আপনি কূলে উঠিয়াছেন। যাহারা তরঙ্গে ডুবিতেছে – তাহাদের লইয়া এ বিদ্রুপ কেন?
ইচ্ছা করিলেই কি আপনার কূলে উঠিতে পারি? আপনি কী ভাবিয়া আমায় ডাকিয়াছেন, জানি না।
যে অধিকার আমার মা আপনাকে দিয়াছেন – সেই অধিকারের দাবি লইয়া যেদিন শুধু আপনি নয় – আপনার অভিভাবিকা জননী আসিয়া ডাকিবেন – সেই দিন হয়তো যাইতে পারি। কিন্তু তাহার পূর্বে নয়। লোকসমাজের শ্রদ্ধা হারাইয়া আপনার কাছে গেলে – আপনিই আমায় শ্রদ্ধা করিতে পারিবেন না। অন্তরে যাহাকে স্বীকার করিয়া লইয়াছি, বাহিরের দিনের আলোকে তাহাকে স্বীকার করিবার সৌভাগ্য যদি অর্জন করি, সেদিন আপনার আদেশে আমি মৃত্যুর মুখোমুখি গিয়া দাঁড়াইতে পারিব।
আশা করি, আপনি আমায় ভুল বুঝিবেন না। এবং আর এরূপ ছেলেমানুষিও করিবেন না। আমার আত্মসম্মান আপনার আত্মসম্মানের চেয়ে কোনো অংশে হীন বা ন্যূন নহে!
বাহিরের ঐশ্বর্যের দম্ভ আমার নাই, আমরা দরিদ্র; কিন্তু অন্তরের ঐশ্বর্যের গৌরব আমার অন্তত আপনার অপেক্ষা কম নাই।
আমাদের মাঝে যে অকূল পারাবার বহিয়া চলিত – তাহাই হয়তো আমার নিয়তি।
এ কূলে আপনি আসিয়াছেন, ইহাই আমার পরম সৌভাগ্য বলিয়া মানিব। ও কূল হইতে আর হতছানি দিয়া ডাকিবেন না। মানুষেরই তো মন, একবার যদি ঝাঁপাইয়া পড়ি প্রলোভনের বশে এ কূল ও কূল দুই কূল হারাইব।
মা আপনার জন্য এখনও কাঁদেন। বলেন, “মিনা এসে চলে গেল! ও আর আসবে না!” যদি উপযুক্ত চিকিৎসা হইত, মা হয়তো ভালো হইলেও হইতে পারিতেন।
এইবার বাবার আর দাদার পাগল হইতে বাকি, আপনার অনুগ্রহে হয়তো তাহারও আর বিলম্ব নাই।
আপনি কি জাদু জানেন? মোমি আর মোবারক আজও আপনার ওকালতি করে! দুটো কাপড় আর দু হাঁড়ি সন্দেশের এমনই মোহ! চির-দুঃখী কিনা!
আমাকে ভুলিয়াও যে স্মরণ করিয়াছেন, তজ্জন্য আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ। আরও ধন্যবাদ দিব, যদি স্মরণ করিয়া ভুলিয়া যান এবং এইরূপ অসম্মানজনক পত্রাদি প্রেরণ না করেন! ইতি –
আপনার দয়া – ঋণী
তহমিনা।”
কুহেলিকা – ১৪
জাহাঙ্গীর সুখ ও দুঃখের নানা স্বপ্ন দেখিতে দেখিতে কখন ঘুমাইয়া পড়িয়াছিল।
জাগিয়া দেখিল, তাহার মাতা শিয়রে বসিয়া অতন্দ্রনয়নে তাহার পানে চাহিয়া আছেন।
সে চোখ মেলিতেই মা বলিয়া উঠিলেন, ‘জেগে উঠলি খোকা? ঘুমো আরও খানিক।’
জাহাঙ্গীর উঠিয়া বসিয়া বলিল, ‘না মা, আর ঘুম হবে না।’ বলিয়াই উসখুস করিতে লাগিল।
মা হাসিয়া বলিলেন, ‘তুই কী ভাবছিস বলতো! আমি কালই হারুণের বাড়ি যাব। দেওয়ান সাহেবও যাবেন, তোকেও যেতে হবে।’
জাহাঙ্গীর কোনোরূপে শুধু বলিতে পারিল…’মা!’
মা বলিলেন, ‘হাঁ, এ তোর মায়ের আদেশ।’ বলিয়াই একটু থামিয়া বলিলেন ‘তোর পাঞ্জাবিটা ধুতে দিতে গিয়ে তার পকেটে বউমার লেখা চিঠি দেখেছি। এমন মেয়ে পেয়েও যদি তুই মাথায় তুলে না নিস, বুঝব তোর কপালে বড়ো দুঃখ আছে। তুই না নিস, আমি আমার ঘরের লক্ষ্মীকে মাথায় করে নিয়ে আসব। আমি হজ করতে যাব বলে বেরিয়েছিলুম – খোদা আমার হজের পুণ্য রাস্তাতেই দিয়েছেন। তাকে না নিতে পারলে খোদা নারাজ হবেন!’
জাহাঙ্গীর ফাঁসির আসামির মতো দয়া ভিক্ষার স্বরে বলিয়া উঠিল, ‘দোহাই মা, আমায় এত বড়ো শাস্তি দিয়ো না। এ শাস্তির অংশ তাকেও নিতে হবে তা হলে। তা ছাড়া সে যা মেয়ে – তুমি গেলেও সে আসবে না – যদি না আমি তাকে সত্যিকার বিয়ে করি।’
মা হাসিয়া বলিলেন, ‘তোর বিয়েতে এত ভয় কেন খোকা বল তো! তোকে তো কেউ ফাঁসি দিচ্ছে না!’ – বলিয়া জিভ কাটিয়া ‘ষাট ষাট বালাই’ বলিয়া পুত্রের শিরশম্বন করিয়া বলিলেন, ‘কী বদখেয়ালি কথা মুখ দিয়ে বেরিয়ে যায় গো মা! – যাক, এখন যদি তুই রাজি নাই হোস – তার ব্যবস্থাও দেওয়ানজি করে রেখেছেন। হারুণকে আমার স্টেটে এখন শ-তিনেক টাকার চাকরি দিয়ে ওদের সপরিবারে কলকাতায় নিয়ে আসব। চব্বিশ পরগনায় রায়েদের একটা বড়ো জমিদারি বিক্রি হচ্ছে – সেটা কিনে নেবার ব্যবস্থা করেছি। হারুণ সেই স্টেটের ম্যানেজার হবে। তারপর যা করবার, করা যাবে।’
জাহাঙ্গীর এক মুহূর্তে সব ভুলিয়া গিয়া বলিয়া উঠিল, ‘সত্যি মা, তুমি হারুণকে নিয়ে আসবে? আহা, বেচারার বড়ো দুঃখ মা! এইবার বি.এ. দেবে, কিন্তু পাশ করলেও সে চাকরি পেত কোথায়? অথচ ওর চাকরি না হলে ওরা সব কটি প্রাণী উপোস করে মরবে! ওকে যদি চাকরি দিয়ে আনতে পার তা হলে আমার কৃতকার্যের অনেকটা অনুশোচনা কমে।’
মা হাসিয়া বলিলেন, ‘তোর পাপের প্রায়শ্চিত্ত হয় বল।’– মা মনে মনে ভাবিলেন, ছেলে শুধু হারুণের চাকরির জন্যই খুশি হইয়া উঠে নাই, তাহার সাথে মেয়েটাও যে আসিবে, ইহাও তাহার খুশি হইয়া উঠার অন্যতম কারণ। তাঁহার মনের মেঘ অনেকটা কাটিয়া গেল! ছেলেবেলা হইতেই তাঁহার খোকা বিবাহ ব্যাপারে অতিরিক্ত লজ্জা অনুভব করে। ওরূপ খেয়াল অনেক ছেলেরই থাকে এবং তাহা কাটিয়া যাইতেও দেরি হয় না। তাঁহার খোকাও হয়তো মনে মনে রাজি আছে, শুধু লজ্জার খাতিরে এতটা করিতেছে। তাই অত্যন্ত প্রসন্ন মনে উঠিয়া পড়িয়া বলিলেন, ‘বেশি রাত্রি হয়নি এখনও। এখনই আমার সব দরকারি জিনিসপত্র কিনে ফেলতে হবে, তুইও আমার সাথে চল। দেওয়ানজি গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করছেন বাইরের ঘরে।’
জাহাঙ্গীর উঠিতে উঠিতে বলিল, ‘কিন্তু আমাকে আর যেতে হবে না তো সাথে?’