সে আর চোখ তুলিয়া কাহারও পানে চাহিতে পারিল না! সব চেয়ে মুশকিল হইল ভূণীর, সে বাহির হইতে পারে না, অথচ বাহির না হইলেও নয়।
লজ্জায় মাথা খাইয়া ভূণীকে দুই একবার বাহিরে আসিতে হইল। সে না আসিলে চলিবেই বা কী করিয়া? এত লোকের খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা তো তাহাকেই করিতে হইবে।
জাহাঙ্গীরের মাতা হারুণের মাতাকে অনেক বুঝাইয়া জাহাঙ্গীরকে বাহিরে পাঠাইয়া দিয়া তহমিনাকে লইয়া পড়িলেন। রান্নার সমস্ত ব্যাপার তাঁহার বাঁদিদের হাতে তুলিয়া দিয়া তিনি ভূণীকে স্নান করাইয়া যখন হিরা-জহরত বসন-ভূষণে সাজাইয়া তুলিলেন, তখন গ্রামের মেয়েরাই বলিল, ভূণীর যে এত রূপ – তাহা তাহারাও জানিত না। অলংকার ও কাপড়-চোপড়ের বাহার দেখিয়া সকলেই বলিল, মেয়ে বরাত লইয়া আসিয়াছিল বটে! কেহ কেহ ইহাও বলিল যে, অত গহনা-কাপড় দিয়া সাজাইলে তাহার মেয়েকেও ইহার চেয়ে কম সুন্দর দেখাইত না।
মোমি ও মোবারক তাহাদের অদৃষ্টপূর্ব বসন-ভূষণে সজ্জিত হইয়া আনন্দে আত্মহারা হইয়া উঠিল। গ্রামের সমস্ত বাড়িতে সন্দেশ মিঠাই পরিবেশন করা হইল। সকলে এই সন্দেশ দেওয়ার অর্থ অন্যরূপ করিল। সন্দেশের মূলে যে ভূণী, ইহা লুকাইলেও কাহারও আর বুঝিতে বাকি থাকিল না।
দুই দিনেই দেওয়ান সাহেব ও জাহাঙ্গীরের মাতা গ্রামের প্রায় সকলের শ্রদ্ধা আকর্ষণ করিলেন তাঁহাদের সহজ সরল নিরহংকার ব্যবহারে।
গ্রামের আত্মীয়স্বজনের নিকট অশ্রুসিক্ত চোখে বিদায় লইয়া হারুণেরা তাহাদের পৈতৃক ভিটার মায়া কাটাইয়া কলিকাতা যাত্রা করিল।
হারুণের নিকট-আত্মীয় একজন তাহাদের বাড়ি দেখাশুনা করিবেন কথা থাকিল। ইতিমধ্যে হারুণ আসিয়া নতুন করিয়া বাড়ি তৈরি করিয়া যাইবার পর তাহার পিতা-মাতা ফিরিয়া আসিবেন বলিয়া আত্মীয়স্বজনকে আশ্বাস দিল।…
হারুণের মাতা জাহাঙ্গীরকে দেখা অবধি আর বেশি কান্নাকাটি করেন নাই। তাঁহাকে বিশ্বাস করাইয়া দেওয়া হইয়াছিল যে, তাঁহার মিনা বড়ো হইয়া বিদেশ হইতে ফিরিয়া আসিয়াছে। উন্মাদিনী তাহাই বিশ্বাস করিয়াছে। কাজেই তাঁহাকে লইয়া যাইতে বিশেষ বেগ পাইতে হয় নাই।
কুহেলিকা – ১৭
স্টেশনে পঁহুছিয়াই জাহাঙ্গীর দেখিল, সারা গায়ে ভস্ম-বিভূতি মাখা জটাজূটধারী এক পৌনে-ষোলো-আনা নাগা সন্ন্যাসী তাহার চিমটার ইঙ্গিতে তাহাকে যেন আহ্বান করিল।
জাহাঙ্গীর দেখিল সন্ন্যাসী ইঙ্গিত করিয়াই রেললাইনের অপর পারে এক বৃক্ষনিম্নে গিয়া বসিলেন। সেখানে আরও বহু সন্ন্যাসী – কেহ ধুনি জ্বালাইয়া, কেহ ধ্যান করিতেছে, কেহ গাঁজা টানিতেছে, কেহ ভজন-গান করিতেছে।
জাহাঙ্গীর কাহাকেও কিছু না বলিয়া সন্ন্যাসীর অনুসরণ করিল। জিনিসপত্র নামানোর হ্যাঙ্গামে কেহ অত লক্ষ করিল না।
সন্ন্যাসী দল হইতে কিছু দূরে একটু নিরালায় গিয়া সেই সন্ন্যাসী বলিল, ‘তুমি আমাকে চেন না। অবশ্য, আমি তোমায় চিনি। আমাদের অত্যন্ত বিপদ। আজ ভোরে তোমার প্রমতদা ও পিনাকীর মাসিমা অস্ত্রশস্ত্র সমেত ধরা পড়েছেন। তোমার গাড়িতে তুলে দেবেন বলে তাঁরা গোরুর গাড়িতে করে সেসব আনছিলেন, রাস্তায় পুলিশ পাকড়েছে। এ খবর পুলিশ বাইরে প্রকাশ হতে দেয়নি, অন্যান্য সকলকে ধর-পাকড়ের জন্য। মাসিমাকে বাঁচাতে গিয়ে প্রমত্তকে ধরা দিতে হয়েছে – আমরা সকলে পালিয়ে এসেছি। পুলিশদের দু-জন মারা গেছে আমাদের গুলিতে । তোমার উপর বজ্রপাণির আদেশ, মাসিমার মেয়ে চম্পাকে নিয়ে কলকাতায় আপাতত তোমাদের বাসায় রাখবে। তার পর দু-এক দিনের মধ্যে বজ্রপাণি লোক পাঠিয়ে তাকে নিয়ে যাবেন। চম্পাকে বোরখা পরিয়ে মুসলমান মেয়ে সাজিয়ে রেখেছি। সে একটু পরেই স্টেশনে আসবে – তুমি তাকে তোমাদের গাড়িতে তুলে নিয়ো। খুব সাবধানে কিন্তু, পুলিশ ভয়ানক কড়া পাহারা দিচ্ছে প্ল্যাটফর্ম। চম্পার সাথে এক বাক্স মালপত্র আছে। সাবধান! প্রাণ দিতে হয় দিয়ো, তবু সেসব যেন বেহাত না হয়। যাও!’ – বলিয়াই সন্ন্যাসী সেখানে বসিয়া গাঁজার কলিকায় দম দিতে দিতে চিৎকার করিয়া উঠিলেন, – ‘বোম কালী কালকাত্তাওয়ালি।’…
জাহাঙ্গীর চক্ষে যেন অন্ধকার দেখিতে লাগিল। কিন্তু ভয় পাইলে চলিবে না, ভাবিবারও অবকাশ নাই। তাহাকে প্রাণ দিয়া কর্তব্য পালন করিতে হইবে। সে স্টেশনে আসিয়া দেখিল, জিনিসপত্র স্যালুনে উঠানো হইতেছে। গাড়ি আসিবার তখনও অনেক দেরি।
তাহার মাতা ভূণী মোমি প্রভৃতি স্যালুনে উঠিয়া বসিয়াছিলেন। স্যালুনটা প্ল্যাটফর্ম হইতে কিছু দূরে ছিল। সে দেখিল, আর একখানা পালকি তাহাদের স্যালুনের দিকে আসিতেছে। সে তাহার মাতাকে বলিল, ‘মা, বলতে ভুলে গেছি, আমাদের মউলবির ভাগনি আমাদের সাথে যাবে। দু-একদিন আমাদের বাড়িতে সে থাকবেও। ডায়াসেশান কলেজে সে পড়ে। মউলবি সাহেব বিশেষ কাজে আজ যেতে পারলেন না, উনি দু-এক দিনের মধ্যেই কলকাতা এসে পঁহুচবেন।’
বলিতে বলিতে পালকি আসিয়া স্যালুনের নিকট থামিল এবং একটি বোরখা-পরা তরুণী নামিয়া স্যালুনে উঠিয়া আসিল। আসিয়াই সে মুসলমানি কায়দায় জাহাঙ্গীরের মা-র পদধূলি লইল। বাঁদিরা তাহার বাক্স-প্যাঁটরা স্যালুনে তুলিয়া লইল। মাতা আশীর্বাদ করিয়া বলিলেন, ‘এবার বোরখাটা খুলে ফেলো মা, যা গরম সেদ্ধ হয়ে গেছ বুঝি।’
চম্পা সামনের খড়খড়ি ফেলিয়া দিয়া বোরখা খুলিয়া ফেলিল। তাহার রূপে সকলের চক্ষু যেন ঝলসিয়া গেল। ভূণীর মুখ ম্লান হইয়া গেল। সত্যসত্যই চম্পার কাছে তাহার রূপ নিষ্প্রভ হইয়া পড়িল।