জাহাঙ্গীর চম্পার সেই তেজোব্যঞ্জক অপরূপ রূপমাধুরী দেখিতে দেখিতে উন্মত্ত হইয়া উঠিল। সে চম্পাকে সহসা বুকে চাপিয়া আর্তস্বরে বলিয়া উঠিল, ‘চম্পা, চম্পা! আমায় বাঁচাও! হয় আমায় একেবারে রসাতলে – যে পাঁক থেকে উঠেছি সেই পাঁকে ছুঁড়ে ফেলে দাও, নয় আমায় ঊর্ধ্বে নিয়ে চলো হাত ধরে।’
চম্পা রহস্য-ভরা হাসি হাসিয়া বলিল, ‘তোমায় বাধা দেব না। জানি আগুনের তৃষ্ণা কত প্রবল। কিন্তু কী হবে এ করে? আমার পিনাকীদা গেছে, মা গেছেন, প্রমতদাও গেছেন। আমি দিব্যচক্ষে দেখতে পাচ্ছি, বজ্রপাণির দলের হয়তো একজনও আর বাইরে নেই। আমি আজ তোমার কাছে আত্মসমর্পণ না করি, কাল করতে হবে। কারণ, তুমি ছাড়া পৃথিবীতে আমার তো আর কোনো অবলম্বনই নাই। আমিও তো রক্ত-মাংসের মানুষ – আর তোমাদেরই মতো পশুত্ব দিয়ে পশুকে জয় করার সাধনা আমার। লোভ তৃষ্ণা তোমাদের কারুর চেয়ে আমার কম নেই। কিন্তু, এর যে একটামাত্র পথ খোলা ছিল – সে পথও তো তুমিই বন্ধ করেছ!… তোমার মায়ের টাকা আছে, তুমি হয়তো বেঁচে গেলেও যেতে পার – কিন্তু তাতে আমার কী? আমি কি তোমার দেবদাসী হয়ে থাকব? জাত ধর্ম আমি মানিনে, সে শিক্ষাই পাইনি জীবনে। কিন্তু আমার নারী ধর্ম তো আছে। তাকে আজ যদি বিসর্জন দিই, কাল তুমি আমাকে ছুঁড়ে ফেলে দেবে – যেমন করে ভূণীকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছ! তোমাকে বলতে আমার লজ্জা নেই – তোমাকে দেখেই আমার ভালো লেগেছিল। তরুণ অরুণের মতো যেদিন তুমি এসে আমাদের আঙিনায় দাঁড়িয়েছিলে তোমার প্রখর দীপ্তি নিয়ে – সেইদিন থেকে তোমায় সকল প্রাণ মন দিয়ে শ্রদ্ধা করে আসছি। মরণোন্মুখ তৃষ্ণাতুর তুমি এসে দাঁড়িয়েছ – তোমাকে অদেয় আমার কিছুই নেই – তবু ওইটুকুর বিনিময়ে আমার এমন অমূল্য শ্রদ্ধাটুকু কেড়ে নিয়ো না। তুমি ভূণীকে বিয়ে করে সুখী হও, আমি তোমাদের ভগিনীর স্নেহে সেবা করব, – যত্ন করব, তার পর মা যদি ফেরেন – মার কোলে ফিরে যাব!…’ চম্পা সহসা কাঁদিয়া ফেলিল!
জাহাঙ্গীর চম্পাকে বুকের আরও কাছে টানিয়া লইয়া আদরে অভিষিক্ত করিয়া সান্ত্বনা দিতে দিতে বলিতে লাগিল, ‘তুমি ঠিকই বলেছ চম্পা। আগুনের আকুল তিয়াসা তো মিটবার নয়। তৃষ্ণা কেবল বেড়েই চলবে? পশুর পশু-জন্ম সার্থক হয় দেবীর বেদিতলে তার বলিদান হয়ে গেলে।… জীবনে কাউকে ভালোবাসিনি, কারুর ভালোবাসা পাইনি, আজ তাও যখন পেয়ে গেলুম দৈববলে – তখন তো আমি বেঁচে গেলুম।… আমি আমার কর্তব্য ঠিক করে ফেলেছি চম্পা, তোমাকে মার হাতে সঁপে দিয়ে – যে তুফান উঠেছে তাতেই ঝাঁপিয়ে পড়ব প্রমতদার মতো।… আমার যে ঐশ্বর্য রইল – তাতে তোমাদের এ জীবনে শান্তি ছাড়া আর কোনো কিছুর অভাব হবে না। আমি আমার সকল ঐশ্বর্য তোমায় দিয়ে যাব। তুমি আমার হয়ে ওই ঐশ্বর্য দেশ-জননীর দুঃখী সন্তান আর ভাই-বোনদের বিলিয়ে দিয়ো।’
চম্পা দুই হাতে জাহাঙ্গীরকে জড়াইয়া বালিকার মতো কাঁদিতে লাগিল। হঠাৎ যেন পাহাড় ফাটিয়া ঝরনা ধারার বাঁধ টুটিয়া গিয়াছে।
জাহাঙ্গীর ধীর শান্তস্বরে বলিতে লাগিল, ‘আমি জীবনে ভাবিনি – নারীজাতিকে কখনও শ্রদ্ধা করতে পারব – তাদের ভালোবাসতে পারব – তাদের প্রেমে বিশ্বাস করব।…. আজ আমার কাছে এই পাপের পৃথিবীও সুন্দর হয়ে উঠেছে। আমার মরুভূমির ঊর্ধ্বে মেঘের স্বপন ভেসে উঠেছে! ফুল ফুটল না সে মরুভূমিতে – দুঃখ করিনে তার জন্য। আমার চিরদগ্ধ বুক তো শীতল হল।’
সূর্যমুখী যেমন করিয়া অস্ত-সূর্যের পানে চায়, তেমনি করিয়া মুখ তুলিয়া চম্পা বলিল, ‘তোমার ঐশ্বর্যের অভিশাপ আমায় দিয়ে যেয়ো না, ও আমি সহ্য করতে পারব না। সবাই তো আমায় ছেড়ে গেল, তুমি যেয়ো না।’
জাহাঙ্গীর চম্পার চক্ষু মুছাইয়া দিতে দিতে বলিল, ‘তোমাকে তো দিয়ে যাব না ওসব চম্পা। আমার মতো যেসব যুবক দেশ-জননীর পায়ে আত্মবলি দিয়ে তাদের আত্মীয়স্বজনকে অকূল পাথারে ভাসিয়ে গেল, তাদের নিরন্ন মুখে দু-মুঠো অন্ন তুলে দেওয়ার ব্রত হবে তোমার। তুমি হবে তাদের দেবী অন্নপূর্ণা।’
ট্রেন একটি স্টেশনে থামিতেই চম্পা বাহিরে মুখ বাড়াইয়া বলিয়া উঠি, ‘ওঠো ওঠো, রানিগঞ্জে এসে পৌঁচেছি। মাত্র দু-মিনিট স্টপেজ।’
নামিয়া ট্যাক্সি ঠিক করিতে আরও আধ ঘণ্টা কটিয়া গেল। যখন তাহারা যাত্রা করিল, তখন রাত্রি দুইটা।
মোটর চলিতে আরম্ভ করিলে জাহাঙ্গীর এলাইয়া পড়িয়া বলিল, ‘আমার কী মনে হচ্ছে চম্পা, জান? যেন এ পথের আর শেষ না হয়! যুগ-যুগান্তর ধরে শুধু তোমায় পাশে নিয়ে এমনি করে ছুটে চলি।’
চম্পা কথা কহিল না। চক্ষু বুজিয়া কী যেন ভাবিতেছিল। কেহ আর কোনো কথা কহিল না। গাড়ি উল্কাবেগে ছুটিতে লাগিল, মোটর হাওড়া ব্রিজের মোড়ে আসিতেই হঠাৎ চার পাঁচজন সার্জেন্ট গাড়ি আগুলিয়া দাঁড়াইয়া মোটর থামাইবার আদেশ করিল।
জাহাঙ্গীর ও চম্পা জ্যা-ছিন্ন ধনুকের মতো সোজা হইয়া উঠিয়া দাঁড়াইল। সশস্ত্র সার্জেন্ট-দল রিভলবার হাতে লইয়া গাড়িতে ঝাঁপাইয়া পড়িল। জাহাঙ্গীর পিস্তল ছুড়িতে একজন সার্জেন্ট মাটিতে লুটাইয়া পড়িল। অন্য সার্জেন্ট জাহাঙ্গীরকে ধরিয়া ফেলিল।
এই ধস্তাধস্তির ফলে চম্পা কখন সরিয়া পড়িয়াছিল, কেহ টের পাইল না।
দুই তিনজন সার্জেন্ট ওই ট্যাক্সি লইয়া দুই তিন দিকে তাহার খোঁজে ধাওয়া করিল।
কুহেলিকা – ১৯
এদিকে জাহাঙ্গীরের মাতা হাওড়া স্টেশনে পঁহুছিয়া জাহাঙ্গীর ও চম্পাকে দেখিতে না পাইয়া এবং হারুণের কাছে সমস্ত শুনিয়া মাথায় হাত দিয়া বসিয়া পড়িলেন। ভূণীর মুখে কে যেন কালি ঢালিয়া দিল।