পিনাকীকে বিপ্লব-সংঘে সকলেই অতিরিক্ত স্নেহ করিত। সে ছিল তাহাদের দলের বয়োকনিষ্ঠদের অন্যতম। তাহা ছাড়া, সে যাইত সর্বাপেক্ষা দুঃসাহসের কাজে সর্বাগ্রে।
মৃত্যুকে সে রাঙা উত্তরীয়ের মতো সারা গায়ে জড়াইয়া ধরিতে চাহিত!
তাহার ফাঁসির দিন বজ্রপাণি হইতে আরম্ভ করিয়া বিপ্লবীদের প্রত্যেকে শিশুর মতো রোদন করিয়াছিল।
ফাঁসির পূর্বে ম্যাজিস্ট্রেট যখন তাহাকে জিজ্ঞাসা করিয়াছিল, ‘তুমি কি কাউকে দেখতে চাও?’
পিনাকী হাসিয়া বলিয়াছিল, ‘চাই, কিন্তু তুমি তা দেখাতে পারবে না!’
ম্যাজিস্ট্রেট তার শিশুর মতো মুখের পানে তাকাইয়া জোরের সঙ্গে বলিয়াছিল, ‘নিশ্চয়ই পারব! বলো কাকে দেখতে চাও?’
পিনাকী তেমনি মধুর হাসিতে মুখ আলো করিয়া বলিয়াছিল, ‘আমি চাই ভারতের স্বাধীনতা দেখতে! পারবে দেখাতে?’
ম্যাজিস্ট্রেট তৎক্ষণাৎ তাহার মাথার টুপি খুলিয়া বালককে অভিবাদন করিয়া অশ্রুপূর্ণনেত্রে বলিয়াছিল, ‘আমি তোমায় প্রণাম করি বালক। মৃত্যুমঞ্চই তোমার মতো বীরের মৃত্যুঞ্জয়ী সম্মান। তোমার মতো বীরের বন্দনা করবার সম্বল জীবনের নাই।’
আজ জয়তী দেবীর জাহাঙ্গীরের প্রতি এই অদ্ভুত অনুরোধ শুনিয়া সকলের সেই সব কথাই স্মরণ হইতে লাগিল!
একটু পরেই জয়তী আসিয়া বলিলেন, ‘তোমরা তোমাদের কাজ করো গিয়ে, আমি একটু ওর সঙ্গে আলাপ করি।’
প্রমত্ত অন্যান্য ছেলেদের লইয়া চলিয়া গেল। জাহাঙ্গীর একা কেমন একটু অস্বস্তি অনুভব করিতে লাগিল।
জয়তী কাছে আসিয়া বসিয়া বলিলেন, ‘তোমায় পিনাকী বলে ডাকব, কেমন?’ –কণ্ঠ তাঁর যেন ভাঙিয়া আসিল।
জাহাঙ্গীরের চক্ষে এতক্ষণে যেন এই রহস্যের কুহেলিকা কাটিয়া গেল। এখন সে বুঝিতে পারিল, কেন জয়তী দেবী তাহাকে মাসিমা বলিতে অনুরোধ করিলেন। তাহারও চক্ষু জলে ভরিয়া উঠিল। দেখিতে দেখিতে তাহার দুই চক্ষু বহিয়া টসটস করিয়া জল গড়াইয়া পড়িতে লাগিল। হঠাৎ সে বলিল, ‘তুমি কি বীর পিনাকীর মাসিমা?’
জাহাঙ্গীরের এই তুমি সম্ভাষণে এমন পাষাণ-প্রতিমার মতো কঠিন জয়তীও যেন ভাঙিয়া পড়িলেন। জাহাঙ্গীরের শিরশ্চুম্বন করিয়া বলিলেন, ‘হাঁ বাবা ‘আমিই সে দুর্ভাগিনি।’
তাহার পর একটু থামিয়া বলিলেন, ‘তোকে দেখতে অনেকটা পিনাকীর মতো।’
জাহাঙ্গীর হাসিয়া বলিল, ‘তুমি দুর্ভাগিনি নও মাসিমা, ভাগ্যবতী। কিন্তু সে যাক, তোমায় না ভেবে ছুঁয়ে ফেলেছি, তোমায় হয়তো আবার স্নান করতে হবে!’
জয়তী বেদনায় নীল হইয়া বলিলেন, ‘ও কথা বলিসনে বাবা, ও কথা শুনলেও পাপ হয় মানুষকে মানুষ ছুঁলে স্নান করতে হয়, মানুষের এত বড়ো অবমাননাকর শাস্ত্র সৃষ্টি হয়েছিল বলেই আমাদের এই দুর্দশা। জানিনে তুই কী জাত, কিন্তু তুই যদি হাড়ি-ডোমও হতিস তা হলেও তোকে ছুঁতে এতটুকু ইতস্তত হত না আমার! ওরে, জন্মটা তো দৈব। যেদিন আরেকজনকে আরেকজাতের ভেবে ঘৃণা করব, সেই দিনই আমার স্বাধীনতা মন্ত্র আমার কাছে ব্যর্থ হয়ে যাবে! তা ছাড়া, তোরা তো আগুনের শিখা, তোদের ছোঁয়ায় সেসব অশুচি শুচি হয়ে ওঠে বাবা!’
জাহাঙ্গীর অবাক হইয়া জয়তীর মুখের পানে তাকাইয়া বলিল, ‘এই যদি আমাদের অন্তরের কথা হয় মাসিমা, তা হলে এই আমাদের সবচেয়ে বড়ো মন্ত্র। আর শুধু এই মন্ত্রের জোরেই বিনা রক্তপাতে আমরা ভারত স্বাধীন করতে পারব।’
এমন সময় অন্য ঘর হইতে জয়তীর একমাত্র কন্যা ঘুম হইতে জাগিয়া ‘মা মা’ বলিয়া ডাকিতে লাগিল।
জয়তী কন্যাকে ডাকিয়া বলিলেন, ‘এইখানে উঠে আয় চম্পা, তোর একজন নতুন দাদা এসেছে।’
চম্পা আলুথালু বেশে তাহার মাতার নিকট আসিয়া বলিল, ‘কই মা?’ বলিয়াই জাহাঙ্গীরকে দেখিয়া একটু থতমত খাইয়া গেল।
জয়তী মলিন হাসি হাসিয়া বলিলেন, ‘ওকে অনেকটা পিনাকীর মতো দেখাচ্ছে, না?’
পিনাকীর নাম করিতেই চম্পার দুই চোখে অশ্রুর বান ডাকিল। সে সেই অশ্রুসিক্ত চক্ষু দিয়া জাহাঙ্গীরকে দেখিতে দিখিতে হঠাৎ তাহার কাছে আসিয়া প্রণাম করিয়া বলিল, ‘দাদাকে কী বলে ডাকব মা?’
জয়তী হাসিয়া ফেলিয়া বলিলেন, ‘দাদাকে আবার কী বলে ডাকবি? দাদাই বলবি!’
চম্পা লজ্জা পাইয়া জয়তীর পশ্চাতে আসিয়া মুখ লুকাইল!
জাহাঙ্গীর দেখিল, চম্পা যেন শুক্লা চতুর্দশীর চাঁদ। সহসা তাহার ভূণীকে মনে পড়িল। ইহারা মায়াবিনীর জাত। ইহারা সকল কল্যাণের পথে মায়াজাল পাতিয়া রাখিয়াছে। ইহারা সকল কল্যাণের পথে মায়াজাল পাতিয়া রাখিয়াছে। ইহারা গহনপথের কণ্টক, রাজপথের দস্যু। সে নিঃশব্দে উঠানে আসিয়া দাঁড়াইল। দেখিল, দূরে বনানীর অন্ধকারে নিশীথের চাঁদ মলিনমুখে অস্ত যাইতেছে, আর পূর্বগগন নবারুণের উদয় আশায় রাঙিয়া উঠিতেছে!
কুহেলিকা – ১২
জাহাঙ্গীর কলিকাতা ফিরিয়া আসিয়াই দেখে দুই তিনখানা টেলিগ্রাম আসিয়া পড়িয়া আছে। একখানা দেওয়ানজির, দুইখানা তাহার মায়ের প্রেরিত। পর পর দুইখানা টেলিগ্রাম করিয়াও তাহার উত্তর না পাইয়া স্নেহবৎসলা জননী আবার ‘রিপ্লাই-পেড’ টেলিগ্রাম করিয়াছেন। এইবার উত্তর না দিলে দেওয়ানজিকে লইয়া তিনি নিজেই কলিকাতা আসিয়া তাহাকে পাকড়াও করিবেন – এমন ইঙ্গিতও দিয়াছেন টেলিগ্রামে।
জাহাঙ্গীরের মাতা ঘুণাক্ষরেও জানিতেন না যে তাঁহার পুত্র বিপ্লব-মন্ত্রে দীক্ষা লইয়াছে, বা সে কলিকাতায় মাঝে মাঝে থাকে না – ওই মন্ত্রের উপাসনার জন্য। কাজেই তিনি মনে করিতেছিলেন, হয় জাহাঙ্গীর পীড়িত, নয় সে ইচ্ছা করিয়াই উত্তর দিতেছে না।