মৃত্যুক্ষুধা – ১৭
শেষের দিকটায় আনসার যেন কেমন অভিভূত হয়ে পড়ল। তারপর একটু সামলে নিয়ে বলতে লাগল, “আমি এখানে কেন এসেছি জানিস? জেল থেকে ফিরে এসে অবধি আমার রাজনৈতিক মতও বদলে গেছে। আমি এখন..” বলেই কী বলতে গিয়ে অপ্রতিভ হয়ে বলে উঠল, “বুঁচি, এখনও চরকা কাটিস?”
লতিফা হেসে বললে, “না দাদু, এখন আমার চারটি ছেলে মিলে আমাকেই চরকা ঘোরা করে। এখন আপনার চরকাতে তেল দিবার ফুরসত পাইনে, তা দেশের চরকা ঘুরাব কখন।”
আনসার হেসে বললে, “হুঁ, এখন তাহলে চরকার সুতো ছেড়ে কোলের সুতদের নিয়েই তোর সংসারের তাঁত চালাচ্ছিস। দেখ, ও ল্যাঠা ছেড়ে দিয়ে ভালোই করেছিস ভাই। আমি এখনই বলছিলাম না যে, আমার মত বদলে গেছে। এখন আমার মত শুনলে তুই হয়তো আকাশ থেকে পড়বি। বাঁক বোঝাই করে করে চরকা বয়ে বয়ে যার কাঁধে ঘাঁটা পড়ে গেছে, তোর সেই চরকা-দাদু আনসারের মত কী শুনবি? সে বলে, সুতোয় কাপড় হয়, দেশ স্বাধীন হয় না।”
লতিফা সত্যি সত্যি এবার হেসে গড়িয়ে পড়ল। সে বললে, “বল কী দাদু! ওরে বাবা, চরকা নিয়ে ঠাট্টা করার জন্য তুমি নাকি মাহ্মুদকে একদিন কান ধরে সারা ঘর নাক ঘেঁষড়ে নিয়ে গিয়েছিলে! ওমা, কী হবে! শেষে কিনা তুমি চরকায় অবিশ্বাসী হলে?”
আনসার এক গাল পান মুখে দিয়ে বললে, “সত্যি তাই। আমি আজ মনে করি যে, আর সব দেশ মাথা কেটে স্বাধীন হতে পারছে না, আর এ দেশ কি সুতো কেটে স্বাধীন হবে?”
নাজির সাহেব বললেন, “দোহাই দাদা, ও মাথা কাটার কথাটা যেখানে-সেখানে বলে নিজের কাঁচা মাথাটাকে আর বিপদে ফেলো না!”
আনসার হেসে বললে, “তার মানে, কোনো এক শুভ প্রভাতে মাথাটা দেহের সঙ্গে নন-কো-অপারেশন করে বসবে – এই তো? তা ভাই, যে দেশের মাথাগুলো নোয়াতে নোয়াতে একেবারে পায়ের কাছে এসে ঠেকেছে, সে-দেশের দু একটি মাথা যদি খাড়া হয়ে থেকে তার ঔদ্ধত্যের শাস্তিস্বরূপ খাঁড়ার ঘা-ই লাভ করে তাহলে হেঁট মাথাগুলোর অনেকখানি লজ্জা কমে যাবে মনে করি।”
লতিফা বললে, “চুলোয় যাক তোমাদের রাজনীতি! এখন আমি বলি দাদু, তুমি চিরকালটা এমনই ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়িয়েই কাটাবে?”
আনসার হেসে বলল, “চুলোয় আমার চরকাকে দিয়েছি – রাজনীতিটা দিতে পারব না বোধহয়। তুই ভুল বললি বুঁচি, আমি ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়াইনি। বনের খেয়েই বনের বাঘ তাড়াচ্ছি! ঘরের খাওয়া আমার রুচল না, কী করবি, কপাল!”
লতিকা হাল ছেড়ে দিয়ে বললে, “যাক তুমি কারুর কথাই কোনোদিন শোননি, আজও শুনবে না। তাই ভাবছি, কী করে আমাদের মনে করে এখানে এলে!”
আনসার বললে, “আমি চিরকালই ঠিক আছি। একেবারে বিনা কাজে আসিনি আগেই বলেছি। এখানে একটা শ্রমিক সংঘ গড়ে তুলতে এসেছি। প্রত্যেক জেলায় আমাদের শ্রমিক সংঘের একটা করে শাখা থাকবে। আপাতত সেই মতলবে ঘুরে বেড়াচ্ছি সব জায়গায়। এখানে হয়তো মাসখানেক বা তারও বেশি থাকতে হবে। এই তো ময়মনসিংহ-এ দু মাস থেকে এলাম।”
লতিফা ছেলেমানুষের মতো খুশি হয়ে নেচে উঠে বললে, “সত্যিই দাদু! তুমি এখানে অতদিন থাকবে? বাঃ বাঃ! কী মজাটা না হবে তাহলে। আমি আজই চিঠি দিচ্ছি খালা-আম্মাকে– তাঁরা সব এসে আমাদের এখানে থাকবেন এখন কিছুদিন। দাদু, লক্ষ্মীটি, এক মাস না দু মাস, কেমন?”
আনসার হেসে ফেলে বললে, “তুইতো খোকার মা হয়েও আজও খুকিই আছিস দেখছি রে। চিঠি লেখ, তাতে আমার আপত্তি নেই, কিন্তু আমি আমার কাজ নিয়ে এত ব্যস্ত থাকব যে, তোদের সঙ্গে হয়তো সারাদিনে একবার দেখা করতেই পারব না! আমি এখানে থাকলেও তো তোদের এখানে থাকতে পারব না! নাজির সাহেবের পিছনে টিকটিকি লেগে একেবারে না, নাস্তানাবুদ করে ছাড়বে।”
লতিফার হাস্যোজ্জ্বল মুখ এক নিমেষে ম্লান হয়ে গেল, –শিশুর হাতের রংমশাল জ্বলে নিবে যাওয়ার পর তার দীপ্ত মুখ যেমন নিরুজ্জ্বল হয়ে ওঠে – তেমনই!
মৃত্যুক্ষুধা – ১৮
এরপর দু তিন দিন কেটে গেছে। এবং এই দু তিন দিন আনসার গোরুর গাড়ির গাড়োয়ান, ঘোড়ার গাড়ির কোচোয়ান, রাজমিস্ত্রি, কুলি-মজুর, মেথর প্রভৃতিদের নিয়ে টাউনে একটা রীতিমতো হুলস্থুল বাধিয়ে তুলেছে। শহরময় গুজব রটে গেছে যে, রাশিয়ার বলশেভিকদের গুপ্তচর এসেছে লোক খ্যাপাতে। সরকারি কর্তাদের মধ্যেও এ নিয়ে কানাঘুষা চলেছে। ম্যাজিস্ট্রেট, পুলিশ, মিউনিসিপ্যালিটি, এমনকী কংগ্রেসওয়ালারা পর্যন্ত আনসারকে কেমন বাঁকা চোখে বাঁকা মন দিয়ে দেখতে শুরু করেছে। সেদিকে আনসারের ভ্রুক্ষেপও নাই। সে সমান উদ্যমে মোটরের চাকার মতো ঘুরে বেড়াচ্ছে।
সেদিন সন্ধ্যায় বসে চা খেতে খেতে আনসার কেবলই অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছিল। গল্প সেদিন কিছুতেই জমছে না দেখে নাজির সাহেবও কেমন বিমনা হয়ে যাচ্ছিলেন। আনসার এ-কয়দিন ঝড়ের মতো এসে নাকে-মুখে যা পেয়েছে দুটো গুঁজে দিয়ে আবার তার কুলি-মজুর, মেথর-চাঁড়ালদের বস্তিতে ঘুরছে। লতিফা রাগ করে অভিমান করে কেঁদেও কিছু করতে পারেনি। আনসার হেসে শুধু বলেছে, “পাগলি!” সে-হাসি এমন করুণ, এমন বেদনামাখা, আর ওই একটি কথা এমন স্নেহ-সিঞ্চিত সুরে বিজড়িত যে, তারপর লতিফা আর একটি কথাও বলতে পারেনি। বেদনা সে যতই পাক, তার বুক সঙ্গে সঙ্গে এই গর্বেও ভরে উঠেছে যে, তার এই ছন্নছাড়া ভাইটি সর্বহারা ভিখারিদের জন্যই আজ পথের ভিখারি। তাকে কাঙাল করেছে এই কাঙালদের বেদনা। গর্বে কান্নায় তার বুকের তলা দোল খেয়ে উঠল।
আজ সন্ধ্যায় অপ্রত্যাশিতভাবে আনসার এসে চা চেয়ে যখন ইজিচেয়ারটায় ক্লান্তভাবে শুয়ে পড়ল, তখন লতিফা খুশি যেমন হল, তেমনই আনসারের ওই ক্লান্তস্বরে কেমন একটু অবাকও হয়ে গেল। এমন বিষাদের সুর তার কণ্ঠে সে কোনোদিন শুনেনি।
চা এনে যখন সে পায়ের কাছটিতে বসে পড়ল, তখন নাজির সাহেব আপনার মনেই রাজ্যের মাথামুণ্ডুহীন কীসব বকে চলেছেন, আর আনসার মাঝে মাঝে আনমনে হুঁ দিয়ে যাচ্ছে।
লতিফা হেসে বললে, “আচ্ছা বেহুঁশ লোক যাহোক তুমি! কাকে বলছ আর কে শুনছে তোমার কথা, বলো তো! কী ভাবছ দাদু, এমন করে?”
নাজির সাহেব বেচারা মাথা চুলকে চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বলে উঠলেন, “অ! উনি আমাদের হবু ভাবি সাহেবের কথা ভাবছেন! আরে, আগে থেকে বলতে হয়? তাহলে কি আর এমন সময় এ বদরসিকতা করি! কিন্তু ভাই, তোমার এই মেথর-মুর্দাফরাশ-ভরা মনে যে কোনো সুন্দর মুখ উঁকি দিতে পারবে – সে ভরসা করতে কেমন যেন ভরসা পাচ্ছিনে।”
আনসারের মুখে একটু ক্ষীণ হাসি দেখা দিল, কি দিল না। সে একমনে চা খেয়ে যেতে লাগল। চায়ের প্রসাদে ততক্ষণে তার বিষণ্ণতা অনেকটা কেটে গেছে।
লতিফা নাজির সাহেবকে ধমক দিয়ে বলে উঠল, “তুমি থামো তো একটু! সত্যি দাদু, লক্ষ্মীটি, বলো না – আজ তুমি এমন চুপচাপ কেন?”
নাজির সাহেব অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে নেপথ্য বলার মতো করে উঠলেন, “বাঁদরকে কে পুয়াল-চাপা দিলে! ইয়া আল্লাহ্! আল্লাহু আকবর!”
লতিফা ভুরু বাঁকিয়ে খর চোকে তাকিয়ে বলে উঠল, “আবার!”
এইবার আনসার হেসে ফেলে বললে, “নাঃ, আর আমায় গম্ভীর হয়ে থাকতে দিলিনে দেখছি, বুঁচি!”
মেঘ অনেকটা কেটেছে দেখে লতিফা খুশি হয়ে আবদারের সুরে বলে উঠল, “কী ভাবছিলে এতক্ষণ, বলো না, দাদু!”
আনসার চায়ের প্রথম কাপটা শেষ করে দ্বিতীয় কাপটার চুমুক দিয়ে বললে, “যাঃ! ও কিছু না! এমনই কী যেন একটু ভাবছিলাম। দেখ বুঁচি, এ-দেশের কিচ্ছু হবে না।”
লতিফা চালাক মেয়ে। আনসার এড়িয়ে চলতে চাইছে দেখে সেও বাঁকা পথ অবলম্বন করলে। আনসারের ও-কথার উত্তর না দিয়ে সে সোজা প্রশ্ন করে বসল, “আচ্ছা দাদু, রুবির খবর জান কিছু?”
আনসার চমকে উঠল। সে এর জন্য প্রস্তুত ছিল না। দু তিন চুমুকে চা খেয়ে অন্য দিকে চেয়ে সে আস্তে আস্তে বলল, “এইবার তার সাথে দেখা হয়েছিল রে বুঁচি।”
লতিফা আরও সরে এসে বললে, “কোথায় দাদু? তোমায় দেখে সে নিশ্চয়ই চিনতে পারলে। কী বললে দেখে? তুমি কী করে চিনলে তাকে?”
আনসার ম্লান হাসি হেসে বললে, “দেখা হল ময়মনসিংহে। চিনতে দেরি না হলেও বিশ্বাস করতে দেরি হয়েছিল আমার। বেশ একটু দেরি…” বলেই আনসার দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবার দু চুমুক চা খেয়ে শান্তস্বরে বললে, “আমি ছাত্রদের একটা মিটিং-এ বক্তৃতা দিচ্ছিলাম। বহু মহিলাও উপস্থিত ছিলেন সে মিটিং-এ। ওরই মধ্যে দেখি একটি বিধবা মেয়ে দু-হাতে চিক সরিয়ে আমার দিকে চেয়ে আছে। আমি চোখ ফিরিয়ে নিলাম। ভালো বক্তৃতা দিতে পারি বলে শহরময় রাষ্ট্র হয়ে গেছিল, কিন্তু সেদিন স্পষ্টই বুঝলাম, আমার বক্তৃতা শুনে কেউ খুশি হয়ে উঠছেন না। আমার ছাত্র-বন্ধুরা হতাশ হয়ে মুখ-চাওয়া-চাওয়ি করতে লাগল। আমার কথা তখন কেবলই জড়িয়ে যাচ্ছে।”
লতিফা রুদ্ধনিশ্বাসে শুনছিল বললে ঠিক বলা হয় না – গিলছিল যেন সব কথা। সে কান্না-দীর্ণ কণ্ঠে বলে উঠল, “রুবি বিধবা হয়েছে, দাদু?”
আনসার চায়ের কাপটায় ঝুঁকে পড়ে মুখটা আড়াল করে বললে, ‘হুঁ!’
মনে হল, সে বুঝি আর কিছু বলতে পারবে না। কেউ একটি কথাও বললে না, কেমন একটা বেদনাময় বিষণ্ণতায় সকলের মন আচ্ছন্ন হয়ে উঠল। মেঘলা দিনের সন্ধ্যা যেমন নামে বন্ধুহীনের বিজন ঘরে।
চা তখন ঠাণ্ডা হিম হয়েও গেছে। তারই সবটা ঢক ঢক করে খেয়ে ফেলে আনসার একটু অধিক সহজ সুরে বললে, “তারপর দেখা হল – অনেক কথাও হল রুবির সাথে-রুবির বাবা-মার সাথে। – রুবির বাবা যে এখন ময়মনসিংহের ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট রে বুঁচি!”
কিন্তু বুঁচি কিছু বলবার আগেই সে বলে যেতে লাগল, “রুবির বাবা অবশ্য ভয়ে ভয়েই আমার সঙ্গে কথাবার্তা কইলেন। ওর মা কিন্তু তেমনই আদর-যত্ন করলেন আমায়। আমার সঙ্গে কথা বলতে বলতে তাঁর চোখ বারে বারে জলে ভরে উঠেছিল।
লতিফা অসহিষ্ণু হয়ে বলে উঠল, “রুবি কী বললে, বলো না দাদু!”
আনসার হেসে ফেলে বললে, “বলছি থাম। রুবির বিয়ে হয়েছিল একটি আই.সি.এস. পরীক্ষার্থী ছেলের সাথে। ছেলেটি আমারই সহপাঠী ছিল – অবশ্য আমার বন্ধু ছিল না – নাম তার মোয়াজ্জম। বিলেতে যাওয়ার আগেই বিয়ের এক মাসের মধ্যেই সে মারা যায়। সে আজ এক বছরেরও বেশি হল। বিয়ের আগেই রুবি ম্যাট্রিক পাশ করেছিল। এবার প্রাইভেটে আই.এ.দেবে। মনে হল ওর বাপ-মায়ের ইচ্ছা, ওকে এই লেখাপড়ার মধ্যেই ডুবিয়ে রাখেন। এর জন্য যথেষ্ট খরচও করছেন তাঁরা। রুবিও খুব মন দিয়ে পড়ছে শুনলাম।”
বলে খানিক চুপ করে থেকে আনসার বললে, “রুবির অন্তরের কথা অন্তর্যামী জানেন, তবে এই বৈধব্য তাকে বড়ো বেদনা দিতে পারেনি – এটা বেশ বোঝা গেল। স্বামীকে সে চেনেনি – আমার যেন মনে হল, তাকে সে চিনবার চেষ্টাও করেনি। তার পড়বার ঘরে তার স্বামীর একটা ফটো পর্যন্ত নেই। অথবা সে যে বিধবা, একটু চেষ্টা করেই সে এ-কথা যেন জানাতে চায় তার আচার-ব্যবহার পোশাক-পরিচ্ছদে। তার মা-বাবা কিছুতেই তাকে পাড়ওয়ালা কাপড় বা গয়না পরাতে পারেনি। পরে সাদা থান, জুতা পরে না, পান খায় না, –যাকে বলে সর্বপ্রকারে নিরাভরণা, কিন্তু এই নিরাভরণা, রুক্ষবেশে তাকে যে কী সুন্দর দেখায় রে বুঁচি, তা যদি একবার দেখতিস! বৈধব্যের এত রূপ আর আমি দেখিনি!”
বলেই নিজের এই প্রশংসা-উক্তিতে লজ্জিত হয়ে সে নিম্নস্বরে বললে, “কিন্তু বুঁচি, ও রূপকে ভক্তি করা যায়, ভালোবাসা যায় না!”
নাজির সাহেবফোঁস করে একটা কৃত্রিম দীর্ঘশ্বাস ফেলে তাঁর ক্লিনসেভড গালের চিবুকের কল্পিত দাড়িতে বামহাত বুলোতে বুলোতে বলে উঠলেন, “সোবহান-আল্লাহ্! সোবহান-আল্লাহ্!’
লতিফা ও আনসার দুজনেই এক সঙ্গে হেসে উঠল। আনসার নাজির সাহেবের ঘাড়ে এক রদ্দা মেরে বলে উঠল, “আরে বে-অকুফ! এর মধ্যে লভটভের কিছু গন্ধ নেই!”
নাজির সাহেবের ঘাড়ে হাত বুলোতে বুলোতে বলেলেন, “দেখ ভাই তারকেশ্বরের ষাঁড়! এ ঘাড়ে এমন করে ধাক্কা মেরো না! এই ঘাড়ই হচ্ছে তোমার বোনের সিংহাসন। এ-ঘাড়ই যদি ভাঙে তা হলে উনি চড়বেন কোথায়?”
লতিফা হেসে বললে, “শ্যওড়া গাছে! বেস, আমি পেতনিই হলাম। এখন গোলমাল যদি কর, সত্যিই ভেঙে দেব! বলো ভাই দাদু, ,তারপর কী হল?”
আনসার বললে, “জানিস, একদিন আমি সোজা রুবিকে বললাম যে, এতটা বাড়াবাড়ি না করলেও সে যে বিধবা, তা বুঝবার কষ্ট হত না কারুর। সে বললে কী, জানিস? সে বললে, যে, সে তার বাপ-মাকে শাস্তি দেওয়ার জন্যই অমন করে থাকে। তার ঘোর আপত্তি সত্ত্বেও নাকি তার বিয়ে দিয়েছিলেন তাঁরা, এবং আবারও বিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছেন তলে তলে – তার মতামতের অপেক্ষা না রেখেই। সে একদিন তার মায়ের সামনেই আমায় বললে, “দেখ আনু ভাই, যাকে কোনোদিনই জীবন স্বীকার করিনি কোনো-কিছু দিয়ে হতভাগ্যের মৃত্যু-স্মৃতি আমায় বয়ে বেড়াতে হবে সারাটা জিন্দেগি ভরে – নিজেকে এই অপমান করার দায় থেকে কী করে মুক্তি পাই, বলতে পার?”
আমি শিউরে ,উঠলাম। বললাম, “তাই যদি সত্যি হয় রুবি, তবে এ-অপমান শুধু তোমাকে নয় – সেই মৃত হতভাগ্যকেও গিয়ে লাগছে। এ-নিষ্ঠুরতা করে কারুর কোনো মঙ্গল হবে না রুবি।”
রুবি তিক্তকণ্ঠে বলে উঠলে, “একে শুধু তুমিই নিষ্ঠুরতা বলতে পারলে। কিছু মনে কোরো না আনু ভাই – অতি বড়ো নিষ্ঠুর ছাড়া আর কেউ এত বড়ো কথা আমায় বলতে পারত না। তুমি শুধু এর নিষ্ঠুর দিকটাই দেখলে? যে নিষ্ঠুর করে তুলেছে আমায় তাকে দেখলে না!”
বলেই সে চলে যেতে যেতে বলে গেল, “ফুল শুকিয়ে গেছে, কিন্তু কাঁটা তো আছে! ফুল থাকলে বুকে মালা হয়ে থাকত, এখন কাঁটা – কেবল পায়ের তলায় বিঁধবে!”
“এর পরেও কত দিন দেখা হয়েছে, কথাও হয়েছে – কিন্তু আমি আর সাপের ন্যাজে পা দিতে সাহস করিনি। একেবারে কাল-কেউটে!”
লতিফা একটু উত্তেজিত স্বরেই বলে উঠল, “কিন্তু তুমি চিনবে না দাদু, তুমি সত্যিই লক্ষ্মীছাড়া! ছোবল মারলেও ওর মাথায় মণি আছে। সাপের মাথার মণি সাতরাজার ধন, তা কি যে-সে পায়?”
বলেই সে চোখ মুছল! আনসার কেমন যেন নেতিয়ে পড়ল।
আজ কেন যেন তার প্রথম মনে হল সে সত্যিই দুঃখী। মানুষের শুধু পরাধীনতারই দুঃখ নাই, অন্য রকম দুঃখও আছে – যা অতি গভীর, অতলস্পর্শী! নিখিল-মানবের দুঃখ কেবলই মনকে পীড়িত, বিদ্রোহী করে তোলে, কিন্তু নিজের বেদনা – সে যেন মানুষকে ধেয়ানী স্বস্থ করে তোলে। বড়ো মধুর, বড়ো প্রিয় সে-দুঃখ!
সে হঠাৎ বলে উঠল, “যেদিন আমি চলে আসি, বুঁচি, সেদিন সে স্টেশনে এসেছিল। ট্রেন যখন ছাড়ে, তখন আমার হাতে একটা জিনিস দিয়ে বললে, “এইটে বিয়ের রাতে – তোমায় মনে করে গেঁথেছিলাম। আজ শুকিয়ে গেছে, তবু তোমায় দিলাম।” – বলেই সে টলতে টলতে চলে গেল!
“ট্রেন ছাড়লে দেখলাম, একটি শুকনো মালা!”
নাজির সাহেব বলে উঠলেন, “কী করলি ভাই, সে মালটা?”
আনসার ধরা গলায় বলে উঠল, “পদ্মার জলে ফেলে দিয়েছি।”
লতিফা একটি কথাও না বলে আস্তে আস্তে উঠে গেল।