জাহাঙ্গীর একেবারে ভয় খাইয়া গেল। পাছে মাতার সন্দেহ আরও বাড়ে, তাই সে দ্বিরুক্তি না করিয়া মউলবি সাহেবকে খুঁজিতে নামিয়া গেল।
জাহাঙ্গীর অহেতুক ভয়চিত্ত। তাহার তথাকথিত মউলবি সাহেবকে বলিতেই তিনি সানন্দে দেওয়ান সাহেবের গাড়িতে আসিয়া বসিলেন এবং বিনা ওজরে খাদ্যাদির সৎকার করিলেন।
জাহাঙ্গীর অহেতুক ভয়চিত্ত। তাহার তথাকথিত মউলবি সাহেবকে বলিতেই তিনি সানন্দে দেওয়ান সাহেবের গাড়িতে আসিয়া বসিলেন এবং বিনা ওজরে খাদ্যাদির সৎকার করিলেন।
দেওয়ান সাহেব মউলবি সাহেবের সাথে জাহাঙ্গীরের কথা লইয়া আলোচনা করিতে লাগিলেন। জাহাঙ্গীর দেখিল, তাহার প্রমতদা নকল মউলবি হইলেও আসল মউলবির চেয়েও দুরস্ত-জবান। চমৎকার উর্দু-ফারসির আমেজ দিয়া তিনি কথা বলিতেছেন।
পাশের কামরা হইতে জাহাঙ্গীরের মাতা বাঁদি দিয়া বলিয়া পাঠাইলেন, মউলবি সাহেবকেও তাহাদের এই খুশিতে শরিক হইতে হইবে। অর্থাৎ তাহাদের সাথে তাঁহাকেও যাইতে হইবে।
মউলবি সাহেব বলিয়া পাঠাইলেন, তিনি অবশ্যই হুজুর আম্মার এ হুকুম পালন করিতেন যদি না শিউড়িতে তাঁহার রোগ-শায়িতা বহিনকে দেখিতে না যাইতেন!
মউলবি সাহেব জাহাঙ্গীরকে এক সময় একলা পাইয়া চুপি চুপি বলিলেন, ‘তোদের স্যালুনে জায়গা গেয়ে আমার ভালোই হল, শালার টিকটিকি আর পিছু নিতে পারবে না!’
জাহাঙ্গীর প্রশ্ন করিল, ‘কিন্তু প্রমতদা, আমার কী হবে? আমাকে যে যূপকাষ্ঠে নিয়ে যাচ্ছে!’
মউলবি সাহেব হাসিয়া বলিলেন, ‘খোদার মর্জি বাচ্চা! সব মেঘ কেটে যাবে! মাকে অসন্তুষ্ট কোরো না, খোদার রহম আপনি তোমার ওপর নাজেল হবে!’
জাহাঙ্গীর হাসিয়া ফেলিয়া বলিল, ‘সোবহান আল্লাহ্ মউলবি সাহেব! ক্যা তরিকা বাতায়া আপনে!’
মউলবি সাহেব এধার ওধার দেখিয়া লইয়া বলিলেন, ‘তোকে পিনাকীর মাসিমা ডেকেছেন, তা ছাড়া আমারও কাজ আছে। তুই হারুণের বাড়ির ফেরতা ওখান হয়ে যাবি।’
জাহাঙ্গীর বলিল, ‘কিন্তু মা যে সাথে আছেন!’
মউলবি সাহেব বলিলেন, ‘তার ব্যবস্থা করা যাবে খন।’
গাড়ি ছাড়িয়া দিল। জাহাঙ্গীরের বুক অজানা অশঙ্কায় কাঁপিয়া উঠিল।
কুহেলিকা – ১৫
বর্ধমান স্টেশনে নামিয়া জাহাঙ্গীর মউলবি সাহেবকে লইয়া ‘রিফ্রেশমেন্ট রুমে’ ঢুকিয়া পড়িল।
সৌভাগ্যবশত তাহারা দুই জন ছাড়া আর কেহ সেখানে ছিল না।
মউলবি সাহেব বলিলেন, ‘মামারা এখনও মুসলমানকে সন্দেহের চক্ষে দেখে না, তাই আজও দিনের আলোকে কোনোরকমে মউলবি সাহেব সেজে বেড়াচ্ছি। কিন্তু সে কথা যাক, তোর ওপর আবার ভীষণ কাজের ভার পড়বে, পারবি?’
জাহাঙ্গীর বলিল, ‘এর মধ্যে তো পারা-না-পারার কথা নেই। যা আদেশ করবেন, তা আমায় পালন করতেই হবে।’
মউলবি সাহেব খুশি হইয়া বলিয়া উঠিলেন, ‘জিতা রহো লেড়কা! তোকে আবার মালপত্র সরিয়ে নিয়ে আসতে হবে। তুই ছাড়া এ-কাজ আর কারুর দ্বারাই হবার নয়।’
জাহাঙ্গীর বলিল, ‘সেবার কিন্তু মরতে মরতে বেঁচে গেছি দাদা! আবগারি সাব-ইন্স্পেকটার যখন গাড়িতে উঠে বাক্স-প্যাঁটরা খুলতে আরম্ভ করলে, তখন আমার আত্মারাম তো খাঁচা-ছাড়া হবার যো হয়েছিল। সৌভাগ্যক্রমে এক জনের প্যাঁটরা থেকে সের কতক আফিম বেরোতেই সে তাকে পাকড়াও করে নেমে গেল। একে একে সব বাক্স যদি খুঁজত, কী হত তাহলে ভাবতেও গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠে!’ বলিয়াই সামলাইয়া লইল, ‘ভাবনা আমার নিজের জন্য ছিল না – ভাবনা ছিল জিনিসপত্রগুলো নিয়ে। সে ব্যাটাও মরত – হয়তো বা আমিও মরতুম – মাঝে অত দামি জিনিসগুলো বেহাত হয়ে যেত!’
মউলবি সাহেব বলিলেন, যাক এবার তোদের স্যালুনেই ওগুলো নিয়ে যেতে পারবি ফিরে যাবার সময়। কারুর কোনো সন্দেহের অবকাশ থাকবে না।
জাহাঙ্গীর হঠাৎ অপ্রসন্ন হইয়া বলিয়া উঠিল, ‘কিন্তু এবার যে আমার বোধ হয় জোড়ে ফিরতে হবে দাদা!’
মউলবি সাহেব বলিলেন, ‘দেখ – নিয়তিকে এড়াতে পারবিনে। আমাদের বজ্রপাণিও তো বিবাহিত। শুধু বিবাহিতই নন, ছেলে-পিলে ঘর-সংসার আছে। আসল কথা, তোর যদি সত্যকার দেশপ্রেম থাকে – কোনো ব্যাটাই তোর সামনে দাঁড়াতে পারবে না।’
গাড়ি ছাড়িবার ঘণ্টা পড়িতেই, তাহারা তাড়াতাড়ি উঠিয়া পড়িল। উঠিতে দরজার সামনে এক চিরপরিচিত ব্যক্তিকে দেখিয়া জাহাঙ্গীর থতমত খাইয়া গেল। এ যে সেই ধাড়ি টিকটিকি অক্ষয়বাবু! জাহাঙ্গীরের অবস্থা বুঝিয়াই যেন মউলবি সাহেব কাংস্য কণ্ঠে বলিয়া উঠিলেন, ‘আরে বেহোঁশ! আভি টারিন ছোড় দেগা! দৌড়কে চল!’
অক্ষয়বাবু বাজপাখির মতো চোখে তাহাদের দিকে তাকাইয়া থাকিলেন।
জাহাঙ্গীরকে দেখিয়া অক্ষয়বাবুও পাশের গাড়িতে উঠিয়া পড়িল।
জাহাঙ্গীর ইঙ্গিত করিতেই মউলবি সাহেব বলিয়া উঠিলেন, ‘কুছ ফিকির নেই বাচ্চা, উয়ো হজম হো যায়েগা।’
দেওয়ান সাহেব হাসিয়া বলিলেন, ‘আর একটু দেরি হলেই স্টেশনে বসে বসে হজম করতে হত মউলবি সাহেব। আর আপনারা নামবেন না কোথাও! গাড়িতেই খাবার আনিয়ে নেবেন!’
অণ্ডাল স্টেশনে গাড়ি বদল করিবার সময় জাহাঙ্গীর দেখিল, অক্ষয়বাবু তাহাদের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করিতেছেন। সেদিকে আর বেশি দৃষ্টিপাত না করিয়া একটা বই লইয়া পড়িতে লাগিল। তাহাদের গাড়ি হইতে নামিবার ঝঞ্ঝাট পোহাইতে হইল না। তাহাদের স্যালুন ইঞ্জিন আসিয়া টানিয়া শিউড়ির গাড়ির ন্যাজে জুড়িয়া দিল।
মউলবি সাহেব হাসিয়া বলিলেন, ‘অমন আড়াল দিয়ে লুকিয়ে গেলে চলবে না, গানটা জান?’