প্রমত্তকে সে জানিত। সে জানে, ইহাদের চক্ষে ধুলা দিতে এক জাহাঙ্গীরই যথেষ্ট, প্রমত্তের ন্যায় সেনানীর দরকার পড়ে না। তবু তাহার কেমন যেন ভয় করিতে লাগিল!
হঠাৎ অন্য দ্বার দিয়া ঢুকিয়া প্রমত্ত বলিয়া উঠিল ‘আসসালামো আলায়কুম! ক্যা মিয়াঁসাব শ্বশরুয়া চলা গিয়া?’
জাহাঙ্গীর লাফাইয়া উঠিয়া বলিল, ‘জি হাঁ! মগর আপ ইস ওক্ত ক্যেঁও’ – বলিয়াই এদিক-ওদিক দৃষ্টিপাত করিয়া গলা খাটো করিয়া বলিল, ‘আপনি সরে পড়ুন প্রমতদা, স্যাঙাতরা নিশ্চয় এইখানেই কোথাও আছে!’
প্রমত্ত পরম নিশ্চিন্তভাবে চেয়ারে বসিয়া বলিল, ‘তোকে সে ভাবনা ভাবতে হবে না। তুই চল দেখি আমার সাথে, এখখুনি এক জায়গায় যেতে হবে।’
জাহাঙ্গীর কোনো প্রশ্ন না করিয়া মিলিটারি কায়দায় উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিল ‘রেডি স্যার।’
সমস্ত জিনিসপত্র স্টেশন মাস্টারের হেফাজতে রাখিয়া সে বাহিরে আসিয়া দেখিল, একখানা মোটরের সম্মুখে প্রমত্ত সন্ন্যাসীর সাজে সাজিয়া দাঁড়াইয়া আছে। দুইজনে মোটরে উঠিয়া বসিলে মোটর বিদ্যুদ্বেগে ছুটিয়া চলিল।
জাহাঙ্গীর বলিল, ‘কী করতে হবে দাদা আমায়, জিজ্ঞাসা করতে পারি কি?’
প্রমত্ত হাসিয়া বলিল, ‘আর কেউ হলে বলতাম না, আমি তোকে জানি বলেই বলছি। একটু দূরেই কোনো গ্রামে যাচ্ছি। সেখানে আমাদের কিছু অস্ত্রশস্ত্র আছে। পুলিশ তা টের পেয়েছে বলে খবর পেয়েছি। আজ ভোরের মধ্যেই তা সরিয়ে আর কোথাও রেখে যেতে হবে – আমার ওপর বজ্রপাণির এ হুকুম।’
জাহাঙ্গীর কিছু প্রশ্ন করিল না। উত্তেজনা উৎসাহে তাহার রক্ত গরম হইয়া উঠিল। হঠাৎ সে প্রশ্ন করিয়া বসিল, ‘রাস্তায় যদি পুলিশের সঙ্গে দেখা হয়?’
প্রমত্ত উত্তর দিল না। মাঝে মাঝে উঁকি দিয়া রাস্তার দিকে দেখিতে লাগিল। হঠাৎ এক জায়গায় গাড়ি থামাইতে বলিয়া একটি ক্ষুদ্র শিস দিল। দেখিতে দেখিতে অন্ধকার ভেদ করিয়া চার পাঁচজন লোক আসিয়া নিঃশব্দে মোটরে বসিতেই আবার মোটর ছুটিতে লাগিল।
ঘণ্টাখানেক পরে তাহারা একটি গ্রামের ভিতর প্রবেশ করিয়া বাঁশবন-ঘেরা একটি ক্ষুদ্র মেটে ঘরের সম্মুখে আসিয়া থামিল। জাহাঙ্গীর সেই স্বল্প তারকালোকেই দেখিতে পাইল, গাড়ি থামিবামাত্র একটি স্ত্রীলোক দুয়ারে আসিয়া দাঁড়াইল। প্রমত্ত গিয়া তাঁহার পায়ের ধুলা লইল।
প্রমত্তের ইঙ্গিতে সকলে নামিয়া পড়িল এবং সকলের সাথে জাহাঙ্গীরও মহিলাটিকে প্রণাম করিল, কিন্তু সে যেন দায়ে পড়িয়া।
ঘরের ভিতরে গিয়া স্বল্প দীপালোকেই জাহাঙ্গীর যে মহীয়সী জ্যোতির্ময়ী মূর্তি দেখিল, তাহাতে এই নারীকে প্রণাম করিতে গিয়া তাহার মন যে-টুকু বিস্বাদ হইয়া উঠিয়াছিল, তাহার জন্য নিজেকে ধিক্কার না দিয়া পারিল না।
মহিলার বয়স ছত্রিশ সাঁইত্রিশের বেশি হইবে না। পরনে শুধু একখানি পরিষ্কার সাদা ধুতি। যেন গায়ের রং-এর সাথে মিশিয়া গিয়াছে। ঘাড় পর্যন্ত ছোটো করিয়া কাটা চুল – অনেকটা বাবরি চুলের মতো। তাহারই কতকগুলো ললাটে ও মুখের আশেপাশে আসিয়া পড়িয়াছে। বড়ো বড়ো চক্ষু, কিন্তু তাহা যেন একটু অতিরিক্ত প্রখর, সহজে চোখের দিকে চাওয়া যায় না। চোখ যেন ঝলসিয়া যায়। মুখ পুরুষের মতো দৃপ্ত, মহিমোজ্জ্বল!
জাহাঙ্গীর মনে মনে বলিল, ‘নারী যদি নাগিনি হয়, তুমি নাগেশ্বরী।’
জাহাঙ্গীরের চিন্তায় বাধা পড়িল। প্রমত্ত নিম্নস্বরে বলিল, ‘এদের সব কে বুঝি চেন না জয়তীদি?’
জাহাঙ্গীর মনে মনে বলিল, ‘তুমি সত্যই জয়তী দেবী।’ জীবনে সে বুঝি এই প্রথম নারীকে শ্রদ্ধার চোখে দেখিল। জয়তী দেবী সকলের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখিতে দেখিতে জাহাঙ্গীর দিকে তাকাইয়া বলিলেন, ‘এ ছেলেটিকে তো আগে দেখিনি!’
প্রমত্ত হাসিয়া বলিল, ‘এ পথ-ভোলা ছেলে দিদি। এ আমাদের গোষ্ঠীর নয়।’
প্রমত্তের এই কথায় অন্যান্য সকলে চঞ্চল হইয়া উঠিল। শুধু জয়তী দেবী বিস্ময়-বিস্ফারিত নেত্রে জাহাঙ্গীরকে দেখিতে লাগিলেন! হঠাৎ তিনি প্রশ্ন করিয়া বসিলেন ‘তোমার মা বেঁচে আছেন?’
জাহাঙ্গীর উত্তর করিল, ‘আছেন।’ জয়তী যেন আরও আশ্চর্য হইয়া তাহাকে দেখিতে লাগিলেন।
প্রমত্ত হাসিয়া বলিল, ‘দিদি বোধ হয় ভাবছ, মা থাকতে ওর অমন লক্ষ্মীছাড়ার মতো চেহারা কেন, না? সত্যিই ও লক্ষ্মীছাড়া। হাতের লক্ষ্মী পায়ে ঠেলতে পেরেছে বলেই ওকে দলে নিয়েছি।’
জয়তীর প্রখর চক্ষু স্নেহে কোমল হইয়া আসিল। স্নেহসিক্ত কণ্ঠে তিনি বলিয়া উঠিলেন, ‘তুমি আমায় দিদি না বলে মাসিমা বলে ডেকো, কেমন?’ বলিয়াই জয়তী অন্য ঘরে চলিয়া গেলেন।
জাহাঙ্গীর ব্যতীত আর সকলেরই চক্ষু জলে পুরিয়া উঠিল! জয়তীর এই অনুরোধের অর্থ বুঝিতে তাহাদের বাকি রহিল না।
জয়তীর ছোটো বোন সন্তান-প্রসব করিয়াই মারা যায়। সেই ছেলেকে জয়তী লইয়া আসিয়া মানুষ করেন। নাম রাখেন পিনাকপাণি। সকলে ‘পিনাকী’ বলিয়া ডাকিত। রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রে লিপ্ত বলিয়া গত বৎসর তাহার ফাঁসি হইয়া গিয়াছে! ফাঁসির মঞ্চেও সে জীবনের জয়গান গাহিয়াছে!
যেদিন পিনাকীর ফাঁসি হয়, সেইদিনই জয়তী গঙ্গাস্নান করিয়া রক্তবস্ত্র পরিধান করিয়া স্বয়ং বজ্রপাণির কাছে স্বদেশি মন্ত্রের দীক্ষা গ্রহণ করেন। আজ জয়তী বিপ্লবীদের শক্তি-স্বরুপা হইয়া দাঁড়াইয়াছেন।
জয়তীর ওই উক্তির পর সকলে এমনকি প্রমত্ত পর্যন্ত বিস্মিত হইয়া দেখিল, জাহাঙ্গীরের সঙ্গে পিনাকীর বেশ খানিকটা সাদৃশ্য আছে।