মা বলিলেন, ‘সে কাল সকালে বোঝা যাবে। সকালেই ট্রেন, আমি টেলিগ্রাম করে দিয়েছি হারুণের ওখানে। হারুণ শিউড়ি স্টেশনে থাকবে! তুই মুখ হাত ধুয়ে কাপড় ছেড়ে প্রস্তুত হয়ে নে, আমি আসছি!’ জাহাঙ্গীর মুখ হাত ধুইয়া কাপড় ছাড়িয়া চা খাইতে খাইতে নানান আকাশ-কুসুমের কল্পনা করিতে লাগিল। তাহার আর সেখানে যাওয়া উচিত কিনা। অথচ সে না গেলে যদি তাহারা আসিতে অসম্মত হয়। সত্যই তাহার পাপের যদি কিছু মাত্রও প্রায়শ্চিত্ত হয় হারুণকে দারিদ্রের কবল হইতে রক্ষা করিয়া, তাহা হইলেও তাহার যাওয়াই উচিত। কিন্তু তাহাকে দেখিয়া যদি আবার ভূণীর অভিমান উথলিয়া উঠে! হারুণই যদি এই অনুগ্রহ লইতে অসম্মত হয়! তাহার পিতা যদি পৈতৃক ভিটা ছাড়িয়া আসিতে না চান। কিন্তু এ সকলের ঊর্ধ্বে সে তাহার বুদ্ধিমতী মাতার স্নেহপ্রবণ হৃদয়ের ও দেওয়ান সাহেবের বৈষয়িক বুদ্ধির উপর বেশি ভরসা রাখে। তাঁহারা ইহার একটা কিনারা করিয়া উঠিতে পারিবেন নিশ্চয়। কিন্তু তবু ওই দলিতা নাগিনির মতো তহমিনা? সে যদি ফণা তুলিয়া দাঁড়ায়! হঠাৎ জাহাঙ্গীরের চিত্ত বিক্ষুব্ধ হইয়া উঠিল। না, তাহার কিছুতেই যাওয়া হইতে পারে না। মাতা যাইতেছেন, যান, সে অপমানিত হইতে কিছুতেই সেখানে যাইবে না!
মাতা আসিয়া বলিলেন, ‘খোকা ওঠ, রাত্রি সাড়ে আটটা বেজে গেল। দোকানপাট বন্ধ হয়ে যাবে আবার।’
জাহাঙ্গীর সুবোধ বালকের মতো মাতার সহিত গিয়া গাড়িতে বসিল। দেওয়ানজি অন্য গাড়িতে উঠিলেন।
মাতার বাজার করিবার ঘটা দেখিয়া জাহাঙ্গীর হাসিয়া বলিল, ‘মা, তুমি যে জুয়েলারির আর কাপড়ের দোকান উজাড় করে নিয়ে যাবে দেখছি!’
মা হেসে বলিলেন, ‘এতদিন পরে মেয়ে পেলুম, তাকে দেবার মতন গয়না-কাপড় কি তবু পাওয়া গেল! তুই ওকে যা দুঃখ দিয়েছিস, এত গয়না-কাপড় দিয়েও তো তা ঢাকতে পারব না খোকা!’
জাহাঙ্গীর আর কোনো কথা বলিতে সাহস করিল না।
দেওয়ান সাহেবের ভ্রুকুটি মুখেও খুশি যেন আর ধরে না। ফররোখ সাহেব শুধু তাঁহার প্রভু ছিলেন না, তাঁহার প্রিয়তম বন্ধুও ছিলেন। তিনি বাঁচিয়া থাকিতে এবং আজও দেওয়ান সাহেব কোনোদিন ভাবিবার অবকাশ পান নাই যে, তিনি বেতনভোগী ভৃত্য। পরম বিশ্বাসে তাঁহার হাতে জমিদারির সমস্ত দায়িত্ব অর্পণ করিয়া ফররোখ সাহেব আনন্দ করিয়া কাটাইয়াছেন। জাহাঙ্গীরের মাতাও তেমনি বিশ্বাস ও শ্রদ্ধা সহকারে দেওয়ান সাহেবকে সম্মান করিয়া আসিতেছেন। দেওয়ান সাহেবের দুইটি পুত্র। দুইটি পুত্রই বিলাতে গিয়াছে। বন্ধুজ ও প্রভুপুত্র জাহাঙ্গীরকে পুত্রাধিক স্নেহের চক্ষে দেখিতেন বলিয়াই তাহার ভাবী সুখের সম্ভাবনায় এতটা উল্লসিত হইয়া উঠিয়াছেন।
এত বড়ো বিষয়ী ও মিতব্যয়ী দেওয়ান সাহেবও সেদিন যেন অতি বড়ো অমিতব্যয়ী হইয়া উঠিলেন। জাহাঙ্গীর ইহা লইয়া একবার বলিয়া ফেলিল, ‘আজ দেওয়ান সাহেবের আঙুলগুলো অতিরিক্ত ফাঁক হয়ে গেছে! যে আঙুল দিয়ে কখনও জল গলেনি, সেই আঙুলের ফাঁক দিয়ে হাজার হাজার টাকা বেরিয়ে যাচ্ছে!’
দেওয়ানজি শুনিতে পাইয়া বলিয়া উঠিলেন, ‘কিন্তু এ টাকা তো জলে পড়ছে না বাবাজি! যার টাকা তাকেই দিচ্ছি। এই জমিদারিই দু-দিন পরে যার কাছে বিকিয়ে দিতে যাচ্ছি, এই দু-দশ হাজার টাকা নজরানাও তার কাছে কিছুই নয়। তুমি তো জমিদারি দেখলে না বাবা, এইবার যে দেখবে – তাকে এ কয়-টাকার জিনিস আর দিলুম?’
জাহাঙ্গীরের মাতা অশ্রুভারাক্রান্ত কণ্ঠে বলিলেন, ‘তুই কী বলছিস খোকা, তোর বাবা মরবার সময় যে ওই দেওয়ানজির হাতেই তোকে দিয়ে গেছিলেন । আজ তোর আনন্দের দিনে উনি কি হিসেব করে আনন্দ করবেন?’
পরদিন সকালে হাওড়া প্ল্যাটফর্মে স্তূপীকৃত হইয়া উঠিল রাশি রাশি জিনিসপত্র একটা স্যালুনের সামনে! দেওয়ানজি প্ল্যাটফর্মে ছুটাছুটি করিয়া চেঁচাইয়া হইচই বাধাইয়া তুলিলেন।
জাহাঙ্গীর কলের পুতুলের মতো দেওয়ান সাহেব ও তাহার মাতার আদেশ পালন করিয়া যাইতে লাগিল। স্টেশনে হঠাৎ এক জন মউলবি সাহেব চলিয়া যাইতে যাইতে যেন জাহাঙ্গীরকে ছড়ির মৃদু আঘাত করিয়া গেল। জাহাঙ্গীর ফিরিয়া দেখিবামাত্র মউলবি সাহিব ইঙ্গিতে তাহাকে ডাকিলেন। কাছে যাইতেই মউলবি সাহেব বলিলেন ‘আমি সব জানি। শিউড়িতে নেমে আমার সাথে দেখা করিস। আমিও সেখানেই নামব।’
জাহাঙ্গীর হাসিয়া নমস্কার করিতে গিয়া সামলাইয়া লইয়া আদাব করিয়া চলিয়া আসিল।
মাতা জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘উনি কে খোকা?’
জাহাঙ্গীর বলিল, ‘উনি আমাদের কলেজের আরবির প্রফেসর। উনিও শিউড়ি যাচ্ছেন, তাই আমায় শিউড়িতে নেমে দেখা করতে বললেন।’
মাতা আর প্রশ্ন করিলেন না। জাহাঙ্গীর তাহার প্রমতদার এই হঠাৎ আবির্ভাবে একটু চিন্তান্বিত হইয়া পড়িল। সে হঠাৎ এই ভাবিয়া খুশি হইয়া উঠিল, যে সুখের স্বর্গ সে রচনা করিতে চলিয়াছে – এইবার তাহা হয়তো তাহার অদৃশ্য ভাগ্যদেবতার রুদ্র আশীর্বাদে আগুনে পুড়িয়া যাইবে।
মাতা হঠাৎ বলিয়া উঠিলেন, ‘খোকা, তোর মউলবি সাহেবকে আমাদের স্যালুনেই ডেকে নে না। দেওয়ান সাহেবের কামরায় তিনি থাকবেন। যা, ডেকে এনে খেতেটেতে দে।’
জাহাঙ্গীর প্রমাদ গণিল! তাহার মনে হইল মাতা বোধ হয় সন্দেহ করিয়াছেন।
সে বলিল, ‘আর তো ট্রেন ছাড়বার সময় নেই মা। ওঁকে বরং বর্ধমান স্টেশনে ডেকে নেব আমাদের গাড়িতে।’
মাতা বলিলেন, ‘না, না, যথেষ্ট সময় আছে! এখনও আধ ঘণ্টা দেরি। ভদ্রলোকের হয়তো কত কষ্ট হবে। তিনি তোর মাস্টার, কী মনে করবেন বল তো! তা ছাড়া ওঁকে দিয়ে আমার কাজ আছে।’