হারুণ কিন্তু যে ভয় করিতেছিল, তাহার কিছুই হইল না। কেহ তাহাদের গাড়ি সার্চ করিল না। হারুণ দেখিল, প্ল্যাটফর্ম মিলিটারি পুলিশে ও গোরায় ছাইয়া ফেলিয়াছে। কয়েকজন যুবককে ধরিয়া তাহারা প্রিজনার-ভ্যানে পুরিল, তাহাও সে দেখিল। ভয়ে তাহার মুখ কাগজের মতো সাদা হইয়া গেল।
সে দেখিল ধৃত বন্দিদের মধ্যে জাহাঙ্গীর নাই। সে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলিল।
হারুণ জাহাঙ্গীরের মাতাকে জাহাঙ্গীরের উপদেশ মতোই সব কথা বলিয়াছিল। সে যে বিপ্লবীদলের, সে কথা সে গোপন করিয়া গেল।
দেওয়ান সাহেব ভ্রু-কুঞ্চিত করিয়া কী চিন্তা করিতে লাগিলেন। জিনিসপত্র গাড়িতে উঠাইয়া দিয়া দেওয়ান সাহেব বলিলেন, ‘আমি পুলিশ-কমিশনার সাহেবের কাছে যাচ্ছি। যেমন করে হোক ওর কিনারা করে তবে জলগ্রহণ করব।’
জাহাঙ্গীরের মাতা সাশ্রুনেত্রে দেওয়ান সাহেবের দিকে তাকাইয়া থাকিলেন। কিছু বলিতে পারিলেন না।
মাঝে মাঝে কেবল হারুণের উন্মাদিনী মাতা কাঁদিয়া উঠিতে লাগিলেন, ‘মিনা! মিনা কোথায় গেল আমার? সে আর ফিরবে না। আবার পালিয়ে গেল!’
এত আনন্দের মাঝে সহসা যেন ঝড় উঠিয়া সমস্ত লন্ডভন্ড হইয়া গেল।
জাহাঙ্গীরের মাতা কাঁদিলেন না। ঝড় উঠিবার পূর্বে প্রকৃতি যেমন শান্ত গম্ভীর মূর্তি ধারণ করে – তেমনি বিষাদ-ঘন মূর্তি লইয়া বাড়িতে আসিয়া উঠিলেন।
কাহারও মুখে কথাটি নাই। জাহাঙ্গীরের মাতা আদর করিয়া হারুণদের সকলকে বাড়িতে উঠাইয়া সকলের ব্যবস্থা করিতে লাগিলেন। মুখরা মোমি এবং মোবারক পর্যন্ত কথাটি কহিতে সাহস পাইল না।
দ্বিপ্রহরে দেওয়ান সাহেব ফিরিয়া আসিলেন। তাঁহার মুখ চোখ দেখিয়া জাহাঙ্গীরের মাতা ভয় খাইয়া গেলেন। তাঁহার মাথা ঘুরিতে লাগিল। কোনো রকমে দেয়াল ধরিয়া দাঁড়াইয়া বলিলেন, ‘দেওয়ান সাহেব! আমার খোকা?’
দেওয়ান শান্ত গম্ভীর স্বরে বলিলেন, ‘বিপ্লবীদের সাথে সে ধরা পড়েছে! হতভাগ্য!…’ তিনি আর বলিতে পারিলেন না। তাহার কণ্ঠ রুদ্ধ হইয়া গেল!
জাহাঙ্গীরের মাতা সকালে উঠিয়াই সমস্ত সংবাদপত্র আনাইয়া পড়িয়াছিলেন। এই দুই দিনের মধ্যে বাংলাদেশে যে ভীষণ ওলট-পালট হইয়া গিয়াছে – তাহাও তিনি জানিতে পারিয়াছেন সংবাদপত্র পড়িয়াই।
শত শত যুবক কারারুদ্ধ হইয়াছে। সেই ভীষণ জার্মান ষড়যন্ত্র প্রকাশ হইয়া পড়িয়াছে। সারা দেশ ব্যাপিয়া পুলিশ জাল ফেলিয়াছে! –
কাজেই দেওয়ান সাহেবের এই সংবাদ তিনি বজ্রাহতের মতো কিছুক্ষণ দাঁড়াইয়া থাকিয়া মূর্ছিত হইয়া পড়িয়া গেলেন। দাসী-বাঁদিরা যে যেখানে ছিল ছুটিয়া আসিল!…
কুহেলিকা – ২০ (শেষ)
বজ্রপাণি, প্রমত্ত প্রভৃতির সাথে জাহাঙ্গীরেরও দ্বীপান্তর হইল। তাহার সত্যকার নাম প্রকাশ পাইল না। জাহাঙ্গীর তাহার নাম বলিয়াছিল স্বদেশকুমার। সেই নামেই তাহার শাস্তি হইয়া গেল।
ফিরদৌস বেগম ও দেওয়ান সাহেব লক্ষাধিক টাকা খরচ করিয়াও তাহাকে বাঁচাইতে পারিলেন না।
যেদিন জাহাঙ্গীরের বিচার হইয়া গেল সেইদিন সন্ধ্যায় মাতা তাহার সহিত আলিপুর জেলে গিয়া দেখা করিলেন। মাতা আর সেখানে কাঁদিলেন না। শুধু বলিলেন ‘খোকা, তুই তো চললি, তোর এই ঐশ্বর্য কাকে দিয়ে যাব?’
জাহাঙ্গীর বলিল, ‘তুমিও কি চলে যাবে মা?’
মাতা শান্তস্বরে বলিলেন, ‘তুই তো আমায় থাকতে দিলিনে। আমি মক্কা গিয়ে একবার কাবা ঘরের ধুলায় লুটিয়ে পড়ে জিজ্ঞাসা করব খোদাকে – কেন তিনি এত বড়ো শাস্তি দিলেন?’
জাহাঙ্গীর বলিল, ‘আর তো তোমাকে নিষেধ করবার অধিকার আমার নাই মা। তুমি যেখানে গিয়ে শান্তি পাও, যাও। যদি ফিরে আসি, আর তুমি বেঁচে থাক, দেখা হবে!’… বলিয়াই একটু ভাবিয়া বলিল, ‘চম্পা এসেছিল তোমার কাছে?’
মাতা বলিলেন, ‘এসেছিল, কিন্তু আমি তাকে তাড়িয়ে দেয়েছি!’
জাহাঙ্গীর বলিল, ‘ভুল করেছ মা, ও ঐশ্বর্যের মালিক যদি আমিই হই, তাহলে ওই ঐশ্বর্যের ভার তারই হাতে ছেড়ে দিয়ো! আমার মার মতো শত শত মা আজ নিরন্ন, তাঁদের মুখে তাঁদের সন্তানের মুখে সে অন্ন দেবে। ও ঐশ্বর্য এখন আমার দেশের নির্যাতিত ভাই-বোনদের। এবার সে এলে তাকে ফিরিয়ো না। হাঁ, ভূণীকে আমার সম্পত্তির এক চতুর্থাংশ ছেড়ে দিয়ো। ও অনেক দুঃখ পেয়েছে।’
মা কিছুক্ষণ ভাবিয়া শান্তস্বরে বলিলেন, ‘আচ্ছা তাই হবে।’ তিনি অধর দংশন করিয়া কান্নার বেগ সামলাইতে লাগিলেন।
মাতার সহিত সকলেই আসিয়াছিল। জাহাঙ্গীর হাসিয়া হারুণের দিকে চাহিয়া বলিল, “তোমার কথাই সত্য হল কবি, নারী ‘কুহেলিকা’।” হারুণ কাঁদিয়া ফেলল।
ভূণী মূর্ছিতা হইয়া পড়িয়া গেল। তাহার মুখ দিয়া কেবল একটা শব্দ নির্গত হইল, ‘নিষ্ঠুর’।
জেলের ভিতর পাগলা ঘন্টি বাজিয়া উঠিল। জেল ভাঙিয়া কয়েকজন রাজবন্দি পলাইয়াছে।
স-ওয়ার্ডার জেলার আসিয়া জাহাঙ্গীরকে লইয়া চলিয়া গেল।
মাতা সেইখানে পড়িয়া কাঁদিয়া উঠিলেন, ‘খোকা! আমার খোকা!’
॥ সমাপ্ত ॥