অল্পক্ষণের মধ্যেই সকলে জাগিয়া উঠিল। গ্রামে বেগম আসিয়াছে বলিয়া হইচই পড়িয়া গেল। ঘরে মেয়েদের ভিড় লাগিয়া গেল।
জাহাঙ্গীরের মাতা বা দেওয়ান সাহেব বিবাহের কোনো কথাই তুলিলেন না।
জাহাঙ্গীরের মাতা হারুণের পিতাকে সম্বোধন করিয়া বলিলেন, ‘আপনার কাছে একটা ভিক্ষা চাইতে এসেছি! অবশ্য ছেলের বন্ধুর বাড়ি দেখতে আসাও আমাদের এখানে আসার আর একটা কারণ। আমি পশ্চিমবঙ্গের পল্লিগ্রাম কখনও দেখিনি – এই অবসরে তাও দেখা হয়ে গেল।’
হারুণের পিতা বিনয়কুণ্ঠিতস্বরে বলিলেন, ‘আপনারদের মতো লোক যে গরিবের বাড়ি এসেছেন, এই আমার পরম সৌভাগ্য। জাহাঙ্গীর বাবাজি না এলে তো আপনার পদার্পণ হত না এ অজ-পাড়াগাঁয়ে। – আর আপনাকে ভিক্ষা দেওয়ার মতো কোনো কিছুই নেই আমার।’
জাহাঙ্গীরের মাতা বলিলেন, ‘আপনার যে সন্তান-রত্ন আছে – তারাই যে সাত রাজার ধন। আমি হারুণকে ভিক্ষা চাচ্ছি। সে আমার নতুন জমিদারি স্টেটের ম্যানেজার হবে। আপাতত সে মাসে তিনশো টাকা করে পাবে। আমার একটি মাত্র ছেলে, কিন্তু সে কিছু নেয়ও না, দেখেও না। সে এরই মধ্যে আধা-দরবেশ হয়ে গেছে। হারুণ কিন্তু আমার ছেলের মতোই থাকবে – আর তার সাথে সাথে আপনাদেরও কলকাতা যেতে হবে। হারুণের কাছেই আপনারা থাকবেন। হয়তো চিকিৎসা হলে ওর মাও ভালো হয়ে উঠতে পারে!’
হারুণের পিতা বহুক্ষণ কোনো কথা বলিতে পারিলেন না। তবে কি ভূণীকে পুত্রবধূ করিতে পারিবেন না বলিয়া তাঁহার এই জমিদারি চাল? ইহা কি তাহারই ক্ষতিপূরণ? তাঁহার আত্মসম্মানে আঘাত লাগিল। ক্ষুণ্ণস্বরে তিনি বলিলেন, ‘আপনার দয়ার জন্য আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ দিচ্ছি বেগম সাহেবা, কিন্তু হারুণের তিনশো টাকা মাইনে পাবার মতো তো গুণ বা কর্মক্ষমতা নাই। আপনিও আমার ছেলের বন্ধুর জননী কাজেই আত্মীয়াও বললে হয়। আমাদের খুবই অভাব, তবু মাফ করবেন – আপনার কাছ থেকে এ দান নিতে আমার হাত উঠবে না।’
দেওয়ান সাহেব বুঝিতে পারিয়া বলিয়া উঠিলেন, ‘বেগম সাহেবাকে আত্মীয়ার মতোই বলছেন কেন খোন্দকার সাহেব, উনি তো আপনার বড়ো আত্মীয় হতে চলেছেন – দু দিন পরে বেয়ান হবেন – ওঁকে যদি এমন করে ফিরিয়ে দেন, আমরা সকলে বড়ো ব্যথা পাব। এখানে আজ সকালে গ্রামের লোকের মুখে শুনেছি আপনাদের বাড়িতে কোনো ভিখারি সোনা-রূপা না পেয়ে ফিরে যেত না। আমরাই কি তা হলে শুধুহাতে ফিরে যাব?’
হারুণের পিতা এইবার গলিয়া গিয়া বেদনার্ত কণ্ঠে বলিলেন, ‘সেদিন তো আমাদের নাই দেওয়ান সাহেব! এখন এক মুঠো চাউল দিতে পারিনে ভিখিরিকে। আমার ওয়ালেদ সাহেব পর্যন্ত সত্যই আমাদের বাড়ির এই রেওয়াজ ছিল। আমিও তা দেখেছি মাত্র, কিন্তু এ কমবখ্ত বাপ-দাদার সে ট্র্যাডিশন বজায় রাখতে পারেনি!’
জাহাঙ্গীরের মাতা বলিয়া উঠিলেন, ‘হারুণ আর তহমিনাই তো আপনার সোনার চেয়েও অমূল্য রত্ন – আমরা ওই সোনাই তো চাচ্ছি!’
হারুণের পিতা বিচলিত হইয়া উঠিলেন, ‘আর আমায় লজ্জা দেবেন না, দোহাই! গোস্তাখীর যথেষ্ট শাস্তি দিয়েছেন। আমি আপনাদের যে ধরনের ধনী মনে করেছিলুম – আপনারা তার থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। বাইরের ঐশ্বর্য আপনাদের অন্তরের ঐশ্বর্যকে দেখছি এতটুকু মলিন করতে পারেনি। ভিক্ষা ভিক্ষা বলবেন না, ওরা আজ থেকে আপনারই সন্তান হল। আমি তো থেকেও নাই। আমি অন্ধ হয়ে ওদের কোনো-কিছুই দেখতে পারিনে। বাপ অন্ধ, মা পাগল। ওদের তো বাপ-মা থেকেও নেই! এখন থেকে আপনারাই ওদের বাপ-মা হলেন। এখন আমি শান্তিতে মরতে পারব।’ বলিতে বলিতে তাঁহার কণ্ঠ ভাঙিয়া আসিল, আর বলিতে পারিলেন না।
দেওয়ান সাহেব বলিলেন, ‘শুধু ওদের তো নিতে আসিনি, আপনাদের সকলকেই যে নিতে এসেছি। আপনার পৈতৃক ভিটে চিরদিনের জন্য ছেড়ে যেতে বলছিনে, কিছুদিন কলকাতা থেকে আপনাদের দুই জনারই চিকিৎসাপত্র করান – খোদা যদি ভালো করে তোলেন আপনারা আবার ফিরে আসবেন এই বাড়িতে!’
হারুণের পিতা আমতা আমতা করিয়া বলিলেন, ‘ভূণীর শাদি কি তা হলে কলকাতাতেই সম্পন্ন করতে চান? কিন্তু, তা তো হতে পারে না সাহেব।’
অনেক তর্ক-বিতর্কের পর স্থির হইল, বিবাহ গ্রামেই হইবে! কিন্তু কিছুদিনের জন্য সেটা স্থগিত রহিল। হারুণ ইতিমধ্যে তাহার এই পুরাতন বাড়ির সংস্কার করিবে। হারুণের পরীক্ষা দেওয়া পর্যন্ত হারুণের পিতা হারুণের জমিদারি কার্যে সাহায্য করিবেন। কথা হইল, এখন গ্রামের কাহাকেও বিবাহ সম্বন্ধে কিছু বলা হইবে না। হারুণ জমিদারি স্টেটে চাকুরি লইয়া সপরিবার কিছুদিনের জন্য চলিয়া যাইতেছে – ইহাই সকলকে জানানো হইবে। ইহাও স্থির হইল, আর তিন দিনের মধ্যে সমস্ত ঠিকঠাক করিয়া যাত্রা করিতে হইবে।
হারুণের পিতা ভয় করিয়াছিলেন, ইহাতে হয়তো একমাত্র ভূণীরই আপত্তি হইবে। কারণ কাল পর্যন্ত সে নাগিনির মতো ফণা ধরিয়াছে। কিন্তু ভূণীকে সব কথা বলার পর সে যখন এতটুকুও আপত্তি উত্থাপন করিল না – তখন পিতা বিস্মিত হইয়া ইহার কারণ সন্ধান করিতে গিয়া মনে মনে হাসিলেন। ভাবিলেন ‘বেটির আমার বর চোখে ধরেছে কিনা, তাই আর কথাটি কইতে পারলে না!’
হারুণের মাতা কিন্তু জাগিয়া উঠিয়া হইচই করিয়া তুলিলেন। এইসব অজানা লোকজন দেখিয়া কখনও তিনি হাসিতে, কখনও বা তারস্বরে মিনাকে ডাকিয়া কাঁদিতে লাগিলেন। মায়ের ডাকে জাহাঙ্গীর ভিতরে আসিতেই উন্মাদিনী ‘ওই আমার মিনা এসেছে, আয়, আয়, সাইকেল দেব’ বলিয়া জড়াইয়া ধরিয়া কাঁদিতে লাগিলেন, কিছুতেই ছাড়িয়া দিতে চাহিলেন না। মাতার আদেশে জাহাঙ্গীর সেইখানে অপরাধীর মতো বসিয়া রহিল।