জাহাঙ্গীরের মাতা নিজে তহমিনা, মোমি ও মোবারককে খাওয়াইলেন। অত্যাধিক গরম পড়ায় তাঁহার সাথে দুইখানা ক্যাম্পখাট খুলিয়া উঠানেই শুইয়া পড়িলেন। তহমিনাকে পাশের খাটে শোয়াইয়া আদর করিতে করিতে প্রশ্নের পর প্রশ্ন করিয়া তাহার মনের কথা বাহির করার চেষ্টা করিতে লাগিলেন।
তহমিনা জীবনে এত স্নেহ পায় নাই। সে এই আদরে গলিয়া গিয়া ছোটো খুকিটির মতো তাঁহাকে জড়াইয়া ধরিয়া শুইয়া দুই একটি কথায় তাঁহার প্রশ্নের উত্তর দিতে লাগিল।
দেওয়ান সাহেব হারুণের পিতার মনোভাব বুঝিবার চেষ্টা করিতে লাগিলেন। সে রাত্রে আর বেশি কথা হল না। পথশ্রান্তিতে সকলেই শীঘ্র ঘুমাইয়া পড়িল।
তহমিনার চক্ষে ঘুম ছিল না। সে যখন দেখিল, সকলে ঘুমাইয়া পড়িয়াছে, অথচ তাহার ঘুম আসিতেছে না, তখন সে উঠিয়া উন্মাদিনী মাতার খোঁজ লইতে গেল। উঠান হইতে অন্দরে যাইবার পথেই সদর দরজা। সে দেখিল, সদর দরজা খোলা রহিয়াছে। দরজা বন্ধ করিতে গিয়া হঠাৎ তাহার সামনে মাঠের উপর দৃষ্টি পড়িল। দেখিল, অস্তমান চন্দ্রের ম্লান চন্দ্রালোকে বসিয়া জাহাঙ্গীর আকাশের দিকে হাঁ করিয়া তাকাইয়া আছে। সে আর চোখ ফিরাইতে পারিল না, নির্নিমেষ নেত্রে তাহার পানে তাকাইয়া রহিল।
কেন সে অতন্দ্রনয়নে একা জাগিয়া শূন্য আকাশে চাহিয়া আছে? এই সুন্দর পৃথিবীতে কী তাহার চাহিবার কিছুই নাই। এত ঐশ্বর্য, এমন মা যাহার তাহার কেন এই দুঃখ-বিলাস?
তহমিনা বুঝিতে পারিয়াছিল, কেন হঠাৎ জাহাঙ্গীরের মাতা সদলবলে আসিয়া হাজির হইয়াছেন। তাহার আরও মনে হইতে লাগিল, হয়তো জাহাঙ্গীরই তাহার মাতাকে লইয়া আসিয়াছে। ভাবিতেই তাহার মন অভূতপূর্ব আনন্দে কানায় কানায় পুরিয়া উঠিল। তাহা হইলে, যতটা হৃদয়হীন সে জাহাঙ্গীরকে মনে করিয়াছিল, ততটা হৃদয়হীন সে নয়!
কিন্তু কী রকম বদরসিক লোকটা? একবারও কি ভুলিয়া খোলা দরজার দিকে তাকাইতে নাই?
সে যেন দরজা বন্ধ করিবার জন্যই দুই কবাটে আঘাত করিল এবং যুগল কবাটের স্বল্প অবকাশ দিয়া দেখিতে লাগিল, জাহাঙ্গীরের ধ্যান ভঙ্গ হইয়াছে কিনা।
জাহাঙ্গীর দরজার দিকে তাকাইল এবং একজন দরজার আড়ালে দাঁড়াইয়া রহিয়াছে ইহাও বুঝিতে পারিল। সে মনে করিল, কোনো প্রয়োজনে হয়তো তাহার মাতা তাহাকে ডাকিতেছেন। সে দরজা ঠেলিতেই তহমিনাকে দেখিয়া চমকাইয়া প্রশ্ন করিল, ‘কে? ভূণী? আমায় ডাকছিলে?’
ভূণী ওরফে তহমিনা লজ্জায় মরিয়া গিয়া কাষ্ঠপুত্তলিকাবৎ দাঁড়াইয়া রহিল, ছি ছি, একী বেহায়াপনা সে করিল!
জাহাঙ্গীর আবার প্রশ্ন করিল, ‘আমাকে কি কোনো কথা জিজ্ঞাসা করবে?’
ভূণী হঠাৎ যেন কূল পাইল। সে অদ্ভুত প্রত্যুৎপন্নমতিত্বের জোরে সহজ হইবার চেষ্টা করিয়া প্রশ্ন করিল, ‘আবার এলেন কেন জিজ্ঞাসা করতে পারি?’
জাহাঙ্গীর আহত হইয়া তাহার চোখে চোখ রাখিয়া বলিল, ‘আমি তো আসিনি, মা এসেছেন তোমায় নিয়ে যেতে!’
তহমিনা জিজ্ঞাসা করিল, ‘মা তা হলে সব শুনেছেন?’
জাহাঙ্গীর ম্লান হাসিয়া বলিল, ‘শুনেছেন নয় – জেনেছেন তোমার চিঠি পড়ে!’
তহমিনা লজ্জায় মরিয়া গিয়া বলিয়া উঠিল, ‘মা গো কী হবে! ছি ছি! তুমি চিঠি দেখালে কেন?’
জাহাঙ্গীর এইবার একটু জোরেই হাসিয়া ফেলিল।
তহমিনা উত্তেজনায় জাহাঙ্গীরের মুখের কাছে হাত আনিয়া সহসা থামিয়া গিয়া বলিয়া উঠিল, ‘দোহাই! অত জোরে হেসো না, কেউ জেগে উঠবে।’
জাহাঙ্গীরের মনে নেশা ধরিয়াছিল। সে আয়তচক্ষু মেলিয়া জিজ্ঞাসা করিল, ‘তুমি যাবে তো?’
তহমিনা লজ্জাজড়িত কণ্ঠে বলিল, ‘সে তো আপনিই জানেন!’
জাহাঙ্গীর হাসিয়া বলিল, ‘বাঃ রে! বেশ তো! একবার “আপনি!” একবার “তুমি” একবার “হিঁয়া আও” –একবার “ভাগো”!’
জাহাঙ্গীরের মাতা পাশ ফিরিয়া শুইতেই তহমিনা তাড়াতাড়ি দরজা বন্ধ করিয়া চলিয়া যাইবার চেষ্টা করিতেই অসাবধানে তাহার হাতের একটা আঙুল দুই দরজার মাঝখানে পড়িয়া পিষ্ট হইয়া গেল। সে ক্ষীণ আর্তনাদ করিয়া বসিয়া পড়িল।
জাহাঙ্গীর তাড়াতাড়ি তাহাকে ধরিয়া প্রশ্ন করিল, ‘কী হল ভূণী? কিছুতে কামড়েছে?’
ভূণী সে স্পর্শে কন্টকিত হইয়া মনে মনে বলিল, ‘কামড়েছে বিষধর সাপে!’ বাহিরে বলিল, ‘আঙুলটা দরজায় বড্ড চিপে গেছে!
জাহাঙ্গীর ক্ষীণ চন্দ্রালোকেও দেখিতে পাইল সত্যসত্যই আঙুলটা নীল হইয়া উঠিয়াছে। সে ভূণীর হাত নিজের হাতের মধ্যে টানিয়া লইল।
সে তাড়াতাড়ি আঙুলটা লইয়া চুষিতে চুষিতে বলিল, ইস! রক্ত জমে নীল হয়ে গেছে! একটু ভিজে ন্যাকড়া আনতে পার?’
তহমিনা তাহার অঙ্গুলিতে জাহাঙ্গীরের উত্তপ্ত মুখের শোষণ যতই অনুভব করিতেছিল, ততই পুলকে তাহার অঙ্গ শিথিল হইয়া আসিতেছিল। সে আর থাকিতে পারিল না – মূর্চ্ছিতার মতো জাহাঙ্গীরের অঙ্গে হেলিয়া পড়িল। জাহাঙ্গীর দিশা হারাইল। বক্ষে তহমিনার তপ্ত কোমল বক্ষের স্পর্শ পাইতেই তাহার রক্তে যেন তাহার পিতার লালসা বহ্নি জ্বলিয়া উঠিল।
সে জীবনে সংযম হারায়নি, আজ সে সংযম হারাইল। তহমিনাকে বিপুল আবেগে বক্ষে অজস্র পিষিতে পিষিতে জাহাঙ্গীর তাহার নিষ্কলঙ্ক গণ্ড অজস্র চুম্বন-কলঙ্কে ভরিয়া দিল।
তহমিনা সুখে, লজ্জায়, উত্তেজনায় শিথিল-তনু শিথিল-বসন হইয়া পড়িল। সে কিছুতেই যেন নিজেকে সংবরণ করিতে পারিতেছিল না। মনে হইল তাহার নড়িবার শক্তিটুকু পর্যন্ত কে হরণ করিয়া লইয়াছে! শুধু তাহার দুই বাহু দিয়া প্রাণপণ শক্তিতে জাহাঙ্গীরের কণ্ঠ জড়াইয়া একবার অস্ফুট মিনতি করিল।