জাহাঙ্গীর গম্ভীর হইয়া বলিল, ‘সত্যি তাই। আমাদের যে মন্ত্রে দীক্ষা, তাতে কেউ পুরুষ-নারী বলে নেই। সেখানে সকলে অগ্নি-সখা। তা নইলে তোমার মতো রূপে-গুণে অপরূপাকে কি এত কাছে পেয়ে নিজেকে বিশ্বাস করতে পারতুম?’
চম্পা বলিল, ‘সত্যি তোমার সে রকম দুর্বলতা আসতে পারে বলে তুমি ভয় কর?’
জাহাঙ্গীর উঠিয়া বসিয়া কহিল, ‘করি চম্পা। আমি আমাকে যত বেশি জানি, তুমি তো তা জান না।’
চম্পা ভয়ের ভান করিয়া বলিল, ‘তবে তোমার সঙ্গে আসা আমার উচিত হয়নি। অথচ প্রমতদা যাবার সময় আমায় তোমায় ছাড়া আর কাউকে বিশ্বাস করতে মানা করেছিলেন। তুমি নাকি নারী জাতিটাকে ঘৃণা কর।’
জাহাঙ্গীর বলিল, ‘কতকটা তাই। ওদের বিশ্বাস করি না – শ্রদ্ধা করি না বলেই আমার অত ভয়। যাকে শ্রদ্ধা করি না, তার অসম্মান করতে আমার বাধবে না।’
চম্পা প্রশ্ন করিল, ‘এই যদি তোমার মনের ভাব তা হলে বিয়ে করতে যাচ্ছ কেন এক নারীকেই?’
জাহাঙ্গীর বলিল, ‘বিয়ে করব কি-না জানিনে চম্পা, কিন্তু তার সর্বনাশের আর কিছু বাকি রাখিনি।’
হঠাৎ সাপ দেখিলে লোক যেমন চমকিয়া উঠে, চম্পা তেমনই চমকিয়া উঠিয়া বলিল, ‘এ তুমি কী বলছ দাদা? হয় তুমি মিথ্যা কথা বলছ – কিংবা পাগল হয়েছে।’
জাহাঙ্গীর তেমনই স্থির কণ্ঠে কহিল, ‘আমি মিথ্যাও বলিনি, পাগলও হইনি চম্পা। এর পরে তোমার সাথেও হয়তো আর আমার দেখা হবে না। এই পৃথিবীর অন্তত একজন আমার বেদনার কাহিনি শুনে রাখুক – কী অভিশপ্ত জীবন নিয়ে আমি এসেছিলুম – কী হতে পারতুম অথচ কী হলুম।’
চম্পা কণ্ঠে বেদনা ও মিনতি ঢালিয়া দিয়া কহিল, ‘দাদা তুমি একটু শুয়ে ঘুমোও দেখি। আমি জেগে থেকে রানিগঞ্জে ট্রেন এলেই উঠিয়ে দেব। তোমার কিচ্ছু আমি জানতে চাইনে। কী হবে আমার জেনে? তোমায় দেখেছি, শ্রদ্ধা করেছি – শুধু এইটুকুই আমার যথেষ্ট।’
জাহাঙ্গীর বাধা দিয়া বলিল, ‘ না চম্পা, তোমাকে শুনতেই হবে। আমি এতদিন ভেঙে পড়িনি বা উচ্ছন্নে যাইনি প্রমতদা ছিলেন বলে। এখন আর আমার ভয় নাই। হয় স্বর্গারোহণ করব – নয় একেবারে যে পাঁক থেকে আমি উঠেছি সেই পাঁকেই ডুবে যাব।’
চম্পা প্রতিবাদের স্বরে বলিল, ‘তুমি পাঁক থেকে উঠতে পার না – যদি তা শুনেও থাক তা মিথ্যা।’
জাহাঙ্গীর ম্লান হাসিয়া বলিল, ‘তুমি হয়তো আমাকে পদ্মফুল মনে করছ – তা নাকি গোবরেও ফোটে চম্পা। কিন্তু আমি যে আমাকে পরীক্ষা করে দেখেছি। তুমি শুনে আশ্চর্য হবে – সে পরীক্ষায় আমি আমার মূলের পাঁককে দেখতে পেয়েছি। আর সে পাঁক অন্যের গায়েও গিয়ে লেগেছে।’
চম্পা কী ভাবিল। তাহার পর বলিল, ‘তুমি কি ভূণীর কথা বলছ? সত্যিই কি তুমি তার ক্ষতি করেছ?’
জাহাঙ্গীর উত্তেজিত হইয়া বলিল, ‘শুধু ক্ষতি চম্পা, যে ক্ষতির চেয়ে বড়ো ক্ষতি মেয়েলোকের হতে পারে না, আমি তার সেই ক্ষতি করেছি। এক মুহূর্তের দুর্বলতাকে জয় করে উঠতে পারলাম না।’
জাহাঙ্গীরের চোখ জলে ভরিয়া উঠিল। সে তাহা গোপন করিবার চেষ্টা না করিয়া বলিতে লাগিল, ‘তার একমাত্র প্রায়শ্চিত্ত তাকে বিয়ে করা। কিন্তু সে তো জানে না – আমি আমার পিতার কামজ সন্তান, – আমার মা কলকাতার এক বিখ্যাত বাইজি! একথা জানলে সে কি আর আমায় শ্রদ্ধা করতে পারবে? আমার মূলে যদি পাঁক না থাকত, তা হলে আমি অত বড়ো পাপ করতে পারতাম? আমার প্রতি রক্ত-কণিকায় যে ভোগী পিতা বেঁচে রয়েছে – আমি ভুললেও সে আমায় যে কেবলই নরকের দিকে টানবে চম্পা! এত ঐশ্বর্য, মা যা-ই হোন তাঁর এত স্নেহ – এই নিয়ে আর যে কেউ হয়তো পরম সুখে দিনাতিপাত করতে পারত। আমি কিন্তু পিতা-মাতার অপরাধ সহস্র চেষ্টা করেও অন্তর থেকে ক্ষমা করতে পারলুম না। অগ্মিমন্ত্রে দীক্ষা নিলুম – ভাবলুম, আগুনে পুড়ে হয় খাঁটি হব – নয় পুড়ে ছাই হব। খাঁটি হতে পারলুম না, এখন ছাই হওয়া ছাড়া আর আমার এ জন্ম থেকে মুক্তি নেই।’ জাহাঙ্গীর হাঁপাইতে লাগিল।
আশ্চর্য! চম্পা ঘৃণায় সরিয়া গেল না। অধিকন্তু অধিকতর স্নেহে তাহার কপালের রুক্ষ চুলগুলো সরাইতে সরাইতে বলিল, ‘লক্ষ্মীটি, চুপ করে শোও। তুমিও তো রক্ত-মাংসেরই মানুষ ভুল বড়ো বড়ো মহাপুরুষও করেন। যাঁদের জন্মে কোনো কলঙ্ক স্পর্শ করেনি, তাঁরাও তো সারা জীবন পাপে ডুবে রয়েছেন দেখছি। তোমাদের অগ্নিপন্থী দলেরই নামকরা দু-চার জনকে জানি, যারা আমার সর্বনাশ করতে উদ্যত হয়েছিল। আমি ইচ্ছা করলে তাদের সর্বনাশ করতে পারতাম – করিনি, ক্ষমা করেছি। বিশেষ করে, তোমাদের অগ্নিপন্থীদের মনে যে ভীষণ পশু রয়েছে – তারই প্রেরণায় তোমরা হত্যা করতেও ভয় পাও না। সেই পশু শুধু হত্যার জন্যই নয় – অন্য কারণেও তো জেগে উঠতে পারে। তোমাদের মনের পশুকে একেবারে মেরে ফেললে তোমাদের দেবত্ব বা মনুষ্যত্ব দিয়ে আর যাই হোক – আমাদের যে মন্ত্র, যে সাধনা তার কিছু হবে না।’
জাহাঙ্গীর উঠিয়া বসিয়া চম্পার দুই হাত চাপিয়া ধরিয়া বলিল, ‘ চম্পা, এমন কথা তো কেউ কোনোদিন বলেনি! প্রমতদাও না।’
চম্পা বাধা দিল না তেমনিভাবে বলিতে লাগিল, ‘তবু তুমি সত্যব্রতী। তোমরা পশুকে মানুষের চামড়া পরিয়ে লুকিয়ে রাখতে জান না। অন্য যাঁদের দেখেছি, তাঁরা সমস্ত বড়ো কর্মী ত্যাগী বীরপুরুষ, কিন্তু এই সত্যটুকু স্বীকার তাঁরা করেননি। তাঁদের দুর্বলতাকে নেপোলিয়নের লাম্পট্যের সঙ্গে তুলনা করেছেন।’ যদিও আমি বিশ্বাস করি না – নেপোলিয়ন সেরকম ছিল।’