জাহাঙ্গীরের যখন ঘুম ভাঙিল, তখন বেলা গড়াইয়া পড়িয়াছে। ঘুম ভাঙিতেই দেখিল সামনে চেয়ারে বসিয়া দেওয়ানজি। জাহাঙ্গীর উঠিয়া শশব্যস্তে তাঁহার পায়ের ধুলা লইল।
দেওয়ানজি তাহাকে একেবারে বুকে চাপিয়া ধরিয়া বলিয়া উঠিলেন, ‘বাবা, বেগম মা অস্থির হয়ে উঠেছেন। তুমি এখনই চলো। আজ দু-দিন তিনি না খেয়ে আছেন।’
জাহাঙ্গীর কুঁজো হইতে জল গড়াইয়া লইয়া চোখে মুখে দিতে দিতে বিস্ময়ান্বিত কণ্ঠে বলিয়া উঠিল, ‘মা? মাও এসেছেন নাকি?’
দেওয়ানজি বলিলেন, ‘হাঁ বাবা, তোমার কোনো খবর না পেয়ে অসুখ-বিসুখ হয়ছে মনে করে কাল আমরা এসেছি। এসে অবধি তোমায় খুঁজছি। তুমি সাত দিন ধরে এখানে নেই শুনে তিনি সেই যে শয্যা নিয়েছেন আর ওঠেননি। কেউ এতটুকু পানি মুখে দিতে পারেনি!’
জাহাঙ্গীর জামা পরিতে পরিতে ক্লান্ত কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করিল, ‘কোন বাড়িতে উঠেছেন এসে?’
দেওয়ানজি উঠিতে উঠিতে বলিলেন, ‘লোয়ার সার্কুলার রোডের বাড়িতে। অন্য বাড়ি তো সব ভাড়া দেওয়া হয়ে গেছে। ওটাই শুধু খালি হয়েছে মাত্র সেদিন!’- বলিয়াই একটু থামিয়া বলিয়া উঠিলেন, ‘তুমি তো কোনো খবরই রাখ না বাবা। নিজের বাড়িঘরগুলোরও না।’
জাহাঙ্গীর উচ্চবাচ্য না করিয়া বাহির হইয়া পড়িল।
দেওয়ানজি নামিতে নামিতে দীর্ঘশ্বাস মোচন করিয়া বলিলেন, ‘কী চেহারা হয়েছে তোমার, দেখো তো! কে বলবে নওয়াব বাড়ির ছেলে! যেন পথের ভিখিরি!’
জাহাঙ্গীর হাসিয়া ফেলিয়া বলিল, ‘আমি তো সত্যই ভিখিরি দেওয়ান সাহেব! বাপের জমিদারি, ও তো আমি অর্জন করিনি!’
জাহাঙ্গীরের চোখে-মুখে এক অব্যক্ত-ব্যথার ছাপ ফুটিয়া উঠিল। দেওয়ানজি কিছু বুঝিতে না পারিয়া বিমূঢ়ের মতো তাকাইয়া থাকিলেন।
মোটরে যাইতে যাইতে জাহাঙ্গীর সাহস পাইয়া জিজ্ঞাসা করিল, ‘আচ্ছা দেওয়ান সাহেব, খবর সব ভালো তো? এত ঘন ঘন টেলিগ্রাম করা কেন বলুন তো! এ অকর্মণ্যকে নিয়ে কেন এ অনর্থক টানাটানি?’– তাহার কথায় সুরে তিক্ত শ্রান্তি ফুটিয়া উঠিল।
দেওয়ানজি স্টেট চালাইয়া ঝানু হইয়া গিয়াছেন। কিন্তু মানুষের বিশেষ করিয়া আজকালকার যুবকদের অন্তর লইয়া কখনও তাঁহার মাথাব্যথা হয়ও নাই, আর চেষ্টা করিয়াও ওর কূল পান না। তবু তাঁহার হঠাৎ মনে হইল তরুণ যুবক হয়তো-বা কোথাও লভ-টভ করিয়া বসিয়াছে। তিনি মনে মনে এ রোগের ওষুধের কথা চিন্তা করিয়া প্রসন্ন হইয়া উঠিলেন।
বলিয়া উঠিলেন, ‘খবর ভালোই বাবা। শুধু আমাদের বেগম-মা জিদ ধরেছেন, তিনি মক্কা যাবেন হজ করতে। আর এক হপ্তার মধ্যেই জাহাজ ছাড়বে। তিনি তোমায় সমস্ত বুঝিয়ে দিয়ে যেতে চান । তাই এত তাড়াতাড়ি!’
জাহাঙ্গীর আর শুনিতে পারিল না। কেমন যেন এক অজানা আতঙ্কে তাহার সারা দেহ মন শিহরিয়া উঠিল। অসহায়ভাবে মোটরে হেলান দিয়া শুইয়া পড়িয়া বলিল, ‘দেওয়ান সাহেব, এখন থাক, মার কাছে গিয়েই সব শুনব!’
কুহেলিকা – ১৩
জাহাঙ্গীর আসিয়া পৌঁছাইতেই তাহার মাতা একেবারে তাহাকে বুকে জড়াইয়া কাঁদিয়া ফেলিলেন, ‘খোকা, এ কী চেহারা হয়েছে তোর?’
জাহাঙ্গীর কিছু না বলিয়া মায়ের কোলে মাথা রাখিয়া শুইয়া পড়িল। জননী উদ্গত অশ্রু সংবরণ করিতে করিতে নীরবে ছেলের মাথায় মুখে হাত বুলাইয়া দিতে লাগিলেন।
জাহাঙ্গীর হঠাৎ উঠিয়া পড়িয়া বলিল, ‘তোমার খাওয়া হয়নি দু-দিন থেকে! আগে খেয়ে নাও, তার পর সব কথা হবে।’
অনিচ্ছা সত্ত্বেও পুত্রের পীড়াপীড়িতে তাঁহাকে উঠিয়া খাইয়া আসিতে হইল।
জাহাঙ্গীর ততক্ষণে ঘরের চতুর্দিকে ঘুরিয়া ঘুরিয়া দেখিতে লাগিল, সত্যসত্যই কোনো দূরদেশে যাইবার জন্যই তাহার মা প্রস্তুত হইয়া আসিয়াছেন। বুঝিতে তাহার বাকি রহিল না, মায়ের এ অভিমান কাহার উপর! সে সংসারী হইল না, ঘর সংসারের কোনোকিছু দেখিল না শুনিল না বলিয়াই মা স্বেচ্ছায় সংসার হইতে সরিয়া দাঁড়াইতেছেন। এ হয়তো অভিমান করিয়া পুত্রকে শাস্তিই দিতেছেন তিনি। জাহাঙ্গীর গভীর দীর্ঘশ্বাস মোচন করিয়া একটা সোফায় বসিয়া অস্ত-আকাশের রং-এর খেলা দেখিতে লাগিল। রং তো নয়, ও মায়া, স্বপ্ন। ও রং লাগিতেও যতক্ষণ মুছিতেও ততক্ষণ।
ওই গোধূলিবেলার রং-এর মতো সুখের স্বপ্নের ছোপ তাহার চিত্তে লাগিয়াই আবার পরক্ষণে মুছিয়া যায়। ওই অস্ত-আকাশের মতোই নির্লিপ্ত তার মন। কত রং আসে, খেলিয়া যায়, তার পরে একেবারে নিশ্চিহ্ন হইয়া মুছিয়া যায় কঠোর বাস্তবের দিবালোকে। এই রং-এর মায়ায় সে ভুলিবে না। ইহাকে প্রশ্রয় দিবে না। তাহার কাছে শুধু দিনের আলো আর রাতের আঁধারই সত্য। নিষ্ঠুর বাস্তবতা আর অসীম দুঃখ সূর্যালোক আর আঁধারের মতো তাহার জীবনকে জড়াইয়া আছে। ইহাকে অতিক্রম করিয়া যাহা কিছু তাহা কেবলই রং-এর মায়া, মরীচিকার প্রতারণা।
সে কী করিবে ভাবিতে লাগিল।
কিন্তু বেশি ভাবিবার অবকাশও সে পাইল না। মাতা খাইয়া আসিয়া পার্শ্বে বসিয়া বলিলেন, ‘সত্য বল দেখি খোকা, তোর কী হয়েছে! দিন দিন তোর চেহারাই বা অমন হচ্ছে কেন? কী হয়েছিস, একবার আয়নার দিকে তাকিয়ে দেখ দেখি।’
জাহাঙ্গীরের মেসে বড়ো আয়না ছিল না। তাছাড়া চুলটুল চিরুনিও করে সে সাধারণত কম। করিলেও এত অন্যমনস্কভাবে করে, যে তাহার নিজের চেহারার দিকে লক্ষ করিবার মতো মনের অবস্থা তাহার থাকে না। মায়ের কথায় হঠাৎ সামনের বড়ো আয়নার দিকে তাকাইয়া সে নিজেকে এতদিন পরে ভালো করিয়া দেখিল। দেখিয়া লজ্জিত হইয়া মুখ ফিরাইয়া লইল। সত্যই তাহার চেহারা অতিমাত্রায় লক্ষ্মীছাড়া হইয়া গিয়াছে। এই ঘরে তাহাকে যেন মানাইতেছিল না।