাসি ছাইগুলোর কিনারা হল দেখে।” বলেই একটু হেসে আবার বলে উঠল, “যেমন উনুন-মুখো দেবতা, তেমনই ছাই-পাঁশ নৈবেদ্যি।”
ডাক্তার ততক্ষণে উঠে পড়েছে। তখন রোগীর চেয়ে তার নাড়িই বেশি চঞ্চল।..
মেজোবউয়ের রূপ পাড়ার নিত্যকার আলোচনার বস্তু। দুঃখের আগুনে পুড়েও ও সোনা যেন একটুকু মলিন হয়নি। বর্ষা-ধোয়া চাঁদনির মতো আজও ঠিকরে পড়েছে রূপ। পাড়ার মেয়েরা বলে, “মাগি রাঁড় হয়ে যেন ষাঁড় হচ্চে দিন-কে-দিন।”
ওর সবচেয়ে বদ-অভ্যাস, কারণে-অকারণে ও হাসে। অপরূপ সে হাসি। – যেন ফুলের ফুটে ওঠা, যেন হঠাৎ চন্দ্রোদয়।
ডাক্তার মেজোবউয়ের শূন্য নিটোল হাত দুটি, এক জোড়া সাদা পায়রার মতো পা আর ঘোমটার অবকাশে সোনার কলসের মতো ঠোঁটসহ আধখানি চিবুক ছাড়া আর কিছু দেখতে পায়নি। কিন্তু এতেই তার নাড়ি একশো পাঁচ ডিগ্রী জ্বরের রোগীর মতোই দ্রুত চলছিল।
দোরের কাছে হঠাৎ একটু থেমে ডাক্তার বললে, “হ্যাঁরে মুরগির ডিম আছে তোদের বাড়ি? একটা ওষুধের জন্য বড্ড দরকার ছিল আমার।”
ডাক্তারবাবু চেয়েছেন, এতেই যেন প্যাঁকালে বাধিত হয়ে গেল। সে অতি বিনয়ের সঙ্গে বললে, “এজ্ঞে, তা আছে বইকী – এই এনে দিচ্ছি।” বলেই সে ঘরে ঢুকতেই মেজোবউ একটু ঝাঁজের সঙ্গেই বললে, “আন্ডা-টান্ডা পাবে না ছোটো-মিয়েঁ! বলে দাও গিয়ে, বাড়িতে আন্ডা নেই। আ মলো, মিনসে যেন কী-বলে-না-তাই। ও আন্ডা কটা বিক্রি করে একবেলার দুমুঠো ভাত উঠবে বাছাদের মুখে।”
প্যাঁকালে ততক্ষণে গোটা আটেক ডিম নিয়ে ডাক্তারের কাছে গিয়ে হাজির হয়েছে। ডাক্তার স্টেথিসকোপটা তার ঝোলা-পকেট থেকে বের করে দিব্যি খুশি হয়ে ডিমগুলি পকেটস্থ করলেন।
মেজোবউ একটু চেঁচিয়েই বললে, “ডাক্তারের গলায় ওটা কী ঝুলছে ছোটো মিয়েঁ? মিনসে কি গলায় দড়ি দিলে?”
প্যাঁকালে এবার একটু রেগেই বলে উঠল, “তুমি থামো মেজো-ভাবি, সব সময় ইয়ে ভালো লাগে না, হেঁ!”
মেজোবউ সে-কথায় কান না দিয়ে গুন গুন করে গান ধরে –
“কত আশা করে সাগর সেঁচিলাম
মানিক পাওয়ার আশে,
শেষে সাগর শুকাল মানিক লুকাল
অভাগিনির কপাল-দোষে।”
গান তো নয় – যেন বুক-ফাটা কান্না!
বড়োবউ তন্ময় হয়ে শোনে আর বলে, “সত্যি মেজোবউ, বড়ো ঘরে জন্মালে তুই জজসাহেবের বিবি হতিস।” বলেই খুব বড়ো করে নিশ্বাস ফেলে।
মেজোবউ সে-কথার কান না দিয়ে উনুন নিকুতে নিকুতে আপন মনে গেয়ে চলে। যেন তার শ্রোতা এ জগতে কেউ নয়।
“নিঠুর কালার নাম কোরো না,
কালার নাম করিলে প্রাণ কাঁদিবে
কালায় পড়িবে মনে গো!
নিঠুর কালার নাম কোরো না।”
গানের সুর তার অতিরিক্ত কাঁপে – নিশীথ রাতের বাদলা-হাওয়া যেমন করে কাঁপে বেণুবনে।
বড়োবউ সব বোঝে। তারপর ধীরে ধীরে উঠে যেতে যেতে মেজোবউয়ের কানের কাছে মুখ নিয়ে বলে, “আজ তুই চোখের পানিতে আখা নিকুবি নাকি?”
সেজোবউয়ের খোকা কেবল কাঁদে – দিবারাত্রি সে-কান্নার আর বিরাম নাই। যেন পাট পচিয়ে তার ছাল-মাংস তুলে নেওয়া হয়েছে –বাকি আছে শুধু হাড়-প্যাঁকাটি।
মেজোবউ এসে কোলে তুলে নেয়। বলে, “আহা! বাছার পিঠে ঘা হয়ে গেল শুয়ে শুয়ে।” তারপর মনে মনে বলে, “হায় আল্লা, এই দুধের বাচ্চা কী অপরাধ করেছিল তোমার কাছে? মারতেই যদি হয়, এমন কাঁদিয়ে মেরে তুলে নাও বাছাকে।” তারপর বুকে জড়িয়ে চুমো খেতে থাকে।
সেজবউ দেখে আর কাঁদে। বলে “মেজোবু, তুমিই ওর মা। আমি তো চললাম, তুমিই ওকে দেখো। আর যদি ও-ও যায় –”
আর বলতে পারে না, চোখের জলে বুক ভেসে যায়। পশ্চিমের দিকে মুখ করে সকল অন্তর দিয়ে প্রার্থনা করে, “আল্লা গো, অনেক দুষকুই দিলে, আর দিয়ো না। বাছাকে যদি নিতেই হয়, আমার দু দিন পরেই নিয়ো।”
মেজোবউ খোকাকে ঘুম পাড়াতে পাড়াতে বলে, “তুই চুপ কর সেজো! মরতে চাইলেই তোকে মরতে দেব নাকি লা? এই বেটার রোজগার খাবি, বেটার বিয়েতে নাচবি, তারপর নাতিপুতি দেখে তোর ছুটি।”– বলেই ঘুমন্ত খোকার চোখে চুমু খেয়ে বলে, “খোকার বিয়ে দিব কাজীবাড়িতে।”
আবার অকারণ হাসি! হাসিতে মুখ-চোখ যেন রাঙা টুকটুকে হয়ে ওঠে! খোকাকে তার মায়ের পাশে শোয়াতে শোয়াতে গায় –
“জাদু আমার লাঙল চষে, দুধারে তার কালো গোরু,
জাদুর বেছে বেছে বিয়ে দিব পেট মোটা মাজা সরু।”
সেজোবউ হাসে বালুচরে অস্ত-চাঁদের ক্ষীণ রশ্মিরেখাটুকুর মতো।