সকলে স্তব্ধ হইয়া শুনিতেছিল এই আধ-পাগলের প্রলাপ। কে একজন বলিয়া উঠিল, ‘পাগলের পাগলামিতেও মাঝে মাঝে মানে থাকে!’ উলঝলুল জোরে-জোরে সিগারেট টানিয়া নিমেষে প্রায় দেড়টা সিগারেট পুড়াইয়া ফেলিল। তাহার পর আবার বলিতে আরম্ভ করিল। –
‘দেখো মানুষ যা নয়, সেই মিথ্যায় অভিষিক্ত করে তাকে খুব শ্রদ্ধা দেখাচ্ছ বলে তোমরা খুব বাহবা নিতে পার, কিন্তু আমার শ্রদ্ধা করার ধারা অন্য রকম। মানুষের – তা তিনি নর হন আর নারীই হন – যা আছে তাই নিয়েই তাকে যথেষ্ট শ্রদ্ধাঞ্জলি দেবার, সম্মান দেখাবার শক্তি ও সাহস আমার আছে। আমার মত অন্তত অতটুকু তৈরি হয়েছে। – শয়তান সৃষ্টি করা সত্ত্বেও আমি স্রষ্টাকে সম্মান করি। তোমরা শয়তানের নিন্দা করে স্রষ্টার ওপর ‘সেনসার মোসন’ আন, প্রকারান্তরে তাঁর সৃষ্টির দোষ ধরে সমালোচনা কর, আমি তা করিনে – এই যা তফাত। তোমরা নারীকে দেবী বলে এই কথাটাই পাকে-প্রকারে স্মরণ করিয়ে দাও যে, সে আসলে মানবী – দেবী হলেই তাকে মানায় ভালো! নারীকে এ অবমাননা করবার দুর্মতি আমার যেন কোনো দিন না হয়।’
তমিজ এতক্ষণ ধরিয়া কথা কহে নাই। সে অতিমাত্রায় রুচিবাগীশ। এই জন্য সকলে তাহাকে বে-তমিজ বলিয়া খ্যাপাইত। তাহার আদর্শ ছিল রামানন্দ ও তুষ্ণীকুমার বাবু। উলঝলুলকে সে সহিতে পারিত না। সে একেবারে খেপিয়া উঠিয়া বলিল, ‘বাবা পাগলা-গাজি, তুমি থামো! তোমার আর বক্তিমে দিতে হবে না! তোমার মতো বিশ্ব-বখাটে ছেলের আদর্শ নিয়ে জগৎ চলছে না আর চলবেও না!’
উলঝলুল হাসিয়া বলিল, “ভাই বে-তমিজ! চটছ কেন? আমি তো তোমার ‘সাধারণ ব্রাহ্ম মন্দিরে’ বা ‘দেবালয়ে’ গিয়ে বক্তৃতা দিচ্ছিনে। তোমার গুরুর আর তোমাদের মতন আদর্শবাদীর ন্যাকামি আর মিথ্যাচার অসহ্য বলেই তো এত ঘা দিই। শয়তানের ওপর আমার কোনো আক্রোশ নেই, কেননা সে যা – তা সে লুকোয় না, তাকে চিনতে কারুর বেগ পেতে হয় না। কিন্তু ভিতরের কড়া-ক্রান্তি-হিসাবরত স্বার্থপর মুদিওয়ালা বানিয়াকে যখন বাইরের আচার্যের দাড়ি দিয়ে ঢাকতে যাও, তখনই আমি আসি ওই পর-দাড়ির মুখোশ খুলে তার ভিতরের বীভৎস কদর্যতা সকলের সামনে তুলে ধরতে। অবশ্য, তার জন্য আমাকেও অনেকটা নীচে নেমে যেতে হয়। কিন্তু যাক, তোমার রুচিবিকারের ভণ্ডামি আর ন্যাকামি নিয়ে আলোচনা করবার যদি দরকার হয় আর একদিন করব। আমাদের যে আলোচনা চলছিল – তাই চলুক।’
হারুণ বলিল, ‘তুমি কি বলছ, নারীর আর যত রূপ মিথ্যা? সেবিকা, প্রীতিময়ী, স্নেহময়ী – এসব রূপ তার ছলনা? এ মূর্তি সে নিয়েছে তার পুরুষের স্তুতি আর বন্দনার প্রতিদানে – কিংবা তা আরও পাবার লোভে? অথবা তাকে এ সাজে সাজিয়েছে ঈর্ষাতুর পুরুষ? তাকে অবগুন্ঠন পরিয়েছে পুরুষ, মানি – কিন্তু সে তো তাকে সুন্দর করার উদ্দেশ্যেই। নারীকে ঘোমটার আড়াল করে দাঁড় করিয়েই তো তাকে পাবার নেশা বাড়িয়ে দিয়েছে হৃদয়ের। এই আড়ালই কাব্য সৃষ্টি করছে। যক্ষকে চিত্রকূটের আড়াল না দিলে কি মেঘদূত-এর সৃষ্টি হত? সীতাকে রাবণ হরণ না করলে কি রামায়ণ পেতাম? দ্রৌপদীর কেশাকর্ষণ কৌরবেরা করেছিল বলেই মহাভারতের মহাদানে আমাদের পাত্র পূর্ণ হয়ে উঠেছে!’
উলঝলুল পুঞ্জীভূত ধূম্র নাসিকা ও মুখ-গহ্বর দিয়া উদ্গিরণ করিয়া আরও কিছু বলিবার আয়োজন করিতেই চা, গুড়ের সন্দেশ এবং লুচি আসিয়া হাজির হইল।
দেখা গেল, যুবকদের কাছেও নারী অপেক্ষা গুড়ের সন্দেশ অনেক মিষ্টি এবং লুচি ও চা ঢের ঢের প্রিয়। গুড়ের সন্দেশ ও লুচিতে নারী ডুবিয়া গেল। তাহাদের খাইবার ধরন দেখিয়া মনে হইল, যেন বাঁকুড়ার দুর্ভিক্ষ-প্রপীড়িত অথবা ছিয়াত্তরের মন্বন্তর-ফেরত একদল বুভুক্ষু। কুম্ভীর মিয়াঁ এক গালে এক ডজন লুচি ও এক গালে এক ডজন গুড়ের সন্দেশ পুরিয়া মুখ-সঞ্চালনবিদ্যার যে অদ্ভুত আর্ট দেখাইতেছিল, তাহা দেখিয়া কেহ হাসিতেছিল – কেহ ওই বিদ্যা আয়ত্ত করিবার মকশো করিতেছিল, আর যাহারা রাগিয়া উঠিতেছিল তাহাদেরই মধ্যে একজন খানিকটা নস্য লইয়া কুম্ভীর মিয়াঁর নাকে ঠাসিয়া দিল। কুম্ভীর মিয়াঁ নস্য লইত না। অতএব ইহার পর যে বীভৎস দৃশ্যের সৃষ্টি হইল, তাহা না বলাই ভালো। তাহার মুখ-গহ্বর হইতে লালা-মিশ্রিত সমস্ত লুচি ও সন্দেশ উৎক্ষিপ্ত হইয়া প্রায় সকলের অঙ্গ অভিষিক্ত করিয়া দিল। খাওয়া রহিল পড়িয়া, লাফাইয়া যে যেখানে পারিল পলাইল। কিন্তু কুম্ভীর মিয়াঁর হাঁচি আর থামে না। হাঁচিতে, কাশিতে, লালাতে, শিকনিতে মিশিয়া একটা বিতিকিচ্ছি ব্যাপার হইয়া গেল। বিকচ্ছ ও প্রায় দিগ্বসন কুম্ভীর মিয়াঁর ভুঁড়ি হাঁচির বেগে প্রবল বেগে আন্দোলিত হইতে লাগিল, – স্টিমার পার হইয়া যাইবার পর গঙ্গা-বক্ষের বয়া যেমন করিয়া দুলিতে থাকে! চক্ষু ত্রৈলঙ্গ স্বামীর মতো হইয়া উঠিল। হাঁচি-নিষিক্ত নাসিকা দেখিয়া মনে হইল, যেন কর্তিত খেজুরগুঁড়ি দিয়া রস চোঁয়াইতেছে। কেহ তাহার মাথায় কেহ বা ভুঁড়িতে বদনা বদনা পানি ঢালিতে লাগিল। তরিক ‘সুরা ইয়াসিন’ পড়িয়া শুনাইতে লাগিল। ‘সুরা ইয়াসিন’ অন্তিম সময়েই শুনাইয়া থাকে এবং ‘আজান’ নামাজের সময় ব্যতীত অন্য সময় দিলে সাধারণত লোকে মনে করিয়া থাকে – কাহারও বাড়িতে সন্তান হইয়াছে। সুতরাং তরিকের ‘সুরা ইয়াসিন’ পড়াতে যত না হাসির সৃষ্টি হইল, আমজাদ তাড়াতাড়ি কাছা খুলিয়া প্রাণপণ চিৎকারে আজান দিতে শুরু করায় সকলে হাসিয়া লুটাইয়া পড়িল!