মা ম্লান হাসি হাসিয়া বলিলেন, ‘না মা, তুমি জান না, ওর শরীরের উপর একটুও যত্ন নেই, সত্যিই ওর শরীর খারাপ করেছে।’
চম্পা বলিল, ‘তা তো দেখেই বোধ হচ্ছে! ওঁর শরীরটা যেন সন্ন্যাসীর, যত রকমে পেরেছেন, ওকে নির্যাতন করেছেন। লক্ষ রাখবেন মা, সন্ন্যাসী-টন্ন্যাসী না হয়ে যান!’
মা হাসিয়া বলিলেন , ‘এবার যার উপর লক্ষ রাখার ভার পড়েছে – সেই দেখবে মা। আমি তো ওকে বাগে আনতে পারিনি – দেখি অন্য কেউ পারে কিনা।’
চম্পা ভূণীর কানে কানে বলিল, ‘তুমি বেশ ভালো ঘোড়সওয়ার তো বউদি? জোর লাগাম কশে রেখো। নইলে এ বেহেড ঘোড়া ছুটতে শুরু করলে আটকে আর রাখতে পারবে না।’
ভূণী জোর করিয়া হাসিয়া বলিল, ‘যদি তোমার মতো কথার চাবুক থাকত হাতে ভাই, তা হলে হয়তো পারতুম। ও ঘোড়া হয়তো একা তুমিই বাগে আনতে পার।’
চম্পা রাম-চিমটি কাটিয়া বলিল, ‘এই ননদ-নাড়া শুরু হল তা হলে!’
ভূণী উঃ করিয়া শব্দ করিয়া বলিল, ‘তুমি দেখছি শূর্পণখা!’
চম্পা হাসিয়া বলিল, ‘আর উনি বুঝি রাবণ, তুমি সীতা?’
জাহাঙ্গীর হাসিয়া বলিল, ‘ওধারে রাম-লীলা শুরু হল, হারুণও কবিতার খাতা নিয়ে বসল, আমি ততক্ষণ কুম্ভকর্ণের ডিপুটিগিরি করি।’
বলিয়া চক্ষু বুজিয়া শুইয়া পড়িল। মাতা হাসিয়া পুত্রের ললাটে সস্নেহ কর সঞ্চালন করিতে লাগিলেন।
কুহেলিকা – ১৮
গাড়ি বর্ধমানে আসিয়া পঁহুচিতেই কাহাদের চঞ্চল স-বুট পদশব্দে জাহাঙ্গীরের ঘুম ভাঙিয়া গেল। জাহাঙ্গীর উঠিয়া দেখিল, সকলে ঘুমাইয়া গিয়াছে। রাত্রি কতটা হইবে তাহা সে আন্দাজ করিতে পারিল না। কেবল হারুণ একাকী জাগিয়া এক মনে বোধ হয় কবিতা লিখিতেছে। একদল সশস্ত্র গোরা ও পুলিশ তাহাদের স্যালুন বারকতক প্রদক্ষিণ করিয়া স্যালুনের পূর্বের গাড়িটাতে উঠিয়া বসিল। ট্রেন ছাড়িয়া দিল।
জাহাঙ্গীরের বুঝিতে বাকি রহিল না – কোন বজ্র তাহার শির লক্ষ করিয়া ছুটিয়া আসিতেছে। সে কী করিবে, কিছুই ঠিক করিতে পারিল না। ধাক্কা দিয়া হারুণের ধ্যান ভঙ্গ করিয়া সে চুপি চুপি বলিল, ‘হারুণ, ভীষণ বিপদ! তোমায় একটা কাজ করতে হবে।’
হারুণ ভ্যাবাচ্যাকা খাইয়া জাহাঙ্গীরের মুখের পানে হাঁ করিয়া তাকাইয়া রহিল। সে জাহাঙ্গীরের এই অহেতুক ভীতির কোনো কারণ খুঁজিয়া পাইল না।
জাহাঙ্গীর বলিল, ‘অনেকগুলো গোরা আর পুলিশ আমাদের গাড়ির সামনে দিয়ে যাওয়া-আাসা করছিল, দেখেছ?’
হারুণ ঘাড় নাড়িয়া বলিল, ‘হাঁ!’
জাহাঙ্গীর বলিল, ‘ওরা খুব সম্ভব আমায় অ্যারেস্ট করবে। হয়তো আমাদের গাড়িও সার্চ করবে। সার্চ যদি করে – তা হলে আমরা সকলেই ভীষণ বিপদে পড়ব। তোমাকে সব কথা খুলে বলি, যাকে আমিনা বলে ভেবেছ – সে আমিনা নয় – আমাদের বিপ্লবীদলের একটি মেয়ে। ওর কাছে অনেক অস্ত্রশস্ত্র আছে। এরা সকলেই ঘুমুচ্ছে – এই অবসরে আমি আর ওই আমিনা নেমে পড়ব স্টেশনে। তুমি আস্তে আস্তে ওর বাক্সটা নামিয়ে দেবে। কোনো ভয় কোরো না। মাকে ভাবতে মানা কোরো – আমি কালই মোটরে করে বাড়ি পঁহুচিব তোমাদের সাথে সাথে।’
হারুণ বোবার মতো বসিয়া রহিল। মনে হইল, তাহার বাক্শক্তি রহিত হইয়া গিয়াছে। ‘মাকে বলো – আমিনার মামা তার করায় বর্ধমান স্টেশনে তা পেয়ে আমি তাঁকে আবার অণ্ডাল পৌঁছে দিতে যাচ্ছি – তার মায়ের ভয়ানক অসুখ বেড়েছে। অণ্ডাল থেকে তার মামা এসে নিয়ে যাবেন।’
বলিয়াই সে আস্তে ধাক্কা দিয়া চম্পাকে জাগাইল। চম্পাকে কোড-ওয়ার্ডে কী কথা বলিতেই সে লাফাইয়া উঠিয়া তাহার বুকের নীচে কী পরীক্ষা করিয়া দেখিল।
তাহার পর বাক্স দুইটি আস্তে আস্তে দোরগোড়ায় টানিয়া দরজা খুলিয়া প্রস্তুত হইয়া রহিল। জাহাঙ্গীর আবার তাহাকে কী বলিতে সে তাড়াতাড়ি বাথরুমে ঢুকিয়া হিন্দু-সধবার বেশে সাজিয়া বাহির হইয়া আসিল। জাহাঙ্গীরও তাড়াতাড়ি ইউরোপিয়ান বেশে সজ্জিত হইয়া লইল। ইত্যবসরে ট্রেন শক্তিগড়ে একটু দাঁড়াইয়াই ছাড়িবার উপক্রম করিতে তাহারা ধীরে দুই জনে দুইটা বাক্স লইয়া নামিয়া পড়িল। জাহাঙ্গীর চাহিয়া দেখিল, সৌভাগ্যক্রমে গোরা বা পুলিশের কেহ সেদিকে লক্ষ করিল না। তাহারা ইহাদের কলিকাতায় পাকড়াও করিবে বলিয়া নিশ্চিন্ত হইয়া হয়তো শুইয়াছিল।
হারুণ তেমনি পাথরের মতো বসিয়া রহিল। তাহার বাক্শক্তি এবং নড়িবার শক্তি দু-ই যেন কে হরণ করিয়া লইয়াছে।
জাহাঙ্গীর ও চম্পা বিপরীত দিককার প্ল্যাটফর্মে গিয়া দাঁড়াইতে বর্ধমান যাইবার ট্রেন আসিয়া উপস্থিত হইল। তখন টিকিট করিবার সময় ছিল না। চম্পাকে একখানা শূন্য ফার্স্টক্লাসে তুলিয়া দিয়া সে গার্ডকে বলিয়া আসিল।
ট্রেন ছাড়িয়া দিল। চম্পা বলিল, ‘বর্ধমানে নামা হবে না। সেখানে পুলিশে নিশ্চয়ই কড়া পাহারা দিচ্ছে।’ স্থির হইল তাহারা রানিগঞ্জে নামিয়া সেখান হইতে ট্যাক্সি করিয়া কলিকাতা আসিবে। তাহা হইলে ধরা পড়িবার সম্ভাবনা থাকিবে না।
জাহাঙ্গীর ক্লান্ত হইয়া শুইয়া পড়িল। চম্পা বলিল, ‘দাদা তোমার মাথাটা টিপে দেব?’ জাহাঙ্গীর আপত্তি করিল না। চম্পা তাহার চম্পক আঙ্গুলি দিয়া জাহাঙ্গীরের কপাল টিপিয়া দিতে দিতে বলিল, ‘দাদা তোমার মা হয়তো এতক্ষণ কী মনে করেছেন!’
জাহাঙ্গীর হাসিয়া বলিল, ‘হ্যাঁ, মা হয়তো মনে করছেন, ছেলে আমার মেয়েটাকে নিয়ে উধাও হল।’
চম্পা জাহাঙ্গীরের হাতে চিমটি কাটিয়া বলিল, ‘যাও তুমি ভয়ানক দুষ্টু। আমাদের ও কথা বলতে নেই।’