দেবকুমার এক মুহূর্তে রক্ত-লোলুপ পশু হইয়া উঠিল!
তহমিনা এইবার যেন কতকটা তাহার অবস্থা বুঝিতে পারিল। সে তাহার শিথিল বাহু দিয়া এক একবার বিবসন-অঙ্গ আবৃত করিতে ও এক একবার জাহাঙ্গীরকে ঠেলিয়া ফেলিয়া দিতে চেষ্টা করিতে লাগিল। কিন্তু সেও আর পারিল না। অনাস্বাদিতপূর্ব উন্মাদনায় তাহারও দেহ যেন টনটন করিয়া উঠিল। সে আর বাধা দিতে পারিল না। জাহাঙ্গীরের বক্ষতলে বহুক্ষণ অজ্ঞানবৎ পড়িয়া থাকিয়া তহমিনা উঠিয়া দাঁড়াইল। বস্ত্র সংবরণ করিতে করিতে সে প্রায় কাঁদিয়া ফেলিয়া বলিল, এ কী সর্বনাশ করলে তুমি আমার? আমি কী করে মুখ দেখাব কাল?
জাহাঙ্গীর কোনো উত্তর না দিয়া মাতালের মতো টলিতে টলিতে চলিয়া গেল।
এ কী করিল সে? পঙ্কজ হইলেও নিজেকে পঙ্কের ঊর্ধ্বে শতদলের মতো তুলিয়া ধরিবার তপস্যা সে করিতেছিল। তাহার যে স্বদেশ-মন্ত্রের পবিত্র অগ্নিতে অগ্নিশুদ্ধি হইয়া গিয়াছে! স্বর্গে আরোহণ করিতে করিতে এ কোন রসাতলে সে পতিত হইল! অনুতাপে অনুশোচনায় তাহার আত্মহত্যা করিবার এচ্ছা করিতে লাগিল! কিন্তু এ কী! এক মুহূর্তে সে যেন অতি বড়ো কাপুরুষ হইয়া উঠিয়াছে। তাহার এখন মৃত্যুকে ভয় হইতেছে! আর সে অসংকোচে মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়াইতে পারে না! সে তো তহমিনার সর্বনাশ করে নাই, সর্বনাশ করিয়াছে সে নিজের।
জাহাঙ্গীর মাটিতে লুটাইয়া পড়িয়া অসহায় শিশুর মতো রোদন করিতে লাগিল।
হঠাৎ কাহার শীতল স্পর্শে সে চমকিয়া চাহিয়া দেখিল – একটা প্রকাণ্ড গোখরো সাপ তাহার উপর দিয়া চলিয়া যাইতেছে। সে শুনিয়াছিল, এ অঞ্চলে গ্রীষ্মকালে সাপের অত্যন্ত প্রাদুর্ভাব।
সে মনে করিল, স্বয়ং বিধাতা বুঝি তাঁহার দণ্ড প্রেরণ করিয়াছেন। সে নিশ্চেষ্ট হইয়া পড়িয়া রহিল। তাহার অঙ্গ বহিয়া সাপ চলিয়া গেল।
তবে কি মৃত্যুও তাহাকে ঘৃণা করে? ক্লান্ত হইয়া সে সেইখানেই ঘুমাইয়া পড়িল।
কুহেলিকা – ১৬
সকালে উঠিয়া ভূণীর মনে হইল, তাহার সকল দর্পের অবসান হইয়াছে। আজ সে পথের ভিখারিনি। দুই হাত পাতিয়া এখন তাহাকে ভিক্ষার তণ্ডুলকণা গ্রহণ করিতে হইবে। কালও সে মনে করিয়াছিল, যত বড়ো দরিদ্র হোক তাহারা, তবু সে দেখাইয়া দিবে – আত্মসম্মান শুধু ধনীরই একচেটিয়া নয়। দারিদ্রের কঠিন দর্প দিয়াই সে ধনীর ঐশ্বর্যকে অতি বড়ো আঘাত করিবে।
আজ কিন্তু তাহার মনে হইতে লাগিল, আঘাত তো সে আর করিতেই পারিবে না, উলটো যত আঘাতই আসুক, – তাহাকে পড়িয়া পড়িয়া তাহা সহিয়া যাইতে হইবে।
হারুণ ফিরদৌস বেগম সাহেবার তার পাইয়া তাহার বাবাকে জানাইবামাত্র – তিনি আনন্দে আত্মহারা হইয়া বলিয়াছিলেন, ‘বাবা, এতদিনে খোদা মুখ তুলে চেয়েছেন!’ ভূণীর মাথায় হাত রাখিয়া অশ্রুসিক্ত কণ্ঠে বলিয়াছিলেন, ‘রাজরানি হয়ে আমাদের ভুলে যাসনে মা!’
ভূণী কিন্তু কঠোর কণ্ঠে বলিয়াছিল, ‘তাঁরা নিতে এলেও আমি তোমায় ছেড়ে যাব না তো বাবা!’
পিতা বুঝিতে না পারিয়া বলিয়াছিলেন, ‘সে কী মা! হাতের লক্ষ্মীকে কি পায়ে ঠেলতে হয়? অতবড়ো জমিদারি, বেগম নিজে আমার বাড়ি আসছেন – এ কী আমার কম সৌভাগ্য?’
ভূণী রাগ করিয়া বলিয়াছিল, ‘তুমি ভুলে যাচ্ছ বাবা, আমার বাপ দাদার আজ অর্থ না থাকলেও বংশ-গৌরবে তাঁরা তাঁদের চেয়ে অনেক বড়ো। বাড়ি বয়ে তাঁরা তাঁদের ঐশ্বর্যের দর্প দেখাতে আসবেন, এ তোমরা সইলেও আমি সইতে পারব না।’
জাহাঙ্গীরের মাতার প্রাণঢালা স্নেহ-আদরে তাহার কঠিন অভিমানের আবরণ টুটিয়া পড়িয়াছিল, তবু সে পরিপূর্ণরূপে আত্মসমর্পণের কথা ভাবিতেই পারে নাই।
কিন্তু কী করিতে কী হইয়া গেল! কেন সে দরজার কাছে গিয়া দাঁড়াইয়াছিল। সে কাঁদিয়া ফেলিল।
মোমি ব্যতীত তখনও কেহ জাগিয়া উঠে নাই। তহমিনা উঠিতে গিয়াও যেন উঠিতে পারিল না। তাহার বুকে-শরীরে ভীষণ ব্যথা। শুইয়া শুইয়াই দেখিল, জাহাঙ্গীরের মাতা তাহাদের ঘরের দাওয়ায় মাটিতে বসিয়া পড়িয়া কোরান ‘তেলাওত’ করিতেছেন।
অপূর্ব ভক্তি-মধুর সে কণ্ঠস্বর! তাহার এক বর্ণও সে বুঝিতে পারিতেছিল না। কিন্তু কেমন এক অজানা শ্রদ্ধায় তাহার মন ভরিয়া উঠিল। তাহার মনের অর্ধেক গ্লানি যেন কাটিয়া গেল।
সে চেষ্টা করিয়া উঠিয়া পড়িল।
জাহাঙ্গীরের মাতা কোরান তুলিয়া রাখিয়া বলিলেন, ‘উঠেছ মা সোনা! এ কী? তোমার চোখ মুখ অমন হয়ে গেছে কেন মা? অসুখ করেছে বুঝি?’
তহমিনার মনে হইল, তাহাকে দেখিয়াই বোধ হয় মাতা সব বুঝিতে পারিয়াছেন। সে লজ্জায় অধোবদন হইয়া বলিল, ‘জি, না।’
জাহাঙ্গীরের মাতা তাহাকে বক্ষে টানিয়া ললাট চুম্বন করিয়া বলিলেন, ‘বালাই! এমন বদ-খেয়ালি কথা আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে যায় মা। – তোমার মা কখন উঠবেন? তাঁহাকে যে দেখলুমই না!’
তহমিনার কিছু বলিবার আগেই মোমি বলিয়া উঠিল, ‘মা যে পাগল। মা উঠলেই তো কাঁদতে শুরু করবে বড়ো ভাইয়ের নাম করে!’
জাহাঙ্গীরের মাতা সব শুনিয়াছিলেন। তাঁহার চক্ষে জল আসিল। মোমিকে বুকে টানিয়া লইয়া বলিলেন, ‘তোমার মা ভালো হয়ে যাবেন মা। আমরা তোমার মাকে কলকাতা নিয়ে গিয়ে ডাক্তার দেখাব। আর, যদ্দিন তোমার মা ভালো হয়ে না উঠেন, তদ্দিন আমি হব তোমার মা, কেমন?’
কলিকাতা যাওয়ার কথায় মোমি অত্যন্ত খুশি হইয়া উঠিল। সে কলিকাতা সম্বন্ধে তাহার দাদাভাই-এর কাছে কিছু কিছু গল্প শুনিয়াছিল। সে কলকাতা সম্বন্ধে অদ্ভুত অদ্ভুত প্রশ্ন করিতে লাগিল। জাহাঙ্গীরের মাতা হাসিয়া সে সবের উত্তর দিতে লাগিলেন।