জাহাঙ্গীর হাসিয়া বলিল, ‘গানটা জানি, কিন্তু গাইতে জানি না। আর জানলেও গাইতাম না।’
পাশের কামরা হইতে মা বলিয়া উঠিলেন, ‘খোকা বুঝি গান-টান একেবারে ভুলে গেছিস?’
জাহাঙ্গীর বলিল, ‘হাঁ, মা, ওসব ভুলে যাওয়াই ভালো। অনর্থক কতকগুলো লোকের শান্তিভঙ্গ করে লাভ কী?’
মা হাসিয়া বলিলেন, ‘গানে বুঝি শান্তিভঙ্গ হয়? তুই একেবারে ভূত হয়ে গেছিস খোকা! দুনিয়ায় কি তোর সব আশা-আকাঙ্ক্ষা মিটে গেছে এরই মধ্যে?’
জাহাঙ্গীর হাসিয়া আস্তে আস্তে বলিল, ‘বেটি ভয়ানক চালাক! পাশের জানলায় বসে শুনছেন আমরা কী কথা বলা-কওয়া করি!’
সন্ধ্যায় ট্রেন শিউড়ি আসিয়া পঁহুছিল।
হারুণ ছুটিয়া আসিয়া জাহাঙ্গীরের মাতার ও দেওয়ান সাহেবের পায়ের ধুলা লইল। মাতা তাহাকে জাহাঙ্গীরের মতোই বুকে ধরিয়া শিরশ্চুম্বন করিলেন।
দেওয়ান সাহেব এক ডজন কুলি লইয়া জিনিসপত্র নামাইতে লাগিলেন।
হঠাৎ মাতা জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘খোকা, তোর মউলবি সাহেব কোথায় গেলেন?’
জাহাঙ্গীর হাসিয়া বলিল, ‘উনি এতক্ষণ বোধ হয় তাঁর বোনের বাড়িতে গিয়ে উঠেছেন মা!’
মাতা বলিলেন, ‘সে কী! তুই ওঁর বোনের বাসা চিনিস? সেখান থেকে তাঁকে যে আনতেই হবে!’
জাহাঙ্গীর হাসিয়া বলিল, ‘সে তো আমি চিনি না মা। তা ছাড়া ওঁর বোনের অসুখ, এখন তো যেতেও পারতেন না।‘
হারুণ জিজ্ঞাসা করিল, ‘কোন মউলবি সাহেব?’
জাহাঙ্গীর বলিল, ‘প্রফেসার আজেহার সাহেব।’
হারুণ বলিল, ‘কই তাঁকে তো দেখলুম না।’
জাহাঙ্গীর বলিল, ‘তোমরা যতক্ষণ বোঁচকা-পুটুলি সামলাচ্ছিলে, ততক্ষণ উনি পগার পার হয়ে গেছেন।’
জাহাঙ্গীর দেখিল, অক্ষয়বাবু সারা প্ল্যাটফর্ম মন্থন করিয়া ফিরিতেছেন! সে অত্যন্ত কৌতুক অনুভব করিয়া মনে মনে বলিল, ‘ঘুঘু দেখেছ ফাঁদ দেখনি।’
তবু তাহার মনে কেমন একটা অজানা ভয় উঁকি দিয়া ফিরিতে লাগিল।
গোটা চার পালকি ও দুইখানা গোরুর গাড়ি বোঝাই হইয়া জিনিসপত্র সমেত সদলবলে জাহাঙ্গীর হারুণের গ্রামে যাত্রা করিল।
টর্চলাইট ও বন্দুক সাথে ছিল। তাহা ছাড়াও চারি বেহারার পালকি, গাড়োয়ান, ভোজপুরি বরকন্দাজ প্রভৃতির জন্য কেহ আর রাত্রে যাইতে আপত্তি করিল না। আকাশও বেশ পরিষ্কার ছিল, ঝড়-বৃষ্টির কোনো সম্ভাবনা ছিল না। নিদাঘের সুনির্মল আকাশে শুক্লা নবমীর চাঁদ শুক্লা নবমীর চাঁদ ঝলমল করিতেছিল।
পালকিতে উঠিয়া জাহাঙ্গীরের মাতা বলিলেন, ‘বাবা! এ রকম বাক্সবন্দি হয়ে যাওয়ার তো অভ্যাস নেই। একে এই গরম, তার ওপর এইরকম ঘাড়মুড় ভেঙে বসে থাকা। আমি তাই বলছিলাম মোটরটা সাথে আনতে।’
হারুণ হাসিয়া বলিল, ‘মোটর না এনে ভালোই করেছেন মা। এ দেশে মোটর যাবার রাস্তা নেই। তার ওপর মাঝে নদী।’
বিচিত্র শব্দ করিতে করিতে পালকি-বাহকগণ অগ্রে অগ্রে চলিল। পশ্চাতে গোরুর গাড়ি, সকলের শেষে বন্দুক স্কন্ধে বরকন্দাজ।
রাত্রি প্রায় এগারোটার সময় সকলে হারুণদের গ্রামে গিয়া পঁহুছিলেন। পল্লিগ্রামে রাত্রি এগারোটার সময় কেহ সজাগ ছিল না। বেগম দেখিতে হয়তো গ্রামের লোক ভাঙিয়া পড়িত। হারুণ তাহার পিতা ও বোনদের ছাড়া কাহাকেও এ খবর বলে নাই, কাজেই গ্রামেও এ সংবাদ রাষ্ট্র হইয়া পড়িতে পারে নাই। মোবারক তাহার এক বন্ধুকে এই খবর বলায় সে বিদ্রুপ করিয়া উড়াইয়া দিয়াছিল, উপরন্তু তাহার মাথায় জোর চাঁটি মারিয়া বলিয়াছিল যে, তাহারও পাগল হইবার আর দেরি নাই। ইহার পর সে আর কাহাকেও এ খোশখবর দিতে সাহস করে নাই।
এত পালকি এত লোকজন দেখিয়া মোবারক ভ্যাবাচাকা খাইয়া প্রস্তরবৎ দাঁড়াইয়া রহিল। মনে হইল, তাহার আক্কেল গুড়ুম হইয়া গিয়াছে। তাহার অন্ধ পিতা ব্যস্ত সমস্ত হইয়া ছুটাছুটি করিতে গিয়া দুইবার আছাড় খাইয়া পড়িয়া গেলেন। হারুণ তাহার পিতাকে স্থির হইতে বলিয়া জাহাঙ্গীরের মাতাকে সসম্মানে বাড়ির ভিতর লইয়া গেল। দেওয়ান সাহেব বাহির বাড়িতে গিয়া বসিলেন।
জাহাঙ্গীর সামনের খোলা মাঠে বসিয়া হাওয়া খাইয়া বাঁচিল।
তহমিনা ও মোমি আসিয়া জাহাঙ্গীরের মাতার কদমবুসি করিল। মাতা দুই বোনকে বক্ষে চাপিয়া ধরিয়া ললাট-চুম্বন করিলেন।
বাঁদিদের হাতে টর্চ-লাইট ছিল, তাহারই আলোকে মাতা অনিমেষ নেত্রে তাঁহার ভাবী বধূর মুখ দেখিতে লাগিলেন। হ্যাঁ, তাঁহার পুত্রবধূ হবার মতো রূপসি বটে!
মাতা বারেবারে তহমিনার ললাট, চিবুক ও শিরশ্চুম্বন করিতে লাগিলেন। তাঁহার অত্যধিক আদরে, কিংবা কেন জানি না, তহমিনা তাঁহার বুকে মুখ রাখিয়া ফোঁপাইয়া ফোঁপাইয়া কাঁদিতে লাগিল।
মা আঙিনাতেই দাঁড়াইয়া তাহাকে বক্ষে চাপিয়া ধরিয়া সান্ত্বনা দিতে লাগিলেন, ‘কেঁদো না মা আমার, সোনা আমার! আর ভয় কী! ও পাগল তোমার অসম্মান করেছে – আমি তোমাকে বুকে তুলে নিতে এসেছি।’
অনেকক্ষণ কাঁদিয়া তহমিনা শান্ত হইল। ভাগ্যক্রমে তাহার উন্মাদিনী মাতা তখন অঘোরে ঘুমাইতেছিলেন, নইলে তিনি হয়তো তাঁহার মিনার জন্য কাঁদিয়া কাটিয়া একাকার করিতেন।
বাড়ির অবস্থা দেখিয়া জাহাঙ্গীরের মাতার বুঝিতে বাকি রহিল না-দুরবস্থার শেষতম স্তরে ইহারা আসিয়া পড়িয়াছে। তাঁহার চক্ষে জল ভরিয়া আসিল। এমন সোনার চাঁদ মেয়েও এমন ঘরে থাকে!
তহমিনা সকলের জন্য রাঁধিয়া রাখিয়াছিল, সকলে তাহা খাইয়া তাহার রান্নার অশেষ তারিফ করিতে লাগিলেন।
হারুণের পিতা কেবলই বলিতে লাগিলেন, এ গরিবের বাড়ি হাতির পা পড়িবে – ইহা তিনি স্বপ্নেও ভাবেন নাই। তাহাদিগকে বসিতে দিবার মতো তাঁহার স্থান তো নাই। তাঁহার বিনয় ও অসোয়াস্তি দেখিয়া দেওয়ান সাহেব এবং বেগম সাহেবা ঘনিষ্ঠ আলাপ আপ্যায়নে তাঁহাকে আপন করিতে চেষ্টা করিতে লাগিলেন। হারুণের পিতা আনন্দে প্রায় কাঁদিয়া ফেলিলেন।