মা এইবার রাগিয়া উঠিয়া বলিলেন, ‘চুপ কর হতভাগা ছেলে! যা নয় তাই বলা হচ্ছে!’ – বলিয়াই স্নেহ বিগলিত স্বরে বলিলেন, ‘সত্যি খোকা বল, তুই আমার ঘরে বউ এনে দিবি? আর ভূতের মতো একলা বাড়ি আগলাতে পারিনে! কেমন? তা হলে জিনিসপত্র খুলতে বলি?’ – বলিয়া হাঁক-ডাক দিতে আরম্ভ করিলেন, ‘ওরে মোতিয়া, দেওয়ানজিকে একবার খবর দে তো !’
মোতিয়া বাড়িরই পুরাতন ঝি। সে এতক্ষণ সব শুনিতেছিল আড়ালে থাকিয়া। এই খোশখবরে সে আর থাকিতে না পারিয়া বলিয়া উঠিল, ‘বেগম আম্মা, আপনি দেইহ্যা বুঝবার পারছেন না, ভাইজানের মুখ ক্যামন শুরুষকু অইয়্যা গিয়াছে! জোয়ান পোলার শাদি না দিলে সে তাই ব্যাওরা অইয়্যা যাইব না?’
জাহাঙ্গীর হো হো শব্দে হাসিয়া উঠিল। মা-ও হাসিয়া ফেলিয়া বলিলেন, ‘তুই যা দেখি, আগে দেওয়ান সাহেবকে ডেকে আন, তার পর তোর ভাইজানের শাদির কথা হবে।’
জাহাঙ্গীর বলিয়া উঠিল, ‘তার আগে মা তোমার সব কথা ভালো করে শোনা দরকার!’
মোতিয়া তাহার কাজলায়িত চক্ষু বিস্ফারিত করিয়া জাহাঙ্গীরের দিকে তাকাইয়া চলিয়া গেল।
মাতা পুত্রের রুক্ষ চুলের মধ্যে অঙ্গুলি চালনা করিতে করিতে বলিলেন, ‘কতদিন তেল মাখিসনে খোকা, বল তো! তুই কি সন্ন্যাসী হয়ে যাবি নাকি শেষে?’
জাহাঙ্গীর হাসিয়া বলিল, ‘কিন্তু তুমি তো সন্ন্যাসী হতে দেবে না। সে যাক, তুমি যে আসল কথাটাই শুনতে চাচ্ছ না!’
মা হাসিয়া বলিলেন, ‘সে কথা না শুনেই আমি বুঝেছি। সে মেয়েটি কোথায় থাকে বল, তার পর আমার যা করবার আমি করব!’
জাহাঙ্গীর লজ্জিত হইয়া বলিল, ‘তুমি যা মনে করছ মা তা নয়। আমি তোমার কাছে কিছু লুকোব না। সব শুনে তুমি যা করতে বলবে তাই করা যাবে।’
জাহাঙ্গীর হারুণদের বাড়ি যাওয়া হইতে আরম্ভ করিয়া তাহার উন্মাদিনী মাতার কীর্তি পর্যন্ত সমস্ত ঘটনা বলিয়া গেল। বলিল না শুধু তাহার বিপ্লবীদলের সহিত সংশ্লিষ্ট থাকার কথা।
মাতা বিস্ময়াভিভূত হইয়া অনেকক্ষণ বসিয়া রহিলেন, তাঁহার মুখ দিয়া কোনো কথা উচ্চারিত হইল না। ক্ষণে ক্ষণে তাঁহার মুখে আনন্দ ও শঙ্কার আলোছায়া খেলিয়া যাইতে লাগিল।
হঠাৎ জাহাঙ্গীর বলিয়া উঠিল, ‘কিন্তু মা তাকে কিছুতেই এ বাড়িতে আনা যেতে পারে না। তোমাকে বলতে ভুলে গেছি – সে অতিমাত্রায় অহংকারী মেয়ে। আমার মা গিয়ে তাকে অভ্যর্থনা করে আনলে তবে নাকি তিনি আমাদের ঘরে শুভ পদার্পণ করলেও করতে পারেন। বিষ নেই মা, কিন্তু ফণা-আস্ফালন আছে!’
মা হাসিয়া ফেলিয়া বলিলেন, ‘সে ঠিকই বলেছে খোকা। তা যদি সে না বলত, আমি তাকে আনবার কথা ভাবতে পারতুম না। যে সাপ ফণা ধরে – তার বিষও থাকে, সে জাতসাপ।’
জাহাঙ্গীর ভয় পাইয়া বলিয়া উঠিল, ‘তুমি কি তাকে এ বাড়িতে আনবে মা?’
মা হাসিয়া বলিলেন, ‘তা আনতে হবে বইকী! খোদা নিজে হাতে যে সওগাত পাঠিয়েছেন তাকে মাথায় তুলে নিতে হবে।’
জাহাঙ্গীর ক্লান্ত কণ্ঠে বলিয়া উঠিল, ‘কিন্তু মা আমি তো তাকে বিয়ে করতে পারি না। তাকে কেন, কাউকেই বিয়ে করবার অধিকার আমার নেই!’
মা চমকিয়া উঠিয়া কী ভাবিলেন। তাহার পর আদেশের স্বরে বলিলেন, ‘তোর তো বিয়ে হয়ে গেছে খোকা। তুই তাকে অস্বীকার করতে পারিস, কিন্তু সে মেয়েকে না দেখলেও তোর কাছে তার সম্বন্ধে যা শুনেছি – তাতে মনে হচ্ছে – সে তোকে অস্বীকার করতে পারবে না। তুই যদি তাকে না নিস, সে তার নিয়তিকে মেনে নিয়ে চিরকাল দুঃখ ভোগ করবে। জানি না, তার অদৃষ্টে কী আছে, কিন্তু আমার ছেলে যদি তার কাছে চির-অপরাধীই থেকে যায় আমাকে তার প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে!’
জাহাঙ্গীর শূন্যদৃষ্টিতে একবার তাহার মাতার পানে চাহিয়া অসহায়ভাবে শুইয়া পড়িল।
মা ম্লান হাসি হাসিয়া বলিলেন, ‘কিন্তু তোর এত ভয় কেন খোকা? সে কি সুন্দরী নয়? না অন্য কারণে তোর মনে ধরেনি?’
জাহাঙ্গীর রুগ্ণ-কণ্ঠে বলিয়া উঠিল, ‘না মা, তা নয়। তার মতো সুন্দরী মেয়ে খুব কমই চোখে পড়ে। তুমি তো হারুণকে দেখেছ। তার চেয়েও সে সুন্দর। আর, মনে ধরার কথাই উঠতে পারে না, কেননা সে মনই আমার নেই। আমায় বিয়ে করতে নেই – তাই বলছিলুম।’
মাতা স্থিরদৃষ্টিতে পুত্রের পানে তাকাইয়া বলিয়া উঠিলেন, ‘বিয়ে করতে নেই মানে? তুই কি ফকির-দরবেশের ব্রত নিয়েছিস?’
জাহাঙ্গীর অন্যদিকে চাহিয়া বলিল, ‘কতকটা তাই!’
মাতার দুই চোখ অশ্রুতে পুরিয়া উঠিল! তবে কি পুত্র তাহার জন্ম-কাহিনির বেদনা আজও ভুলিতে পারে নাই? আজও কি সে তার জন্মের জন্য অনুতপ্ত?
মোতিয়া আসিয়া খবর দিল, দেওয়ান সাহেব আসিয়াছেন। মাতা মোতিয়াকে বলিলেন, ‘তুই তোর ভাইজানের কাছে থাক, দেওয়ান সাহেবের সাথে আমার কথা আছে।’ বলিয়া পাশের কামরায় উঠিয়া গেলেন।
মোতিয়া জাহাঙ্গীরের পানে পৌনে দুই চোখে তাকাইয়া মুচকি হাসিয়া বলিল, ‘ভাইজান, পা টিপ্যা দিবাম নি?’
জাহাঙ্গীর কোনো উত্তর দিল না। হয়তো সে তাহার কথা শুনিতেই পায় নাই।
মোতিয়া জাহাঙ্গীরের পা কোলে তুলিয়া লইয়া টিপিতে লাগিল।
জাহাঙ্গীর আপত্তি করিল না।
তখন মনে তাহার ঝড় বহিতেছিল। তাহার মনে পড়িল, ভূণীর চিঠির কথা। পর দিন অর্থের লোভে গোরুর গাড়ির সেই গাড়োয়ান সত্যসত্যই শিউড়ি স্টেশনে পত্রের উত্তর লইয়া আসিয়াছিল।
ভূণী লিখিয়াছিল: ‘যদি মা আমাকে আপনার হাতে সঁপিয়া না দিতেন, আমি আপনার পত্রের উত্তর দেওয়া অপমানজনক মনে করিতাম! আপনি যাহাকে চিরজীবনের নির্বাসন-দণ্ড দিয়া গিয়াছেন, হঠাৎ তাহার প্রতি এই করুণার হেতু কী, জানি না। আমি আপনাকে যতটুকু বুঝিয়াছি – তাহাতে আমার ধারণা – হৃদয় ছাড়া অপনার সকল কিছুই আছে। কিন্তু সে সকল লইয়া তো – নারী আমি – আমার কোনো লাভ নাই। দুঃখের সমুদ্রে কলার ভেলায় আমরা ভাসিতেছিলাম। হঠাৎ আপনার বিপুল অর্ণবপোত আমাদের কাছে আসিল। উদ্ধার পাইবার আশা করি নাই, বরং মনে যে ভয়ের সঞ্চার হইয়াছিল – তাহাই ফলিয়া গেল। আপনার জাহাজের ঢেউ লাগিয়া আমাদের কলার ভেলাখানি ডুবিয়া গেল। এখন তরঙ্গের সঙ্গে যুদ্ধ করা ছাড়া অন্য পথ নাই। যতদিন শক্তি থাকিবে যুদ্ধ করিব।